কুর্দিস্তান নিয়ে মূল রাজনীতিটা কী
সিরাজুল ইসলাম, তেহরান থেকে।
কুর্দিস্তান নিয়ে লেখার শুরুতেই ইরাকের নিরাপত্তা বিশ্লেষক আহমাদ আল-শারিফির একটি মন্তব্য উল্লেখ করতে চাই। তিনি গত ২২ সেপ্টেম্বর রাশিয়ার স্পুৎনিক সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, কুর্দিস্তানে গণভোট অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে ইহুদিবাদী ইসরাইল মূলত এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চায়। বিষয়টিকে তিনি ব্যাখ্যা করে বলেছেন, কুর্দিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার মাধ্যমে ইসরাইল একদিকে তার জ্বালানি চাহিদা পূরণ করবে; অন্যদিকে আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী ইরাক ও সিরিয়াকে দুর্বল করবে। কুর্দিস্তান সংকট বোঝার জন্য সম্ভবত ইরাকী এ বিশ্লেষকের এই একটি মন্তব্যই যথেষ্ট। তারপরও কুর্দিস্তান নিয়ে যে মূল রাজনীতি তার স্বরূপ উন্মোচনের জন্য আরো একটু গভীরে যাওয়ার চেষ্টা করব। সে আলোচনায় আঞ্চলিক গুরুত্বপূর্ণ শক্তি ইরান ও তুরস্কের ভূমিকা নিয়ে কথা বলব। কথা বলব- সৌদি আরব এবং তার প্রধান মিত্র আমেরিকার ভূমিকা নিয়েও। কুর্দিস্তানের প্রতি ইসরাইলসহ অনেকের লোলুপ দৃষ্টি কেন- সে কথাগুলো সহজভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করব। সামগ্রিক বিশ্লেষণে বিষয়টি পরিষ্কার হবে বলে আশা করি।
কুর্দিস্তান বহুদিনের একটা সমস্যা। তবে, সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্য ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়েছে। কুর্দি নেতারা বিশেষ করে আধা-স্বায়ত্ত্বশাসিত কুর্দিস্তানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ বারজানি কুর্দি অঞ্চলকে ইরাকের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য গত ২৫ সেপ্টেম্বর যে গণভোটের আয়োজন করেন তারপর থেকে কুর্দিস্তান আন্তর্জাতিক রাজনীতির অনেকটা কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে। তবে, ইরাক সরকার বিষয়টিকে যথেষ্ট দক্ষতার সঙ্গে মোকাবেলা করে চলেছে। ইস্যুটিকে তারা কোনাভাবেই এমন পর্যায়ে যেতে দিতে চান নি যাতে কুর্দিস্তানকে কেন্দ্র করে আবার সেখানে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের ঘটনা ঘটে। যাহোক, যে কুর্দিস্তান নিয়ে এত আলোচনা তার অবস্থান কোথায়, কত তার জনসংখ্যা, কেমন তার আয়তন, কী সম্পদই বা আছে সেখানে এবং ভৌগোলিক অবস্থানের কৌশলগত গুরুত্বটা কী-এসব নিয়ে এখানে একটু কথা বলা দরকার।
আজকের কুর্দিস্তান বলতেতুরস্কেরপূর্বের কিছু অংশ, উত্তর ইরাক, দক্ষিণ-পশ্চিম ইরান এবং উত্তর সিরিয়ার কুর্দি-অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোকে বোঝায়। ভৌগোলিকভাবে কুর্দিস্তান অঞ্চলটিজগ্রোস পর্বতমালারউত্তর-পশ্চিম অংশ এবংতোরোস পর্বতমালারপূর্বাংশ নিয়ে গঠিত। এছাড়া, আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার সামান্য কিছু এলাকাকেও কুর্দিস্তানের অন্তর্গত বলে গণ্য করেন কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতারা। কুর্দি নেতারা যে আলাদা কুর্দিস্তান কল্পনা করেন তার আয়তন এক লাখ ৯০ হাজার বর্গকিলোমিটার থেকে তিন লাখ ৯০ হাজার বর্গকিলোমিটার। কল্পিত এ রাষ্ট্রের আয়তন প্রায় বর্তমান ইরাকের সমান এবং সিরিয়ার চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ। কুর্দি মোট জনসংখ্যা তিন কোটির কাছাকাছি। এর মধ্যে তুরস্কে সবচেয়ে বেশি কুর্দি জনগোষ্ঠীর বসবাস। মোট কুর্দি জনসংখ্যার মধ্যে তিন ভাগের দুই ভাগই বসবাস করে তুরস্কে। নানা তথ্য থেকে দেখা যায়, তুরস্কে প্রায় এক কোটি ৮০ লাখ কুর্দি জনগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে। এছাড়া, ইরানে রয়েছে ৮০ লাখ, ইরাকে ৫০ লাখ এবং সিরিয়ায় ২০ লাখ। কুর্দি জনগোষ্ঠীর সবার ভাষা কুর্দি এবং সাংস্কৃতিক বন্ধন খুবই দৃঢ়। পোষাক-আশাক, খাবার-দাবার এক কথায় তাদের কৃষ্টি-কালচার এক। কুর্দি জনগোষ্ঠীর একটি দুঃখ হলো-“তিন কোটি জনগণ কিন্তু তাদের আলাদা কোনো রাষ্ট্র নেই!”
ইরাকিকুর্দিস্তান ১৯৭০ সালে ইরাক সরকারের সঙ্গে এক চুক্তির মাধ্যমে স্বায়ত্ত্বশাসন লাভ করে। ২০০৫ সালে ইরাকের নতুন সংবিধানেও ইরাকি কুর্দিস্তানের এই স্বায়ত্ত্বশাসন স্বীকৃতি পায়। দিনে দিনে তারা এখন ইরাক থেকে আলাদা হতে চায়। এজন্যই সাম্প্রতিক গণভোটের আয়োজন করা হয়েছিল।
কুর্দি অধ্যুষিত এলাকায় রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের বিপুল পরিমাণ গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। সেখানে বিস্তীর্ণ পাহাড় থাকলেও বিরাট এলাকা জুড়ে রয়েছে উর্বর ভূমি এবং ঐতিহাসিকভাবে কুর্দি অঞ্চল থেকে নানা রকম শস্য ও গবাদি পশু উৎপাদন করা হয়। এ এলাকায় রয়েছে প্রচুর গাছপালা ও বনজঙ্গল। যে উইলো কাঠ দিয়ে ক্রিকেটের ব্যাট তৈরি হয় তাও প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায় এই কুর্দি অঞ্চলে। রয়েছে হরিণ, ভালুক, নেকড়েবাঘ, হায়েনা ও ঈগলসহ নানা ধরনের পাখ-পাখালি ও জীবজন্তুর বিচিত্র সমাহার। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যা, তা হচ্ছে- এখানকার নদী বা পানির উৎস এবং খনিজ সম্পদ।
কুর্দিস্তান অঞ্চলে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় এবং বরফ পড়ে। এই কুর্দিস্তানই হচ্ছে বিখ্যাত দজলা ও ফোরাতের পানির প্রধান উৎস। কুর্দিস্তান মধ্যপ্রাচ্যের পানির প্রধান জলাধার। এ অঞ্চল থেকে উৎপন্ন হয়েছে ছোট খাবুর, থরথর, কেইহান, আরাক্সে, কুরা, সেফিদ রুদ, কারখা এবং হেজিলের মতো ছোট-বড় অনেক নদী। তুরস্কের মুরাদ বা আরাসান এবং বুহতান নদী; ইরাকে পেশখাবুর, ছোট জাব, বড় জাব এবং দিয়ালিয়া আর ইরানের জারিনা রুদ, সিমিনা রুদ, জাহাব ও কামাসিয়াব নদী এই কুর্দি অঞ্চল থেকে উৎপত্তি হয়েছে।
এসব নদীর বেশিরভাগই সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে তিন হতে চার হাজার মিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। ফলে এসব নদী ইরাক, সিরিয়া ও তুরস্কের জন্য যেমন পানির গুরুত্বপূর্ণ উৎস তেমনি পানিবিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রেও রাখছে বিরাট বড় ভূমিকা। এর মধ্যে তুরস্কের দক্ষিণ আনাতোলিয়া প্রকল্প দেশটির বিদ্যুত চাহিদার বড় অংশের যোগান দিচ্ছে। এ প্রকল্প মূলত পানিবিদ্যুৎ উৎপন্নের প্রকল্প।
চার দেশ জুড়ে যে কুর্দি অঞ্চলের বিস্তার সেখানে অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক হ্রদও রয়েছে। এর মধ্যে খুবই নামকরা হ্রদ হচ্ছে ইরানের উরুমিয়া হ্রদ ও ভন হ্রদ। ইরাকের কুর্দিস্তানে রয়েছে লেক জারিভার ও দুকান হ্রদ। এ সব হ্রদই আন্তর্জাতিক পর্যটকদের কাছে বিশেষ আকর্ষণের বস্তু।
কুর্দিস্তানে রয়েছে প্রাকৃতিক খনিজ সম্পদের এক বিশাল ভাণ্ডার এবং এটাই হচ্ছে কুর্দিস্তানকে নিয়ে কূট-রাজনীতির অনেক বড় কারণ। শুধুমাত্র ইরাকের কুর্দিস্তান আঞ্চলিক সরকারের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে সাড়ে চার হাজার কোটি ব্যারেল তেল। জ্বালানি তেলের এই বিশাল মজুদ ইরাকের কুর্দিস্তানকে করেছে বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম তেলের অধিকারী অঞ্চল। খুব বেশি দিন নয়- ২০০৭ সাল থেকে এ অঞ্চলের তেল উত্তোলন শুরু হয়েছে।
আল-হাসাকা প্রদেশ যা জাজিরা অঞ্চল নামেও পরিচিত, তেলের জন্য তারও রয়েছে ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব এবং প্রদেশটি উর্বর কৃষিজমির জন্য সুবিখ্যাত।
২০১১ সালের নভেম্বর মাসে আমেরিকার টেক্সাসভিত্তিক মার্কিন তেল ও গ্যাস কোম্পানি Exxon কুর্দিস্তানের শতকরা ছয় ভাগ জায়গার তেল ও গ্যাসের জন্য চুক্তি করে ইরাকের কেন্দ্রীয় সরকারকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেয়। এর মধ্যে একটি চুক্তি ছিল গোলযোগপূর্ণ এলাকা নিয়ে। এটা ছিল কিরকুক মেগা-ফিল্ডের ঠিক পূর্বে। এ চুক্তির পর বাগদাদ সরকার দক্ষিণাঞ্চলীয় তেলক্ষেত্রগুলো নিয়ে যেসব চুক্তি ছিল তা বাতিল করার বিষয়ে Exxon-কে হুমকি দেয়।
২০০৭ সালে ইরাকের কুর্দি সরকার বিদেশি কোম্পানিগুলোর প্রতি ৪০টি নতুন তেলক্ষেত্রে অর্থ বিনিয়োগ করার জন্য সনির্বন্ধ অনুরোধ জানায়। তাদের মধ্যে এই আশা ছিল যে, বড় রকমের বিনিয়োগ এলে পাঁচ বছরের মধ্যে তেল উত্তোলনের পরিমাণ পাঁচগুণ বাড়িয়ে প্রতিদিন তেল উত্তোলন দশ লাখ ব্যারেলে নেবে।
কুর্দি অঞ্চলে গ্যাসেরও বিশাল মজুদ রয়েছে। এছাড়া, উল্লেখযোগ্য পরিমাণে রয়েছে কয়লা, তামা, সোনা, লোহা, চুনাপাথর, মার্বেল ও জিংক। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি রক সালফার বা গন্ধকের মজুদ রয়েছে কুর্দিস্তানের আরবিলের ঠিক দক্ষিণ-পশ্চিম এলাকায়। প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদের এই বিশাল ভাণ্ডারকে ঘিরে ওই অঞ্চলে তৎপর রয়েছে তেল ও গ্যাস কোম্পানি এক্সন, টোটাল, শেভরন, তালিসমান এনার্জি, জেনারেল এনার্জি, হান্ট অয়েল, গাল্ফ কীস্টোন পেট্রোলিয়াম এবং ম্যারাথন অয়েল।
মজার বিষয় হচ্ছে- ইরাক থেকে কুর্দিস্তান বিচ্ছিন্ন হওয়ার বিরুদ্ধে যেসব দেশ এখন খুবই সক্রিয় তার মধ্যে তুরস্ক হচ্ছে অন্যতম প্রধান। অথচ এই তুরস্ক ২০১২ সালে কুর্দিস্তানের আঞ্চলিক সরকারের সঙ্গে তেল চুক্তি করেছিল। ওই চুক্তির আওতায় তুর্কি সরকার কুর্দিস্তান সরকারকে পরিশোধিত তেলজাতীয় পণ্য দেয়ার এবং কুর্দিস্তান থেকে অপরিশোধিত তেল নেয়ার অঙ্গীকার করে। তুরস্কের এ চুক্তিতে ইরাকের কেন্দ্রীয় সরকার অসন্তুষ্ট হয়েছিল কিন্তু তুর্কি সরকার তা আমলে নেয় নি। সে চুক্তি ছিল ইরাকের কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য অবশ্যই একটা বিব্রত ও অস্বস্তিকর বিষয়। তবে, গত ২৫ সেপ্টেম্বর গণভোট অনুষ্ঠানের তিনদিন পর তুর্কি সরকারের প্রধানমন্ত্রী বিনালি ইলদিরিম ইরাকি প্রধানমন্ত্রী হায়দার আল-এবাদির সঙ্গে টেলিফোন আলাপে বলেন, অপরিশোধিত তেল কেনার বিষয়ে তুরস্ক সরকার এখন থেকে শুধুমাত্র ইরাকের কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে চুক্তি করবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটি আংকারার জন্য বড় ধরনের 'ইউ-টার্ন' ছিল। ওই আলাপে তুর্কি প্রধানমন্ত্রী কুর্দিস্তানের সঙ্গে তেল কেনার চুক্তি না করার কথাও জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, তেল কেনাসহ সব বিষয়ে ইরাক সরকারকেই সমথর্ন দেবে তুরস্ক। বলা দরকার-তেল বিক্রির অর্থ হচ্ছে কুর্দিস্তান সরকারের অর্থনীতির বড় শক্তি। কেইহান পাইপলাইন দিয়ে কুর্দিস্তান থেকে প্রতিদিন তুরস্কে সাড়ে ছয় লাখ বারেল তেল তুরস্কে রপ্তানি করা হয়।
কুর্দিস্তানে তেল-গ্যাস ও খনিজ সম্পদ এবং প্রাকৃতিক সম্পদের বিশাল ভাণ্ডার রয়েছে এবং এগুলো অবশ্যই ইসরাইল, আমেরিকা এবং তাদের পশ্চিমা ও আঞ্চলিক মিত্র দেশগুলোর কাছে বড় ফ্যাক্টর। এগুলোর প্রতি লোলুপ দৃষ্টি রয়েছে ইরাক, ইরান ও সিরিয়ার শত্রুদের।ইরাকের কুর্দিস্তানকে আলাদা করতে পারলে আস্তে আস্তে তুরস্ক, সিরিয়া ও ইরানের কুর্দি জনগোষ্ঠীকেও বিচ্ছিন্নতার দিকে টেনে নেবে। এ কাজে সফল হলে কুর্দিস্তান হবে ইহুদিবাদী ইসরাইলের তেল সরবরাহের বড় কেন্দ্র। শুধু তাই নয়, ইসরাইলের জন্য পানি সরবরাহেরও বড় উৎস হবে কুর্দিস্তান। এছাড়া, ইসরাইল ও আমেরিকার জন্য মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে কুর্দিস্তান হবে‘ছড়ি ঘোরানোর নতুন কেন্দ্র’। কল্পিত কুর্দিস্তানের অবস্থান যেহেতু ইরান, তুরস্ক, সিরিয়া ও ইরাক এই চার দেশের মাঝখানে ফলে সেখানে বসেই মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক শক্তিগুলোর ওপর পুরো নজরদারি করা যাবে।
ইরাক ও সিরিয়ার সঙ্গে ইরানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। তুরস্কের সঙ্গেও তাই। ফলে এসব দেশে আমেরিকার জন্য দিন দিন জায়গা সংকীর্ণ হয়ে আসছে। আর ইরাক ও সিরিয়ার সঙ্গে ইসরাইলের কোনো সম্পর্কই নেই। ফলে ইরানের ওপর নজরদারি করতে হলে, ইরানের অভ্যন্তরে ধ্বংসাত্মক তৎপরতা চালাতে হলে ইসরাইলকে ইরান সীমান্তের কাছাকাছি আসতে হবে বলেই তেল আবিবের কুশিলবরা মনে করে। ফলে কুর্দিস্তানকে বেছে নিয়েছে তারা। এ কারণেই সিরিয়া ও ইরাকে যখন উগ্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আইএসআইএল’র পতন হতে যাচ্ছে তখন নতুন করে ইসরাইল ও আমেরিকা কুর্দিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার এই প্রজেক্ট হাতে নিয়েছে। এতে সম্মতি রয়েছে সৌদি আরবসহ আমেরিকা এবং ইসরাইলের ঘোষিত ও অঘোষিত কিছু মিত্র দেশের। সিরিয়া ও ইরাককে সন্ত্রাসীদের নিয়ন্ত্রণে নেয়ার সবরকম প্রচেষ্টা যখন ব্যর্থ হতে চলেছে তখন কুর্দিস্তানকে নিয়ে নতুন ষড়যন্ত্র করছে এসব দেশ।
এখানে সৌদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি আরব দেশ কুর্দিস্তান বিচ্ছিন্ন হওয়ার বিষয়ে যে কারণে সমর্থন দিচ্ছে তা হলো, এর মাধ্যমে ইরান, ইরাক, সিরিয়া ও তুরস্ক- সবার ওপর প্রতিশোধ নেয়া যাবে। এসব দেশ যেমন আইএসআইএল -সহ উগ্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই করছে (যদিও তুরস্ক পরে এসেছে এ দলে) তেমনি ইয়েমেন ও কাতার ইস্যুতে সৌদি নেতৃত্বাধীন দেশগুলোর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। ফলে কুর্দিস্তান ইস্যুর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবগুলো দেশের বিরুদ্ধে একইসঙ্গে প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ নেয়ার সুযোগ এসেছে। সেই সুযোগ কাজে লাগাতে চাইছে সৌদি আরব ও তার আঞ্চলিক মিত্ররা। দুঃখজনক হচ্ছে- এ কাজে তারা মূলত জোট বেধেছে ইহুদিবাদী ইসরাইল ও আমেরিকার মতো মুসলিম স্বার্থের বিরোধী অপশক্তির সঙ্গে।
ইরাকের নিরাপত্তা বিশ্লেষক আহমাদ শারিফি স্পুৎনিকের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেছেন, ২০০৫ সাল থেকে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ইরাকের কিরকুক ও মসুল থেকে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত তেল পাইপলাইন নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা কথা বলে আসছেন। ইরাকের এই নিরাপত্তা বিশ্লেষকের মতে- আইএসআইএল হচ্ছে ইসরাইলের প্রজেক্ট। এই উগ্র গোষ্ঠীকে সৃষ্টি করা হয়েছে ইরাক ও সিরিয়ার সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে দেশ দুটিতে মার্কিন ও ইসরাইলের প্রতি অনুগত পুতুল সরকার বসাতে যাতে ইসরাইলের ওই তেল ও পানি প্রকল্প সহজে বাস্তবায়িত করা যায়। আইএসআইএল’র হাতে ইরাক ও সিরিয়ার সরকারের পতন হলে কথিত খেলাফতের মালিকরা ইসরাইলকে এ অঞ্চলের তেল ও পানি সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পথ করে দিত। পাশাপাশি পারস্য উপসাগর ও ভূমধ্যসাগর এলাকায় ইসরাইল পেত কয়েকটি অনুগত প্রতিবেশী। কিন্তু ইরাক ও সিরিয়ার কঠোর সিদ্ধান্তের কারণে ইসরাইলের সেই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ লাভ করে নি। ফলে নতুন করে কুর্দি প্রজেক্ট হাতে নিয়েছে। এর অংশ হিসেবে ইসরাইল প্রকাশ্যে ইরাকের কুর্দিস্তানে গণভোট আয়োজনের পক্ষে সমর্থন দিয়েছে আর সিরিয়ায় সন্ত্রাসবাদ-বিরোধী কথিত লড়াইয়ে কুর্দি স্বেচ্ছাসেবীদের প্রতি সমর্থন দিচ্ছে আমেরিকা। সিরিয়া যেহেতু সন্ত্রাসী মুক্ত হতে চলেছে সে কারণে আমেরিকা এসব কুর্দি যোদ্ধাদের নিয়ে কুর্দি অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে লড়াইয়ে রসদ যোগাচ্ছে। সেখানে মূল টার্গেট হলো- সিরিয়ার যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরপরই কুর্দি যোদ্ধাদের মাধ্যমে সিরিয়ার কুর্দি এলাকাগুলোর স্বাধনীতা ঘোষণা করানো। এরইমধ্যে সিরিয়ার সীমান্তবর্তী কুর্দি এলাকায় মার্কিন ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
ইসরাইল কুর্দি নেতাদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছে যে, কথিত গণভোট চক্রান্তের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করবেন কুর্দি নেতারা, আর আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর সমর্থন আদায় করে দেবে ইসরাইল। গণভোটের রায় বিচ্ছিন্নতার পক্ষে যাবে বলে নিশ্চিত হওয়ার পর ইসরাইল এই প্রকল্প হাতে নেয়। তাদের পরিকল্পনা ছিল- গণভোটের পর ইরাক সরকার সামরিক হস্তক্ষেপ করবে এবং রক্তক্ষয়ী সংঘাতের এক পর্যায়ে আমেরিকা ও পশ্চিমা মিত্রদের সহায়তায় কুর্দিস্তানে স্বাধীন সরকার ঘোষণার বিষয়টি বৈধ করে তুলবে। এতে দ্রুত সমর্থন দেবে সৌদি নেতৃত্বাধীন আরব দেশগুলো। তখন আর কুর্দিস্তানে স্বাধীনতা ঠেকানোর পথ থাকবে না। কিন্তু তুরস্ক, ইরান, ইরাক ও সিরিয়া একযোগে রুখে দাঁড়ানোর কারণে এবং ইরাক সরকার ধৈর্যশীল কৌশলী ভূমিকা নেয়ার ফলে ইসরাইলের সে পরিকল্পনাও অনেকটা মার খেয়ে গেছে। কুর্দিস্তানের গণভোটের বিপরীতে ইরাকের কেন্দ্রীয় সরকার সংলাপের উদ্যোগ নিয়েছে যাতে করে কুর্দিস্তান আন্তর্জাতিক মাথাব্যথার কারণ না হয়। পাশাপাশি ইরান, ইরাক ও তুরস্ক সামরিক মহড়ার মাধ্যমে খানিকটা শক্তিও দেখিয়ে দিয়েছে।
গত মধ্য আগস্টের দিকে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু কুর্দিস্তানের গণভোটের বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়ে বলেছিলেন,“কুর্দিরা হচ্ছে বিশ্বের অন্যতম সাহসী ও পশ্চিমাপন্থি জনগোষ্ঠী যাদের মুল্যবোধ আমাদের (ইসরাইলের) মতোই।”এর এক মাস পরে তিনি সরাসরি কুর্দি রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে মত দেন। কিন্তু ইরান ও তুরস্কের রুখে দাঁড়ানোর কারণে ইসরাইলের এসব মতামত ও স্বপ্ন আপাতত হওয়ায় উড়ে গেছে। এরইমধ্যে ইরান ও তুরস্ক যৌথ সামরিক মহড়া চালিয়েছে, সীমান্তে ইরান ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বসিয়েছে এবং ইরান ও তুরস্কের সেনাপ্রধানরা পারস্পরিক সফরের মাধ্যমে এ ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নিয়েছেন। পাশাপাশি তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোগান ইরান সফর করেছেন এবং দেশটির নেতাদের সঙ্গে সম্পূর্ণ একমতে এসেছেন যে, কুর্দিস্তানের বিচ্ছিন্নতা মেনে নেয়া হবে না। এই অবস্থায় ইরান ও তুরস্কের বর্তমান ঘনিষ্ঠ মিত্র রাশিয়াও ঘোষণা করেছে যে, মস্কো ইরাকসহ আঞ্চলিক দেশগুলো ভৌগোলিক অখন্ডতায় বিশ্বাস করে। ফলে ইসরাইল, আমেরিকা ও সৌদি নেতাদের পরিকল্পনা ভেস্তে যেতে বসেছে। মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে যে, মার্কিন ও ইসরাইলের পৃষ্ঠপোষকতায় যেমন সৌদি নেতৃত্বে ৫১ জাতির কথিত ইসলামিক সামরিক জোটের অকাল মৃত্যু হয়েছে, তেমনি মার্কিন ও ইসরাইল-বিরোধী আঞ্চলিক দেশগুলোর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এই কুর্দিস্তান প্রজেক্টেরও কবর রচনা হবে। ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের মতো মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা চায় -এমন দেশগুলো ঐক্যবদ্ধ থাকলে শুধু কুর্দিস্তান প্রজেক্ট ব্যর্থই হবে না বরং এই অঞ্চল থেকে শিগগিরি মার্কিনিদের ঘটি-বাটি নিয়ে চলে যেতে হবে। মধ্যপ্রাচ্যের সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিবেশ স্পষ্টত সেই ইঙ্গিতই দিচ্ছে।
লেখক: রেডিও তেহরানের সিনিয়র সাংবাদিক।