নিঃসঙ্গতা পাঠের অনুভূতি: মায়েস্ত্রো মার্কেজ
“একদিন সকালে অস্বস্তিকর স্বপ্ন দেখে জেগে উঠে গ্রেগর সামসা দেখতে পায় যে নিজের বিছানায় সে একটা আরশোলায় রূপান্তরিত হয়েছে।” [মেটামরফসিস/ ফ্রানস্ কাফকা]
“বহু বছর পর, ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড়িয়ে, কর্নেল অরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার মনে পড়ে যাবে সেই দূর বিকেলের কথা, যেদিন তাকে সঙ্গে নিয়ে বরফ আবিষ্কার করেছিল তার বাবা।” [নিঃসঙ্গতার একশ বছর/ গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ]
গ্রেগর সামসার জীবনী পাঠ শেষে আমাদের চেপে ধরে একটা বিষণ্ন ও নিঃসঙ্গ হাত। পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে কিনা তা বারবার পরীক্ষা করতে হয়। সুপার হিউম্যান যুগে গ্রেগর সামসার আরশোলায় পরিণত হওয়ার পরের একাকীত্ববোধ; কর্পোরেট জীবনকে দাঁড় করিয়ে দেয় অর্থহীন আয়নার সামনে। সেই আয়নার ভেতর থেকেই মার্কেজের র্নিজন হাত ওঠে আসে মানবসমাজের বিস্তার ও নিঃসঙ্গতার পরিণতির দলিল নিয়ে। আমরা দেখি, হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়াকে; ঘুমহীনতার হাত থেকে বাঁচতে কিভাবে পালিয়ে গেলো আর পত্তন করল নিঃসঙ্গতা ও মাকোন্দো গ্রাম। মার্কেজ জলাশয় ঘেরা মাকোন্দো গ্রাম পত্তনের ভেতর দিয়ে দেখাচ্ছেন লাতিন আমেরিকার ইতিহাস।
পুরো বুয়েন্দিয়া পরিবারের ভেতর দিয়ে বর্ণনা করেছেন লাতিন আমেরিকার জীবন ও সংস্কৃতি। কিন্তু এই বর্ণনার মধ্যে আপনি দেখবেন অতিলৌকিক জীবন। তবে অবিশ্বাস্য বলে উড়িয়ে দিতে পারবেন না কোনভাবে। এখানেই মার্কেজের লেখনির সার্থকতা। আপনি এই লেখনিতে যারপরনাই মুগ্ধ হয়ে এসব অতিলৌকিকতাকে নাম দিলেন ম্যাজিক রিয়ালিজম বা জাদু বাস্তবতা; কিন্তু মহান গাব্বু জানাচ্ছেন- ম্যাজিক রিয়ালিজম নয়, লাতিন আমেরিকার জীবনটাই এমন অলৌকিকতা ও রহস্যে ভরপুর। গাব্বুর জন্মস্থান; কলম্বিয়া দেশটিতে সংঘাত যেন স্বাভাবিক ব্যাপার। একনায়কতন্ত্র ও স্বৈরাচারবিরোধী রক্তক্ষয়ী আন্দোলন দেখেই গাব্বু বা গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের শৈশবে বেড়ে ওঠা। কলম্বিয়ায় মার্কিন সম্রাজ্য বিস্তারের প্রচেষ্টা, মাকোন্দোতে কলা কোম্পানির আগ্রাসন কিংবা ‘সরলা এরেন্দিরা ও তার ভয়ংকর দাদিমা’র’ চরিত্র যেন একই সুতোই গাঁথা।
মার্কেজের প্রধান চরিত্রগুলো আনপ্রেডিক্টেবল। একেকবেলায় তারা একেকরূপ নিয়ে হাজির হয়। মার্কেজের প্রবল সেন্স অব হিউমার প্রতিফলিত হয়েছে চরিত্রগুলোর মধ্যে। হোসে আর্কাদিওর ভবঘুরে জীবন থেকে মাটিখেকো রেবেকার সাথে জড়িয়ে সংসারী হয়ে ওঠা, কৈশরের ভাবুক অরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া থেকে পরে কর্ণেল অরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া হয়ে ওঠা, যিনি বত্রিশটা সশস্ত্র বিদ্রোহ সংগঠিত করে সককটাতেই হেরে গিয়েছিল, এড়িয়ে গিয়েছিল প্রাণের ওপর চালানো চৌদ্দটা হামলা, তিয়াত্তরটা ত্র্যামবুশ আর একটা ফায়ারিং স্কোয়াড। পরবর্তী জীবনে উদ্দেশ্যহীন যুদ্ধের হতাশা থেকে কর্ণেল কামারশালায় ছোট ছোট সোনার মাছ বানানোতেই মনোনিবেশ করেছিলেন। কুমারী আমারান্তা থেকে সুন্দরী রেমেদিওস, অরেলিয়ানো সেগান্দো, আমারান্তা উরসুলা সবাই যেন একেকটি আনপ্রেডিক্টেবল চরিত্র। মার্কেজের অন্যান্য উপন্যাস ও ছোটগল্পতেও আনপ্রেডিক্টেবল, বুদ্ধি ও কৌতুকদীপ্ত চরিত্রের সন্ধান পাওয়া যায়। মার্কেজ সরাসরি গল্প বলেন না। তাঁর বর্ণনাভঙ্গি সিম্বলিক। বাস্তবতাকে বিভিন্ন আঙ্গিক থেকে দেখার অন্তর্দৃষ্টি লক্ষ্য করা যায় তাঁর লেখায়। এবং এর উদাহরণ পাওয়া যাবে, চৌদ্দ বছরের এরিন্দিরার প্রেমে পড়ে যখন ইউলিসিস । ইউলিসিস যখন যা ধরতে যায় তা সোনা হয়ে যায়; তখন তার বাবা বুঝতে পারে সে প্রেমে পড়েছে। ইউলিসিস যে প্রেমে পড়েছে তা মার্কেজ সরাসরি বলে দিচ্ছে না। স্পর্শ ও স্বর্ণের ভেতর দিয়ে বুঝাচ্ছেন- প্রেম কতোটা আবেগের আর ভয়াবহ। এরিন্দিরা, দাদীমা ও ইউলিসিসের আবির্ভাবটা মার্কেজের ছোটগল্প ‘সরলা এরেন্দিরা ও তার ভয়ংকর দাদিমা’ ও ‘নিঃসঙ্গতার একশ বছর’ উপন্যাসের একটা গুরুত্বপূর্ণ সেগমেন্ট। তেমনি আমরা পাবো, ‘লাভ ইন দ্যা টাইম অব কলেরা’ উপন্যাসে ফারমিনা ডাজার ঘ্রাণশক্তির পরিচয়। কিভাবে সে লুকিয়ে থাকা সন্তানকে ঘ্রাণেন্দ্রিয় দ্বারা খুঁজে পাচ্ছে। মার্কেজ এভাবেই আগায়। এখানেই তাঁর প্রধানশক্তি।
‘নিঃসঙ্গতার একশ বছর ’ উপন্যাস জুড়ে যিনি পরিবারের সম্প্রিতি রক্ষার জন্য উদ্গ্রীব থাকতেন তিনি উরসুলা। বুয়েন্দিয়াদের ছয় প্রজন্ম ধরে তিনি পরিবার ও মাকোন্দোতে সম্প্রীতি বজায় রাখতে ও রুটিন মাফিক জীবন পালনের জন্য সংগ্রাম করে গেছেন। মাকোন্দো পত্তন থেকে শুরু করে বুয়েন্দিয়াদের ছয় প্রজন্মের অনিদ্রারোগ, নিঃসঙ্গতা ও প্রেমহীনতার একমাত্র স্বাক্ষী- উরসুলা। হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া হলো নিঃসঙ্গতার সমার্থক, মাকোন্দো গ্রাম পত্তনকারী, প্রথম যিনি অনিদ্রারোগাক্রান্ত. স্মৃতিলোপ ও নিঃসঙ্গতায় মৃত্যুবরণ করেন। এবং ভবঘুরে দার্শনিক বৈজ্ঞানিক মেলিকিয়াদেস’র প্রভাবে বিমোহিত হয়ে পরবর্তী জীবন কাটিয়ে দেন কেবল যৌবনের বন্ধু প্রুদেনসিও আগিলারের কাটামুন্ডুর সাথে কথা বলে। মেলিকিয়াদেসই প্রথম ব্যক্তি যিনি মাকোন্দো গ্রামে নিয়ে আসে আধুনিক সভ্য জগতের পরশ। পরবর্তীতে আমরা দেখব- বুয়েন্দিয়া পরিবারের প্রতিটি প্রজন্মের কেউ না কেউ মেলিকিয়াদেস’র দুর্বোধ্য পার্চমেন্টের অর্থ উদ্ঘাটনের নেশায় কাটিয়ে দিচ্ছে। এবং আমাদের অপেক্ষা করতে হবে ততক্ষণ পযন্ত যতক্ষণ না অরেলিয়ানো ব্যাবিলনিয়া ও আমারান্তা উরসুলার সামাজিকভাবে অস্বীকৃত যৌনতার ফলে শুয়োরের লেজ নিয়ে জন্ম হয় শেষ অরেলিয়ানোর। আর পার্চমেন্টের অর্থ উদ্ধার পর্যন্ত। তারপর মাকোন্দোর নিশ্চিহ্ন হওয়ার মুহুর্ত। এরপর আপনাকে ঘিরে ধরবে তিনদিনের সাময়িক ঘোর ও আজীবনের জন্য একটা নিঃসঙ্গতা। অবশেষে সত্যি হয় বর্ষীয়ান উরসুলার ধারণা। যে ধারণা থেকে খুন হতে হয় প্রুদেনসিও আগিলারকে আর পত্তন হয় মাকোন্দো গ্রামের। বুয়েন্দিয়া পরিবার ও মাকোন্দো গ্রাম ধ্বংস হয়েছে কেবল প্রেমহীনতা, স্মৃতিলোপ, নিঃসঙ্গতা ও অনিদ্রা রোগের ফলে। উরসুলার তৈরী ‘কুঁচিলা জাতীয় গুল্মের চোলাই’ খাওয়ার পরও যারা অনিদ্রা রোগ থেকে মুক্তি পায় না। অনিদ্রা থেকে সাময়িক মুক্তি পেলেও তারা নিঃসঙ্গতা থেকে মুক্তি পায় না। যারা একই পরিবারের সদস্য হয়েও প্রকৃতিগত ভাবে আলাদা, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ও চরম নিঃসঙ্গ একেকজন। কেবল উরসুলাকে দেখা যায়, যার সাংসারিক ও সামাজিক জ্ঞান টনটনে। প্রেমহীনতা, বিচ্ছিন্নতাবোধ, নিঃসঙ্গতা ও পৌরুষত্ববোধের কারণেই কর্ণেল অরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া জড়িয়ে পড়ে সশস্ত্র বিদ্রোহে।
মার্কেজের গল্প-উপন্যাস মানেই প্রচুর যৌনতার উপস্থিতি। এবং তা তাঁর লেখনির খাতিরে যথেষ্ট উপভোগ্য। মার্কেজের চেতনা আবর্তিত হয়েছে কার্ল মার্কস ও সিগমুন্ড ফ্রয়েডকে কেন্দ্র করে। যদিও সমালোচকরা দাবি করেন, মার্কেজের লেখনির মধ্যে আছে উইলিয়াম ফকনার’র প্রভাব। তিনি নিজেও একসময় তা স্বীকার করেছেন। তবে আদিম মাতৃতান্ত্রিক সমাজের একটা ছায়া রয়েছে তাঁর গল্প উপন্যাসগুলোতে। মার্কেজের সৃজিত চরিত্রগুলো নিঃসঙ্গতা থেকে বাঁচতে দ্বারস্থ হয় যৌনতার। কিন্তু এই সাময়িক আনন্দ তাদের সুখ দিতে পারে না, মুক্তি দিতে পারে না বিচ্ছিন্নতাবোধ ও নিঃসঙ্গতা থেকে। ফলে পতন ঘটে মাকোন্দো গ্রামের।
গ্যাব্রিয়েল মার্কেজের উপন্যাসের চরিত্রগুলো হলো লাতিন আমেরিকার। জীবনাচারও। কিন্তু মার্কেজের উপন্যাসের দর্শন ভারতীয় উপমহাদেশের। নিবৃত্তিমার্গের। শেষ অরেলিয়ানো যখন পার্চেমেন্ট উদ্ধার করতে পারে এবং তার সামনে যখন খুলে যাচ্ছিল জ্ঞানের দরজা তখন একটা ধ্বংস এসে তাদেরকে ঝাপটে ধরে। আর এভাবেই সমাপ্তি ঘটে মাকোন্দো জগতের । কোন নতুন প্রফেটের তখন আবির্ভাব ঘটে না। সৃষ্টি আর বিনাশের ভেতর দিয়ে সকলকিছুর নিবৃত্তি ঘটে।
মার্কেজ গল্প বলার ভঙ্গিটি রপ্ত করেছেন ছোটবেলায় তাঁর দাদিমার মুখে গল্প শুনে শুনে। এবং একজন লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য খেটেছেন প্রচুর। নিঃসঙ্গতার একশ বছর কেবল মাকোন্দো ও বুয়েন্দিয়া পরিবারের ইতিহাস নয়, এটা লাতিন আমেরিকার ইতিহাস। এই ইতিহাস মার্কিন সাম্রাজ্যবাদে খুন হওয়া মানুষ ও নিস্পেষিত হওয়ার ইতিহাস, প্রযুক্তি ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের ইতিহাস। মার্কেজ হয়তো দাবি করতে পারেন, তিনি শুধু তার পরিচিত মানুষের চরিত্রগুলো অংকন করতে চেয়েছেন, কিন্তু এইসব চরিত্রই হয়ে উঠেছে বিশ্বজনীন। মায়েস্ত্রো মার্কেজ।