দুদক চলছে শম্বুক গতিতে : হাইকোর্ট
দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক : দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ‘এক্সপ্রেস’ গতিতে না চলে ‘শম্বুক’ গতিতে চলছে মন্তব্য করেছে হাইকোর্ট।
সাবেক বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়ে দুদককে দেয়া সুপ্রিম কোর্টের চিঠির বৈধতার প্রশ্নে জারিকৃত রুলের শুনানিকালে মঙ্গলবার (২৪ অক্টোবর) এমন মন্তব্য এসেছে হাইকোর্টের পক্ষ থেকে। বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি সহিদুল করিমের ডিভিশন বেঞ্চ এই মন্তব্য করেন।
শুনানির এক পর্যায়ে দুদক কৌঁসুলির উদ্দেশ্যে হাইকোর্ট বলেন, নথিপত্রে দেখা যাচ্ছে আপনারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সন্তানের লেখা-পড়ার ব্যয়ভারের রেকর্ড চেয়েছেন। মসজিদ বা মাদ্রাসাসহ সামাজিক খাতে কত টাকা ব্যয় করা হয়েছে তার রেকর্ডও দাখিল করতে বলেছেন। এসব বিষয়ে খরচের রেকর্ড কেউ কি কখনো সংরক্ষন করেন? দুদক এসব বিষয়ে যেভাবে রেকর্ডপত্র চাচ্ছে তা বাস্তবতার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। এভাবে যদি তথ্য চান তাহলে তো পূর্ব থেকেই জনগণকে সতর্ক করতে হবে। নইলে ভবিষ্যতে তো হয়রানির সম্ভবনা রয়েছে। আদালত বলেন, আপনারা (দুদক) বেশি স্বচ্ছতা আনতে গিয়ে সবকিছু গুলিয়ে ফেলছেন।
শুনানিতে বিচারপতি জয়নুলের বিরুদ্ধে সাত বছর ধরে চলা দুদকের অনুসন্ধানের কঠোর সমালোচনা করে আদালত। হাইকোর্ট বলেন, দুদকের নোটিশের প্রেক্ষিতে সম্পদের হিসাব দাখিল করা হয়েছে ২০১০ সালে। সাত বছর পেরিয়ে গেলেও কেন অনুসন্ধান শেষ হচ্ছে না? সুপ্রিম কোর্টের কাছে ২০১৭ সালে চিঠি দিয়ে যে তথ্য দুদক চেয়েছিলো সেটা কেন ২০১০ সালেই করা হলো না? আপনাদের অনুসন্ধান কার্যক্রম দেখে মনে হচ্ছে দুদক ‘ এক্সপ্রেসওয়ে’তে না চলে ‘শম্বুক’ গতিতে চলছে। এভাবে চললে যার বিরুদ্ধে নোটিশ দেয়া হচ্ছে সেই ব্যক্তি তো মানসিকভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এ পর্যায়ে দুদক কৌসুলি খুরশীদ আলম খান বলেন, ন্যায় বিচার পেতে সময় লাগবে। কারণ দুদক আইনের বিভিন্ন ধারার দাড়ি, সেমিকোলন এমনকি কমার বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট করা হচ্ছে। যেহেতু অনুসন্ধান পর্যায়ে রয়েছে সেহেতু তথ্যগুলো পর্যালোচনার জন্য সময় লাগছে।
সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি জয়নুল আবেদিনের বিরুদ্ধে কোন রকম ব্যবস্থা গ্রহণ করা সমীচিন হবে না মর্মে-দুদককে দেওয়া সুপ্রিম কোর্টের চিঠি কেন বে-আইনি ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চেয়ে গত ১০ অক্টোবর রুল জারি করে হাইকোর্ট। এই রুলের শুনানিতে অংশ নিয়ে অ্যামিকাসকিউরি অ্যাডভোকেট প্রবীর নিয়োগী বলেন, আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান। সে দৃষ্টিতে কোনো ব্যক্তি দায়মুক্তি পেতে পারে না। সাবেক বিচারপতির ক্ষেত্রে আলাদা বলে কোনো আইন নেই। তাই সুপ্রিম কোর্টের এই চিঠি সংবিধান এবং আইন বহির্ভূত। সুপ্রিম কোর্ট চিঠিতে যে ভাষা ব্যবহার করেছে তা আইন বহির্ভূতভাবে করা হয়েছে। কোনো প্রতিষ্ঠান এভাবে বলতে পারে না। এ পর্যায়ে আদালত জানতে চান, সুপ্রিম কোর্টের এই চিঠির বিচার করার এখতিয়ার হাইকোর্টের আছে কি? প্রবীর নিয়োগী বলেন, এটা সুপ্রিম কোর্টের প্রশাসনিক আদেশ। সুতরাং কোনো প্রশাসনিক আদেশের বিচার করার এখতিয়ার আপনাদের রয়েছে। অপর অ্যামিকাসকিউরি এএম আমিনউদ্দিন বলেন, সুপ্রিম কোর্ট আইনগতভাবে এ ধরণের চিঠি দিতে পারে না। একজন বিচারপতি দায়মুক্তি পেতে পারেন না। তিনি বলেন, জনতা টাওয়ার মামলায় একজন রাষ্ট্রপতিকে দায়মুক্তি দেওয়া হয়নি। তাই একজন বিচারপতি যদি অপরাধ করে থাকেন তবে তিনি দায়মুক্তি পেতে পারেন না।
শুনানিতে বিচারপতি জয়নুলের আইনজীবী ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন বলেন, বিচারপতি জয়নুল আবেদীন প্রধান বিচারপতির আত্মীয় নন। এখানে প্রধান বিচারপতির ব্যক্তিগত কোনো স্বার্থ নেই। বিচার বিভাগের অভিভাবকের মত কাজ করেছেন তিনি। এখানে অসৎ উদ্দেশ্যের প্রশ্নই আসে না। তিনি বলেন, অনুসন্ধান কার্যক্রম চলাকালে বিভিন্ন সময় সাংবাদিকদের তথ্য দেয় দুদক। এটা মূলত মিডিয়া ট্রায়ালের জন্য করা হয়।
দুদক কৌঁসুলির উদ্দেশ্যে আদালত বলেন, আপনারা কোনো ব্যক্তির সম্পদ বিবরণী যে ফরমের মাধ্যমে চেয়ে থাকেন, সেই ফরমে দেখো যাচ্ছে সন্তানরা যে বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছে তার তথ্য চেয়েছেন, এটা কেন? দুদক আইনজীবী বলেন, এটার প্রয়োজন পড়ে। আদালত বলেন, এটা কি কেউ অনুসরণ করেন? দুদক আইনজীবী বলেন, আমার ছেলে স্কলাস্টিকায় পড়ে। আমি তো সব তথ্যই সংগ্রহে রাখি। আদালত বলেন, আপনি দুদকের আইনজীবী তাই হয়তো রাখেন। ৩৫ বছর আগে কেউ একজনের ছেলে প্রাইমারি স্কুলে পড়েছে, সেই লেখা-পড়ার যে ব্যয় তার হিসাব কি কেউ রাখেন? আপনি এমন একটা তথ্য চাচ্ছেন যা অবাস্তব। বিভিন্ন ব্যক্তি একজন মসজিদ, মাদ্রাসা, ক্লাবে চাঁদা দেয় সেটার রশিদ কি কেউ রাখে? মোটা অঙ্কের টাকা দিলে কেউ হয়তো হিসাব রাখতে পারে। সামান্য অঙ্কের টাকা দিলে কি কেউ রাখে? দুদক আইনজীবী বলেন, স্বচ্ছতার সার্থেই রাখা প্রয়োজন এবং দুদক সেটা চেয়ে থাকে। এ পর্যায়ে আদালত দুদক কৌসুলিকে বলেন, কবে কত টাকার বাজার করলাম, মুরগি কিনলাম তিনশ টাকায়, মাছ কিনলাম চারশ’ টাকায় এরকম দৈনন্দিন বাজারে হিসাবও রাখতে হবে? তদন্ত করার অনেক পদ্ধতি আছে তাই বলে কি এভাবে! বাস্তবতার নিরিখে বিষয়গুলো যাচাই করে দেখুন। আপনারা ব্যাংকের হিসাব বিবরনী বা কয়টি এফডিআর আছে সেটা চাইতে পারেন। তবে ফরমের ৬, ৭, ১১ ও ১২ ক্রমিকে যেসব বিষয়ে তথ্য চাচ্ছেন তা বাস্তব সম্মত নয়। তথ্য জানার নানা পদ্ধতি আছে। সেদিকে দৃষ্টি দিন। দুদক আইনজীবী বলেন, এই ফরম নিয়ে আদালতের মনোভাব কমিশনকে জানানো হবে।
দুদক কৌঁসুলি বলেন, ২০১০ সালের ৮ আগস্ট বিচারপতি জয়নুল দুদকে সম্পদ বিবরণী দাখিল করেন। এই বিবরণী পাওয়ার পর দুদকের অনুসন্ধানে দেখা যায়, ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে বেশ কিছু টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে। এগুলো আমেরিকা মালয়েশিয়া সুইজারল্যান্ডসহ কয়েকটি দেশে কিছু টাকা পাঁচার করা হয়েছে। আদালত বলেন, সম্পদ বিবরণী দাখিলের পর তা যাচাইয়ের জন্য তার চাকরির নথিপত্র চেয়ে ৭ বছর পর সুপ্রিম কোর্টকে চিঠি দেওয়া হল। এইটুকু তথ্য জানতে আপনাদের এত সময় লাগলো। আপনারা তো ওই সময়ই সুপ্রিম কোর্টকে চিঠি দিতে পারতেন। আদালত বলেন, অনুসন্ধানের নামে বছরের পর বছর এগুলো ঝুলিয়ে রাখা হচ্ছে। আবার আপনারা মিডিয়াকে তথ্য দেন ওই ব্যক্তি সম্পর্কে। এভাবে চললে তো মিডিয়া ওই ব্যক্তিকে শেষ করে ফেলবে। আপনারা যদি এই গতিতে চলেন তাহলে দেখা যাবে আরেকটা তথ্যের জন্য ২০২৪ সালে গিয়ে আরেকটা নোটিস দিচ্ছেন। আসলে দুদক এক্সপ্রেসের মত না চলে চলছে শম্বুক গতিতে। আদালত বলেন, যে ব্যক্তির বিষয়ে অনুসন্ধান করতে থাকলেন সে ব্যক্তির অবস্থাটা কি দাঁড়ালো? তার যদি ডায়াবেটিক নাও থেকে থাকে তাহলে আপনাদের অনুসন্ধানের কারণে ডায়াবেটিস, প্রেশার হবে। একটা সময় হয়তো এই লোক হার্ট অ্যাটাক করবে। এর চেয়ে মানসিক হয়রানির আর কি আছে?
(দ্য রিপোর্ট/জেডটি/অক্টোবর ২৪, ২০১৭)