জীবনানন্দ চিত্রকল্পেরই কবি । তাঁর বড় কৃতিত্ব  কাব্যপ্রচলনকে বর্জন এবং নতুন কাব্যভাষা সৃষ্টি । তাঁর কবিতায় প্রেম ও প্রকৃতি, তাঁর কবিতায় ইতিহাসচেতনা, ও সমাজ রাজনীতি চেতনা, তাঁর কবিতায় ব্যক্তি ও স্বদেশ, তাঁর জীবন ও মৃত্যুচিন্তা – সব মিলিয়ে এমন একটি একক পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছে–যেটি রবীন্দ্রনাথের মতো রহস্যীকরণের জালে মোড়া কল্যাণময়ী নয়–সে পৃথিবী একান্ত আমাদেরই,স্বতঃ, রজঃ, তমঃ – সাংখ্যের এই তিনের মতোই সেই পৃথিবীর জল, আলো, আকাশ, মাটি সবকিছু সময়, সংবেদ ও নিসর্গ দিয়ে তৈরি, যেখানে আশা ও নিরাশা হাত ধরাধরি করে চলে – সে পৃথিবীর আবহমান বাণী সমাহৃত হয় এরকম একটি বাক্যে –অসম্ভব বেদনার সাথে মিশে রয়ে গেছে অমোঘ আমোদ”-তাঁকে আবাগের দরিয়ায় বাঁধদিয়ে কতটুকু পড়তে পেরেছি আমরা।  
আমার মতে জীবনানন্দের কবিতার সবচেয়ে সঠিক আর অন্তমূল্যায়ন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।

এখনকার নব্য জীবনানন্দ প্রেমিকরা নাও মানতে পারেন অবশ্য! কারণ সবাই ঘোরে আছে এখনো! মদ খেয়ে ঘুমালে পরদিন যেমন শূন্য এক স্মৃতির মতো আগের রাত মনে আসে, জীবনানন্দ বাংলা সাহিত্যে এখন সেই অবস্থায় আছেন। আশা করি বেলা বাড়লে হাং ওভার কাটবে!

যত ভালোই হোক, লাগাতারপ্রতিদিন রসগোল্লা খেলে কদিন পরেই বিষাদ লাগে। তিন বেলা বিরিয়ানি খেলেও ! মাতাল যেমন নেশার ঘোরে একই কথা বার বার বলে, জীবনানন্দ এই প্রথম থেকে একই লয়ে একই তালে একই বিষাদে একই আবেগে একই তৃপ্তিতে একই সীমানায় একই বাস্তবে একই পরিপার্শ্বে একই মেদুরতায় অনর্গল বলে গেলেন অনন্ত অতৃপ্তির কথা; যতক্ষণ না কেও কেও, যেমন বুদ্ধদেব সেই প্রতিদিনের রসগল্লার বিষাদের কথা তাকে না জানান।আর কি বা আছে তাঁর কবিতায় অতৃপ্তির মেদুরতা ছাড়া? বিষাদের নিমগ্ন পুকুরে সাঁতার ছাড়া? নমনীয় উপমার মাত্রাহীন ব্যবহার ছাড়া?

'জীবনানন্দ দাশ আমাদের নির্জনতম স্বভাবের কবি। এই নির্জনতার বিশিষ্টতাই তাঁর প্রাক্তন রচনাকে দীপ্যমান করেছিল। মনে মনে এখনো তিনি নির্জনের নির্ঝর, তাঁর চিরতন্ত্রী এখনো স্বপ্নের অনুকম্পায়ী। কিন্তু পাছে কেউ বলে তিনি এস্কেপিস্ট, কুখ্যাত আইভরি টাওআরের নির্লজ্জ অধিবাসী, সেই জন্য ইতিহাসের চেতনাকে তাঁর সাম্প্রতিক রচনার বিষয়ীভূত ক'রে তিনি এইটেই প্রমাণ করবার প্রাণান্ত চেষ্টা করছেন যে তিনি 'পেছিয়ে' পড়েন নি। করুণ দৃশ্য, এবং শোচনীয়। এর ফলে তাঁর প্রতিশ্রুত ভক্তের চক্ষেও তাঁর কবিতার সম্মুখীন হওয়া সহজ আর নেই। দুর্বোধ্য বলে আপত্তি নয়; নিঃসুর বলে আপত্তি, নিঃস্বাদ বলে।'- বুদ্ধদেব বসু

সুরের উপযোগিতা তার অনিঃশেষ আকুতি যা শেষ হবার পরেও কানে লেগে থাকে। যে মুহূর্তে মনে হয় সুর থেমে গেলে ভালো হতো সে মুহূর্তে মরণ হয় সুরের, তা যত মধুর সুর হোক না কেন।

জীবনানন্দ জানতেন তাঁর শক্তি তাঁর মেদুরতা, উপমার চূড়ান্ত চমকিত ব্যবহার। কিন্তু সেই শক্তিকে তিনি রয়ে সয়ে কবিতায় না দিয়ে, এক জোর, ইচ্ছুক গোয়ারের মতো ব্যবহার করলেন।

ঝরা পালকের পাঠপ্রতিক্রিয়ায় রবীন্দ্রনাথ জীবনানন্দকে একটি চিঠি লিখেছিলেন, জীবনানন্দ তখন বরিশালে, চিঠির বক্তব্য –

‘তোমার কবিত্বশক্তি আছে তাতে সন্দেহমাত্র নেই। কিন্তু ভাষা প্রভৃতি নিয়ে এত জবরদস্তি কর কেন বুঝিতে পারিনে। কাব্যের মুদ্রাদোষটা ওস্তাদিকে পরিহাসিত করে ।বড় জাতের রচনার মধ্যে একটা শান্তি আছে, যেখানে তার ব্যাঘাত দেখি সেখানে তার স্থায়িত্ব সম্বন্ধে সন্দেহ জন্মে । জোর দেখানো যে জোরের প্রমাণ তা নয় বরঞ্চ উল্টো।’

এটি যে রবীন্দ্রনাথের কোন বিদ্বেষ প্রসূত মত নয় উপলব্ধির পরিবর্তনে রবীন্দ্রনাথ তা প্রমাণ করেছেন। জীবনানন্দের “মৃত্যুর আগে ” কবিতা পাঠ করে রবীন্দ্রনাথ বুদ্ধদেব বসুর কাছে স্বীকার করতে বাধ্য হলেন – ” জীবনানন্দ দাশের চিত্ররূপময় কবিতাটি আমাকে আনন্দ দিয়েছে।” এরপর ধূসর পাণ্ডুলিপির পাঠ প্রতিক্রিয়ায় জীবনানন্দকেই লিখে ফেললেন – ” তোমার লেখায় রস আছে , স্বকীয়তা আছে এবং তাকিয়ে দেখার আনন্দ আছে। ”

২.

জীবনানন্দের কবিতার ‘সীমাবদ্ধতা’ হলো স্মৃতিচারনার স্বর! এমন না যে এই স্মৃতিকাতরতা সর্বদা অতীতকাল কেন্দ্রিক বা ভাষায় ‘কাল’ ব্যবহারে আছে এর বেশী জীবনানন্দের ‘ এমন যদি হত’ ধর্মী লেখায়। কবিতায় কবি যতই অতীত বা চিরন্তনতার আঙ্গিক আনুন , তাঁর স্বর হতে হয় জাগ্রত, হতে হয় সমকালীন! জীবনানন্দের কবিতায় মহাজাগতিক, মহাসময় বা অপর-সব জীবনানন্দীয় ভ্রমণ একটি শুদ্ধতার কেন্দ্র থেকে রওনা দেয়; রবীন্দ্রনাথের মতো কল্যাণশীল নয়, আত্মস্খালনকামী—এবং সেই আত্মস্খলনের মধ্য দিয়েই নিখিল-মুক্তি নিঃশব্দে তার দাবি পেশ করে। কিন্তু তা কি জয়ী হয়?

‘শুদ্ধতম কবি’তে আবদুল মান্নান সৈয়দ লিখছেন, “প্রত্যেক কবি নিজের ভিতর দিয়ে একবার মানববাহিত আদ্যন্ত কাল পরিভ্রমণ ক’রেআসেন; অতিজাগতিক ও মহাসময়বাহী একটি পৃথিবী কবির ভিতর দিয়ে অতিবাহিত হ’য়ে যায় যেন। জীবনানন্দেও মহাসময়-পরিভ্রমণের সেই পরিচিহ্ন পড়েছে: তার প্রান্তিক যুগ্ম উদাহরণ ‘মাঠেরনিস্তেজ রোদে নাচ হবে/ শুরু হবে হেমন্তের নরম উত্সব। /হাতে হাত ধ’রে-ধ’রে গোল হ’য়ে ঘুরে-ঘুরে’ (অবসরের গান, ধূসর পাণ্ডুলিপি) যেন পৃথিবীর আদিমকালের ফসলোত্সব; ‘ওখানে চাঁদের রাতে প্রান্তরে চাষার নাচ হতো’ (১৯৪৬-৪৭, শ্রেষ্ঠ কবিতা) সেই সুদূরাতীতের ফসলোত্সবের—তাঁর আপন কাব্যে উদ্যাপিতও বটে—স্মৃতিচারণারমতো মনে হয়”।

একটা উদাহরণ দিলে আরও পরিস্কার বুঝা সম্ভব।জীবনানন্দের বহুল আলোচিত ‘মৃত্যুর আগে’ কবিতায় তিনি লিখছেন-

‘সব রাঙা কামনার শিয়রে যে দেয়ালের মতো এসে জাগে
ধূসর মৃত্যুর মুখ—একদিন পৃথিবীতে স্বপ্ন ছিল—সোনা ছিল যাহা
নিরুত্তর শান্তি পায়—যেন কোন্‌ মায়াবীর প্রয়োজনে লাগে।
কী বুঝিতে চাই আর? রৌদ্র নিভে গেলে পাখি-পাখালির ডাক
শুনি নি কি? প্রান্তরের কুয়াশায় দেখি নি কি উড়ে গেছে কাক!’

জীবনানন্দের স্মৃতিপ্রিয়তার যেন প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। যে ছিল না বা যা হবেও না তার জন্য জীবনানন্দের যত আর্তি। আবার তা পেয়েও তার ভালো লাগবে কিনা সেই সিদ্ধান্তহীনতায় তিনি যেন দিশেহারা। ‘সব রাঙা কামনার শিয়রে যে দেয়ালের মতো এসে জাগেধূসর মৃত্যুর মুখ’- প্রতিটি শব্দের শরীর থেকে নামছে হতাশা আর নৈরাশ্যের কুয়াশা। ‘যেন কোন্‌ মায়াবীর প্রয়োজনে লাগে’- বলেও নিজেকে লুকাতে পারছেন না ; কী বুঝিতে চাই আর?- বলে কি বুঝতে চান তাই বলেছেন যখন জীবনের সব রঙ আলো আর রূপ ও তাকে সান্তনা করতে পারেনি। ‘আমরা হেঁটেছি যারা নির্জন খড়ের মাঠে পউষ সন্ধ্যায়’- তাঁরা বুঝতে পেরেছি শেষে কেন হেঁটেছি এই উত্তর পাইনা জীবনানন্দে। রবীন্দ্রনাথের একটা ভীষণ প্রিয় শব্দ – সত্য । যখনই তিনি তাঁর বুঝতে না পারা কোন পরম উপলব্ধি বা বিশ্বাসের কথা বলতে চেয়েছেন , তখনই তিনি এই শব্দ ব্যবহার করেছেন। জীবনানন্দ ব্যবহার করেছেন প্রতারণা মুলক সত্য। তিনি বলেননা দেখেছি, বলেন না শুনেছি, বলেন, ‘দেখিনি কি?’ ‘শুনিনি কি’। যেন তার এই দেখা আর শোনা দিয়ে তার জীবনের কোন উপলব্ধিই নতুন করে রাঙ্গিয়ে যায় না। এটা এক অপরিণত স্বর যেখানে কবির যেমন তার পূর্বের বোধ হতে উত্তরণ ঘটছে না , পাঠকের ও তেমন। একই ঘূর্ণাবর্তে ঘূর্ণায়মান।

৩.

“পথের শেষ কোথায় , শেষ কোথায় , কী আছে শেষে !এত কামনা , এত সাধনা কোথায় মেশে ? ”- রবীন্দ্রনাথের অনেক গানের মতোই এই গানটিতেও অব্যক্ত কাতরতা আমাদের মুগ্ধ কর,সুরের আলোড়নে আমরা ভাসি ডুবি । যতদূর জানা যায় জীবন সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের মোহ সম্পূর্ণ চলে গিয়েছিল যখন তিনি মাঝ বয়সি রবীন্দ্রনাথের পাশে যতই ঠাকুর বাড়ি আর শান্তিনিকেতন দেখি না কেন , রবীন্দ্রনাথ সম্পূর্ণ ব্রাত্য ভাবে জীবনের এক বৃহত্তর সময় যাপন করেছিলেন, সে যাপন হৃদয় লোকে। তবুও তিনি জীবনের নিরর্থকতাকে স্বীকার করে নেন নি ! রবীন্দ্রনাথ জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত খালি দুঃখই পেয়ে গেছেন–কারণ এই নয় যে তিনি জীবনের নিরর্থকতার মতো চিরন্তন জিনিসকে মেনে নিতে পারেনি । বরং নিরর্থকতার এই ক্ষতকে তিনি ঢেকেছেন বিশ্বজগতের রহস্যীকরণের কাজ করে আর দুঃখ পেয়েছেন মানুষের জন্য যারা ‘সত্য’ মৃত্যুর এই বিভ্রম মায়ার এই জীবনে নিরর্থকতার সেই আধার ক্ষতে তলিয়ে যাবে।

জীবন নিরর্থক, এটা এই অর্থে যে জীবনের শেষে দাঁড়িয়ে আছে মৃত্যু। কিন্তু এজন্যই জীবন মূল্যহীন হয়ে যায় না, হয়ে পড়ে অমূল্য। এই জিবনকে আমরা বুঝে নিতে চাই। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত আমরা বহু রূপ রসের ভীতর দিয়ে চলবো – কখনও পৌষের সন্ধ্যা আমাদের স্পর্শ করবে,কখনও বৈশাখী রৌদ্র আমাদের রক্তে ঢুকবে , কখনও বা ভরা শ্রাবণ আমাদের বিগলিত করবে–জীবনে এত কিছু প্রাপ্তির পরেও জীবনানন্দের কাছে জীবনে বোঝার কিছু নেই বলে বলবো না –

“যে দুটি শুধু ঢেউ তুলে চলে স্থির জলে–
রৌদ্র নিভে গেলে পাখ-পাখালীর ডাক
শুনি নি কি?
প্রান্তের কুয়াশায় দেখি নি কি উড়ে গেছে কাক?”

যেন তাৎপর্যহীন চির ভোগান্তির সর্বব্যাপ্ত এক বিষাদ। এই নিকষ ধোঁয়াশা জীবনানন্দের কাব্যপথের মূল সুর। যেই ইন্দ্রিয়গুলোর ব্যবহারে পৃথিবীর সাথে তার যোগ, সেই সুত্রগুলোও কোথাও তার বোধগুলোকে সতেজ ও সজীব করতে পারছে না। আমরা এই তাৎপর্যহীনজীবনকে আমরা আমাদের ইন্দ্রিয়গুলি দিয়ে কিছুকাল তাৎপর্যপূর্ণ করে যেতে চাইবো–, যদিও যে কোন মুহূর্তেই প্রস্তুত থাকবো মৃত্যুর । আরো কিছু কাল বেঁচে থেকে আমরা জ্যোৎস্নায় ভিজতে চাইবো, অমাবস্যার নক্ষত্রে ভরা আকাশ দেখতে চাইবো , নারী দেখতে চাইবো , শিশির আর ঘাস ছুঁতে চাইবো , ছড়ানো কুয়াশার মধ্যে দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে ঘাসের গন্ধ পেতে চাইবো, কবিতা পড়তে চাইবো – লিখতে চাইবো, আর পৃথিবীর কোণায় কোণায় ছুটে যেতে চাইবো …তারপর একদিন মৃত্যু আসুক হঠাৎ করে–আমরা যেকোন জায়গাতেই পড়ে থাকতে পারি–জলে, জলাভূমিতে , পাহাড়ের চুড়োয়, নদীতে, মরুভূমিতে, তুষারস্তূপে । কিছুই অপবিত্র নয় যেমন কিছুই পবিত্র নয়; সবই সুন্দর–আর সবথেকে সুন্দর এই তাৎপর্যহীন জীবনকে নিজের ইন্দ্রিয়গুলো দিয়ে তাৎপর্যময় করে বেঁচে থাকা।

৪.

গিরিজাপতি ভট্টাচার্য 'ধূসর পাণ্ডুলিপি'র আলোচনায় লিখেছিলেন, 'এই গ্রন্থে স্থানে স্থানে কাঁচা হাতের ছাপ চোখে পড়ে, সুন্দর ও সার্থক পঙক্তির প্রাচুর্য থাকলেও সমগ্র কবিতা মাঝে মাঝে নিষ্প্রভ ও অস্পষ্ট মনে হয়। কতকগুলি ভাব, উপমা ও বাক্যের পুনঃ পুনঃ সমাবেশ কবিতাগুলোর দৌর্বল্য প্রকাশ করে, তথাপি এই বইয়ে এমন সৌন্দর্যস্বাতন্ত্র্য ও কবিত্ব-বিকাশ আছে যা কবির অনন্যসাধারণ দক্ষতার পরিচায়ক।’

সুন্দর ও সার্থক পঙ্‌ক্তি জীবনানন্দে ভরপুর। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা এক আলেয়া হিসেবেই পাঠকের সম্মুখে আসে। পাঠক বোঝা ও না বোঝার স্বতন্ত্র এক আচ্ছন্ন বোধে বুঁদ হয়ে থাকেন। অনেকটা মদের মতই। কিন্তু সেই মতিচ্ছন্নতা কেটে গেলে উজ্জ্বল রোদের দিকে তাকাতেও কষ্ট হয়। খুঁজে পাওয়া যায় না আচ্ছন্নতার কার্যকরণ।

'বাঙলা সাহিত্যে বাস্তববাদের সমস্যা' প্রবন্ধে ননী ভৌমিক লেখেন- '...সাম্প্রতিক কবিতার ক্ষেত্রে জীবনানন্দ দাশ অস্বীকৃতিরই একটি আধুনিক মুখোশ মাত্র। আপন অবচেতনার রঙে স্বাধীন বাস্তব জগতকে, মানুষ এবং তাঁর ভূত-ভবিষ্যতকে এমন করে রাঙিয়ে দেওয়ার দুর্লক্ষণ আতঙ্কের কথা; অথচ বিস্ময়ের কথা এই যে এমন সমালোচক আছেন যারা এই ছিন্নবিচ্ছিন্ন, চিন্তাহীন, উদ্ভট অনুভূতিস্রোতকে আখ্যা দেন 'ঐতিহাসিক বোধ' বলে।'
['পরিচয়', অগ্রহায়ণ ১৩৫৯]

দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর বিখ্যাত সম্পাদনা গ্রন্থ ‘জীবনানন্দ দাশ : বিকাশ প্রতিষ্ঠার ইতিবৃত্ত’-তে লিখছেন জীবনানন্দ জীবিত কালে অনন্দিত থাকার কারণ মনীন্দ্র গুহের জবানীতে , “ জীবনানন্দের সামাজিক অনাদরের জন্য তাঁর চিরন্তন অসামাজিকতা দায়ী। কবির সমকালে নজরুল, প্রেমেন্দ্র মিত্ররা সফল ছিলেন কারণ তাঁরা কবিতায় ব্যক্তি থেকে সামাজিক বক্তব্যে গিয়েছেন।‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’-তে কবির উপলব্ধি জাতীয় জীবনের গভীরে প্রসারিত নয়’। ‘বনলতা সেন’ ও ‘মহাপৃথিবী’তে প্রবল কাব্যশক্তি থাকলেও একটা বিশেষ মূল বিশ্বাসে আনা যায় না।‘প্রেমের কবিতায় সামাজিক অস্তিত্বের থেকে আত্মিক জগতই লক্ষ্য ছিল’ চল্লিশের দশকে কবি গণ্ডিমুক্ত হলেও ‘বৈজ্ঞানিক’ ও ‘দার্শনিক’ দৃষ্টি নেই’। প্রতিটি কারণ নির্মোহ ভাবে দেখলে সত্য আর আলোচনার দাবি রাখে!

জীবনানন্দ গবেষক অমলেন্দু বসু, যিনি ‘মাল্যবান’-এর ভূমিকা লিখেছেন, তিনি জীবনানন্দকে দেয়া রবীন্দ্রনাথের ‘serenity’ জাতীয় কাব্যিক বিশুদ্ধতার পরামর্শে লিখেছেন—‘রবীন্দ্রনাথের কাব্যঅভিব্যক্তিতে নিয়ত বহমান যে অপরিমেয়তল প্রশান্তির ধারা সে ধারা নিজ অভিব্যক্তিতে আয়ত্ত করেছেন এবং বাঙালি মানসের ও কাব্যের যে নিঃসংশয় ঐতিহ্য রবীন্দ্রনাথে বর্তেছিল তারই ধারক জীবনানন্দ’। (জীবনানন্দ দাশ : উত্তরপর্ব, দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত)। মন্তব্যটি গভীর অনুসন্ধিত্সু। বাঙালি মানসের এই ঐতিহ্য জীবনানন্দের কাব্যিক বিশুদ্ধতার প্রতীক কেননা ঐতিহ্য মাত্রেই বিশুদ্ধতা থাকে।

‘একান্তরূপেই একটি বিশেষ মানসিক ভঙ্গির প্রতীক-তাতে নতুন ভাব বা নব্য আঙ্গিকের বিদ্রোহ নেই। এমনকি সাম্প্রতিক বাংলা কবিতার বিদ্রোহ যে দ্বিতীয় আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সেই সাম্যবাদী দৃষ্টিও তাঁর নেই’।

আধুনিকতাবাদ ও জীবনানন্দের জীবনোৎকণ্ঠা গ্রন্থে প্রশ্নের আকারে সমালোচনা ও বিতর্কের পথ খুলে দেন আবুল কাসেম ফজলুল হক। করেছেন কিছু গুরুত্বপূর্ণ জিজ্ঞাসা- আর জীবনানন্দের নৈব্যত্তিক মূল্যায়নের স্বার্থে এসব প্রশ্নের উত্তর আমাদের পেতে হবে। যেমন, যিনি মানুষ হিসেবে দুর্বল, কবি হিসেবে তিনি কি শক্তিশালী হতে পারেন? শুধু কবিতার কথা কেন? তাঁর গল্প-উপন্যাসে যদি তাঁর আত্মজৈবনিক ভিত্তি খোঁজ করা হয় তাহলে সেখানেও কি জীবনানন্দকে শক্তিশালী মনে হয়?

অধ্যাপক সাহেব বলছেন, ‘চিন্তা-চেতনার দিক থেকে তাকে প্রগতিশীল বলবার কোনো কারণ আমি খুঁজে পাই না। রক্ষণশীল চেতনার, জীবনের বিকার-বিকৃতির ও অবক্ষয়ের অদ্বিতীয় রূপকার তিনি’- এর উত্তর দরকার। আমার ধারণা বদলেয়ার যেভাবে ভিক্টর হুগোর প্রভাব এড়াতে স্বেচ্ছায় বিপরীত জগত বেছে নিয়েছিলেন, নিয়েছিলেন সেই বোধ যে তিনি নিজেও বিশ্বাস করেন নি, জীবনানন্দ রবীন্দ্র প্রভাব এড়াতে তাই করেছিলেন। তাঁর দুঃখবাদী মানস এমন দুঃসহ পাথরের মতো কবিতার অন্তরে জেঁকে বসে যে ‘রূপসী বাংলা’ কাব্যকে মনে হয় একটি সমাধিলিপি। আধুনিকতাবাদীদের নিছক দুঃখবাদী কিংবা বিশ্বযুদ্ধের অভিঘাতকেন্দ্রিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ আমাদের পরিতৃপ্ত করে না; যদি না তাতে কোন পথের সন্ধান থাকে।

মৃত্যুপরবর্তী জীবনানন্দ জীবিত জীবনানন্দের থেকে শক্তিশালী হয়ে ওঠেন নিশ্চয় তাঁরই কাব্যিক ঐশ্বর্যে। কিন্তু আমার প্রশ্ন জীবিত কালে তথাকথিত ‘অবহেলিত’ আর না বোঝা জীবনানন্দের কবিতা হঠাৎ করেই কি তাবৎ কবিতা পাঠক বুঝতে শুরু করলেন? তাকে নিয়ে এতো তোড়জোড় এতো অধিক মুগ্ধতা কি স্বাভাবিক নাকি অতিশয়োক্তি এটাও আজ বুঝে নেয়ার সময় হয়েছে। দেবীপ্রসাদ তাঁর লেখাতে শেষে বলেছিলেন, আগে যে স্বীকৃতি দেয়া হয়নি পরে তা দেবার জন্য এত তোড়জোড় কেন তবে কি তা ‘অতিস্বীকৃতি’! দেবীপ্রসাদ একথাটি বলেছেন আক্ষেপের সুরে। জীবনানন্দ কি জীবিতকালের মতো আজও আক্ষেপ হয়ে রইলেন বাংলা কবিতায়?

দোহাই:

১। জীবনানন্দ দাশ : উত্তরপর্ব, দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত

২। আলেখ্য : জীবনানন্দ, ভূমেন্দ্র গুহ

৩। জীবনানন্দ ও সঞ্জয় ভট্টাচার্য, ভূমেন্দ্র গুহ

৪। জীবনানন্দ সমগ্র, প্রতিক্ষণ প্রকাশিত দেবেশ রায়ের ভূমিকা

৫। মানুষ জীবনানন্দ : লাবণ্য দাশ

লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক