খুলনার সোনালী ব্যাংকের অর্থ লোপাট, ব্যাংক পাড়ায় তোলপাড়
মুহাম্মদ আবুতৈয়ব, খুলনা ব্যুরো : “পাট খাতে রাজনৈতিক প্রভাব, খুলনা সোনালী ব্যাংকের ১৫০০ কোটি টাকা আদায় অনিশ্চিত ” শিরোনামে অনলাইন নিউজ পোর্টাল দ্য রিপোর্ট টোয়েন্টিফোর ডটকমে প্রকাশিত সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে খুলনা ব্যাংক পাড়ায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। দুনীতি দমন কমিশন (দুদক) বিষয়টি তদন্ত করার জন্য ঊর্ধতন কতৃপক্ষের কাছে আবেদন জানিয়েছে।
ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তথ্য সঠিক বলে অভিমত দেওয়াই অর্থ লোপাটকারীরা বেজায় ক্ষুদ্ধ হয়েছেন। এক ঊর্ধতন ব্যাংক কর্মকর্তাকে খুলনা থেকে বদলীর জন্য একজন সংসদ সদস্যকে দিয়ে ডিও লেটার ইস্যু করিয়েছেন।
গত ২১ অক্টোবর সংবাদটি প্রকাশের পর খুলনার ব্যাংক পাড়ার আলোচনার প্রধান ইস্যুতে পরিণত হয়। অনেকেই এই লোপাটের নতুন নতুন তথ্য প্রকাশ করেছে । একই ভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে সংবাদটি ভাইরাল হয়ে যায় । ফেসবুকে ব্যাংক লোপাটকারীদের ক্রসফায়ার দেওয়া দাবি জানানো হয়।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) খুলনার অন্যতম সদস্য ও সচেতন নাগরিক কমিটির আহবায়ক অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির জানান, একই অপরাধে ইতিপূর্বে ব্যাংক কর্মকর্তাসহ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে । সেই একই অপরাধে এই ব্যবসায়ীরা শুধু রাজনৈতিক কারণে সাজা না পেয়ে আবার তাদের নতুন করে ঋণ দেওয়াটা অনৈতিক । তিনি দাবি করেন, এক দেশে দুই ধরনের আইন চলতে পারে না ।
সোনালী ব্যাংক বিএল কলেজ রোড় শাখার সাবেক ম্যানেজার এজিএম জয়নাল আবেদিন জানান, পাট ব্যবসায়ীদের পিসিসি (প্যাকেজ ক্যাস ক্রেডিট) ঋণটি দেওয়া হয় বিদেশে পাট রপ্তানি হবার জন্য গ্রাহকের হিসাবে ব্যাংকে এলসি আসার পর। ৯০ থেকে ১৮০ দিনের জন্য এই ঋণটি দেওয়া হয় মাত্র ৭ শতাংশ সুদে । এই ঋণের বিপরীতে অন্য কোন জামনাত নেওয়া হয় না কারণ এলসিটাই জামানত।
সোনালী ব্যাংক খুলনা জোনের ছয়টি শাখায় এই পিসিসি ঋণখেলাপির পরিমাণ ৩৫ কোটি ৭০ লাখ টাকা । তাই প্রতিয়মান হয় যে পাট রাপ্তানিকারকরা ভ’য়া বা জাল এলসি দেখিয়ে এই ঋণ নিয়েছেন। অথবা মানি ল্যান্ডরিং করে এলসির অর্থ বিদেশে গচ্ছিত রেখেছেন। পিসিসি ঋণ ৩৫ কোটি ৭০ লাখ টাকার মধ্যে ২৫ কোটি ১৭ লাখই দৌলতপুর কর্পোরেট শাখার । খুলনা কর্পোরেট শাখার এক কোটি ৪৭ লাখ, বিএল কলেজ রোড় শাখার ৫ কোটি ৭৩ লাখ, খালিশপুর শাখার তিন কোটি ৩৩ লাখ । কলেজ রোড় শাখায় গত এক বছরে পিসিসি ঋণ বকেয়া প্রায় ৭ কোটি টাকা কৌশলে আদায় করেছেন বর্তমান ম্যানেজার জাকির হোসেন খান। এর মধ্যে বড় অংশটি ছিল সিরাজুল ইসলামের দুটি হিসাব থেকে কেটে নেওয়া ।
ব্যাংকের একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, পাট রপ্তানিকারক হয়ে কোন দিন পাট রপ্তানি করেনি এমন ব্যাক্তিকেও এই পিসিসি ঋণ দেওয়া হয়েছে। জামানত বিহীন এই ঋণের টাকা লোপাট ঘটনায় সোনালী ব্যাংক দৌলতপুর বিএল কলেজ রোড় শাখা পক্ষ হতে ১৫ অক্টোবর স্থানীয় পত্রিকায় এক পাট রাপ্তানি কারকের ছবি সহ রঙ্গিন বিজ্ঞাপন প্রকাশ ” একে ধরিয়ে দিন শিরোনামে”।
এই ধরনের বিজ্ঞাপনই প্রমান করে দেয় যে ব্যাংকে প্রয়োজনীয় জামানত ছাড়া ঋণ দেয়ার চিত্র।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত দুই বছর ধরে অর্থঋন আদালতের জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকায় দেয়া ১৬টি নীলাম বিজ্ঞপ্তির একটির নীলাম বিক্রি হয়নি। কারণ ব্যাংকের খাতা পত্র অনযায়ী কোন পাট গুদামেই পাট নেই আবার জামানত হিসাবে দেয়া সম্পত্তির মুল্য বাস্তবের মুল্যর চেয়ে ব্যাংকে দেখানো হয়েছে অবিশ্বাস্য মূল্যের ।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১০ সালের পর থেকে ব্যাংকের ঊর্ধতন মহলের সাথে দহরম মহরম থাকায় খুলনা অঞ্চলের খবরদারী করতেন ভিজে সিরাজ খ্যাত সিরাজুল ইসলাম । তিনি ব্যাংক কর্মকর্তাদের ধমকের সুরে কথা বলতেন । ডিজিএম, এজিএমদের বদলী পদোন্নীতি ঋণ প্রদান সবাই চলত তার নির্দেশে। কেউ তার নির্দেশ না মানলে শাস্তিমূলক বদলী ছিল নিশ্চিত । সিরাজুল ইসলাম তার সুবিধার জন্য খুলনা কর্পোরেট শাখার ডিজিএম নেপাল চন্দ্রকে পদোন্নাতি দিয়ে খুলনায় জিএম হিসাবে থাকার ব্যবস্থা করেন। এই জিএম নেপাল চন্দ্র সোনালী জুট মিলকে অনিয়ম করে ১১০ কোটি টাকা ঋণ দেবার কারণে দুদকের মামলার অন্যতম অসামি হয়ে বর্তমানে সাময়িক বরখাস্ত রয়েছেন ।
সোনালী ব্যাংকের ঋণ খেলাপি ঋণের খবর প্রকাশিত হবার পর বেজায় ক্ষিপ্ত হয়েছে অবৈধ সুযোগ সুবিধা নেয়া একটি চক্র। কারণ এই সংবাদ প্রকাশের পর সোনালী ব্যাংক কর্তপক্ষর ঋণ খেলাপিদের নতুন করে দেয়া ঋণের বৈঠকটি বাতিল করে দেয়া হয়েছে । একই ভাবে স্থানীয় সংসদ সদস্যকে ভুল বুঝিয়ে জিএম মো: মোশারেফ হোসেনকে বদলীর জন্য ডিও লেটার ইস্যু করানো হয়েছে । বিষয়টি সোনালী ব্যাংকের প্রধান কার্যলয়ের গোচরে আনা হয়েছে । এসব ব্যাংক কর্মকর্তাদের খেলাপি ব্যবসায়ীরা নানা ভাবে হুমকিও দিয়েছে । তবে খুলনা সোনালী ব্যাংকের কেউ এ বিষয় কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।
এই ঋণ খেলাপিদের সংবাদ প্রকাশের পর প্রতিবাদ দিতে গিয়ে সিরাজুল ইসলাম লিখিত ভাবে দাবি করেছেন ২০১৩ সালে বিএনপি জামাত কর্তৃক সৃষ্ট রাজনৈতিক অস্তিরতায় বিশ্ব বাজারে পাটের দাম কমে গিয়েছে । যে কারণে এই পাট ব্যবসায়ীরা নাকি ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে পৌঁছে গেছেন। ফলে তারা ব্যাংকের ঋণ খেলাপিতে পরিণত হয়েছে । এই প্রতিবাদ লিপিতে সিরাজুল ইসলাম সোনালী ব্যাংকের জেনারেল ম্যানেজার মো: মোশারেফ হোসেনের দেয়া তথ্য সঠিক নয় বলে দাবি করেন। তিনি জানান, তার নিজের ২৩ আর ছেলের নামে ১৭ কোটি টাকার ঋণ রয়েছে । তবে লিগ্যাল নোটিশে সিরাজুল ইসলামের নামে ৪৭ কোটি এবং ছেলে ও তার প্রতিষ্ঠানের নামে ২৩ কোটি টাকা করে খেলাপি দাবি করা হয়েছে জানালে তিনি নিরব থাকেন। বলেন, সংবাদ প্রকাশে পাট ব্যবসায়ীদের প্রচন্ড ক্ষতি হয়ে গেল ।
চুয়াডাঙ্গার গনমাধ্যম কর্মীদের কাছ থেকে জানা গেছে, চুয়াডাঙ্গায় সিরাজুল ইসলাম বিএনপি ঘরনার হিসাবে পরিচিত । তার ব্যবসাীয়ক অংশীদার জোত্যি বিস্কুটের মালিক সেন্টু আগারওয়ালা হত্যা মামলায় তিনি গ্রেফতার হয়ে ছিলেন। পরে জামিন নিয়ে চুয়াডাঙ্গা ছেড়ে খুলনায় চলে আসেন। ব্যাংক ঋণ সুবিধা নিতে তিনি খুলনায় আওয়ামী লীগের নেতাদের ব্যবহার করছেন।
দৌলতপুরে সুনামের সাথে দীর্ঘদিন যাবাৎ পাট রপ্তানির সাথে জড়িত প্রগতি জুট সাপ্লাই এর প্রধান নির্বাহী সাইফুল ইসলাম পিয়াস দাবি করেন বিশ্ব বাজারে পাটের দাম কমে গেলে সেই পাট গুদামের থাকার কথা । কিন্তু এসব ঋণখেলাপিদের গোডাইনে খাতা পত্র অনুযায়ী ১০ শতাংশ পাট নেই ।
তিনি জোর দিয়ে বলেন, ব্যাংকের অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজসে গোদামের পাট বিক্রি করে দিয়ে অর্থ লোপাট করা হয়েছে । একই ভাবে পাট খাতে ঋণ নিয়ে সেই বিনিয়োগ অন্য খাতে সরিয়ে ফেলা হয়েছে ।
২০১৩ সালের রাজনৈতিক অসন্তোষ চলাকালে খুলনা অঞ্চলে কোন বড় ধরনের সহিংস ঘটনা ঘটেনি। কোন পেট্রোল বোমা বিস্ফোরণ হয়নি। পাট বোঝাই কোন ট্রাক বা নৌ-যানের ক্ষতি গ্রস্থ হবার খবরও নাই । শুধু মাত্র রাজনৈতিক সুবিধা নেয়ার জন্য বিএনপি- জামাতের সহিংস ঘটনার কথা প্রকাশ করা হয়েছে ।
এদিকে দুর্নীতি দমন কমিশন খুলনা উপ পরিচালক আবুল হোসেন জানান , বিভিন্ন মিডিয়াতে প্রকাশিত সোনালী ব্যাংক লোপাটের সংবাদ তার দৃষ্টি গোচর হয়েছে । তিনি এসব সংবাদের সূত্র ধরে ঊর্ধতন কতৃপক্ষর কাছে বিষয়টি তদন্ত করার আবেদন করবেন। এবং অনুমতি পেলেই তদন্ত শুরুসহ আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
(দ্য রিপোর্ট/এনটি/অক্টোবর ২৯, ২০১৭)