দ্বিতীয়বার হার্ট অ্যাটাকের পর রাহাত তার ওয়ার্ডেন এভিনিউয়ের বাসায় শুয়ে আছেন।শরীর এখনো দুর্বল। ডাক্তার বলে দিয়েছে প্রচুর বিশ্রাম  নিতে। শুয়ে বসে, টিভি দেখে আর খবরের কাগজ পড়ে দিন কাটছে। এবারের অ্যাটাকটা আগেরটার চেয়ে ম্যাসিভ। ডাক্তার আটচল্লিশ ঘণ্টার অনিশ্চয়তার সতর্কবার্তা দিয়ে ছিলেন। এখানকার বিনা পয়সায় চিকিৎসা সেবার কল্যাণে পয়সা খরচ হচ্ছে না ঠিকই, কিন্তু গত দুই মাস ধরে কাজে যেতে না পারায় সংসারের ওপর একটা বড় ধরণের চাপ পড়েছে। স্বাভাবিক কাজ কর্মে কতদিনে ফিরে আসবে তা কেউ বলতে পারছে না। মাথার কাছে টেবিল ফ্যান ঘুরছে। চোখে মোটা লেন্সের চশমা। শোয়ার ঘরের দেয়ালে স্ত্রী ফরিদার  বিকিনি পরা ছবি ঝোলানো। একরাশ অসহায়ত্ব নিয়ে সে সময় সময় ছবিটার দিকে তাকায় আবার কাঁচের জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। জানালার পর্দাটা নামানো-দূর দিয়ে লেকঅন্টারিওর বিস্তৃত নীল জলরাশির ওপর শাদা শাদা মেঘ উড়ে যাচ্ছে। 

ফরিদা সোফায় বসে গলফ বলের মতো দেখতে একটা বোতল থেকে মদের পেয়ালায় স্কচ হুইস্কি ঢালছে। ছোট ছোট শব্দ ব্যবহার করে বিড় বিড় করে কী যেন বলছে।
ফরিদা আজ ক্লাবে না গেলে হয় না? আমার মন ভাল নেই। তুমি পাশে থাকলে ভাল লাগতো। তা ছাড়া ছেলে মেয়েরা বড় হচ্ছে।এগুলো কি তোমার চোখে পড়ছে?
উইক-এন্ডে ক্লাবে না গেলে, মদ খেয়ে না নাচতে পারলে আমার ঘুম হয় না, পেটের ভাত হজম হয় না, তা তুমি ভাল করেই জান। আজও আমাকে যেতে হবে।

ফরিদাকে বড় অচেনা লাগে আজকাল রাহাতের। অতীতে ফিরে যায় রাহাত। ঢাকার মানিকনগরে থাকত সে। অভাবের সংসার। দশ বছর বয়সে এক রাতে হঠাৎ সড়ক দুর্ঘটনায় বাবা মাকে হারানোর পর এতিম হয়। পরে চাচারা তাকে ঠেলা গাড়ির কাজে লাগিয়ে দেয়। পুরান ঢাকায় ঠেলা গাড়ি চালাতে চালাতে একসময় ভ্যান চালাতে শুরু করল রাহাত। খ্যাপ নেওয়ার জন্য একদিন লক্ষ্মীবাজারের ভিক্টোরিয়া পার্কের সামনে বসে আছে। পরনে কালো রঙের দোনলা প্যান্ট। প্যাসেঞ্জার না পেয়ে সামনের মতিমিয়ার চায়ের দোকানে চা সিঙ্গাড়া খেতে যায়। সেখানে চা খেতে আসা এক জার্মান নাগরিকের সাথে তার পরিচয় হয়। নাম উলফ গ্যাং ভলম্যান। ইউনেস্কোর ঢাকা অফিসের একজন কর্মকর্তা। পুরান ঢাকার ঐতিহ্য নিয়ে একটা প্রজেক্টের কাজে প্রায়ই এদিকে আসে। সেই ভলম্যান একদিন তাকে জার্মানির বার্লিনে নিয়ে এল। একটি টেনিক্যাল স্কুলে ভর্তি করে দিল। দুবছর পর হঠাৎ একদিন ভলম্যান মারা গেলে রাহাত তার কানাডা অভিবাসী বন্ধু রায়হানের পরামর্শে কানাডার টরন্টোতে পাড়ি জমাল। বেশ একটা গতির জীবন নিয়েছে এখন সে। অথচ ছোটবেলায় পাশের গ্রামে তার বড়বোনের বাড়িতে যেতে বললে কী মন খারাপ করতো। ঘরমুখো টান ছিল বলেই হয়তো আজ যাযাবরের জীবন বেছে নিয়েছে।

রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে ফরিদা। বিক্রমপুরের এক অজ পাড়া গাঁয়ের মেয়ে সে। তার বাবা প্রথমে রাহাতের সঙ্গে ফরিদার বিয়েতে রাজি ছিল না। ফরিদার চাচা নাসেরের জেদা-জেদিতেই শেষ পর্যন্ত বিয়েটা হয়েছে। নাসেরের এক বন্ধুর বড়ভাইয়ের ছেলে রাহাত।

কানাডায় আসার পর ফরিদার আচার আচরণ কেমন যেন? সব সময় বিষণ্ণ ও উদাসীন। সবকিছুতেই যেন আড়ষ্ট, সব সময় মনমরা।ইদানীং টিভি দেখে, শপিংমলে বা মেলায় গিয়েও সে আনন্দ পায় না। রাহাত ভাবে হয়তো এতবড় টরন্টো নগরীতে গাঁয়ের মেয়ে ফরিদার মন বসছে না। ভিনদেশ, অচেনা শহর, অজানাপথঘাট। মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্মীয় স্বজনহীন নতুন পরিবেশে এসে হয়তো তার মন ভেঙে পড়েছে। রাহাতের মনে হল এ পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসতে হলে ফরিদাকে এখানকার কালচার শেখাতে হবে, বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে বেড়াতে নিয়ে যেতে হবে।

জুলাই মাসের বিকেল। লংউইকেন্ড। রাহাতের বন্ধু রায়হান ব্রাম্পটন থেকে এসেছে।রায়হান রাহাতের ছোটবেলার বন্ধু।মানিকনগরেরেললাইনের ধারে কাঁচাবাজারের পাশের গলিতেপাশাপাশি বাসায় থাকত। অনেকদিন পর দুইবন্ধু একসাথে হল। মনখুলে অনেক কথা-বার্তা হল।টেবিলে সাজানো কয়েকটি দামি মদ আর বিয়ারের বোতল।

ফরিদা, এদিকে এসো। দেখো কে এসেছে?

ফরিদা এসে হাজির।

ফরিদা এসো, বসো। আমাদের সঙ্গে বসে একটু মদ খাও। রায়হান আমার ছোটবেলার বন্ধু। লজ্জার কিছু নেই।

না এসব ছাইপাশ আমি খাব না। তোমরা খাও। প্লিজ আমাকে মদ খাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি কর না।

ভাবি সাহেব, যেখানে যে নিয়ম, যে কালচার তা মানতে হয়। এখানকার সমাজে মিশতে হলে, অ্যাডজাস্ট করে চলতে হলে একটু-আধটু মদটদ খেতে হয়, বারে যেতে হয়, পার্টিতে যেতে হয়। পুরনো লাইফস্টাইল ভুলে যান, দেশের কথা ভুলে যান। তাছাড়া এই নির্দয় শীতের দেশে একটু আধটু মদটদ, বিয়ার-টিয়ার না খেলে বাঁচবেন কী করে? রায়হান পেয়ালায় মদ ঢালতে ঢালতে কথাগুলো বলে।

না ভাই, মদ খাওয়া, পার্টিতে যাওয়া এসব আমি পারব না। কানাডায় থাকলেও আমি একজন খাঁটি বাঙালি মেয়ে হয়েই থাকব, আমার পারিবারিক মূল্যবোধ নিয়েই থাকব। ভাল না লাগলে দেশে ফিরে যাব, তবু কখনো ওসব খাব না।

এরপর রাহাত তাকে এক রকম জোর করে টেবিলে এনে বসাল। টেবিলে বেশ কয়েক বোতল ইয়েলো লেবেল হুইস্কি, এক প্যাকেট ডানহিল সিগারেট, আর কয়েক প্যাকেট চানাচুর। নিজে দুবোতল ইয়েলো লেবেল হুইস্কি সাবাড় করল। ফরিদার মনের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে যায়। খাবে কি খাবে না। যখনই খেতে চায় তখনই যেন একটি ভয়াবহ অদৃশ্যশক্তি পেছন থেকে টানদিয়ে ধরে। মনের ভিতরের এইদ্বন্দ্বযুদ্ধ-টু ড্রিংক অর নট টু ড্রিংক- তাকে কাহিল করে ফেলে।অবশেষে এক সময় তার রক্ষণশীল মন পরাজিত হয়।

দাও তবে একটু খেয়ে দেখি,দুজনের মুখ চেয়ে ফরিদা বলে।জীবনে প্রথম মদ খেল ফরিদা।তার ভেতরে একটা অপূর্ব আনন্দানুভূতি খেলে গেল।আনন্দে রাহাতের চোখ মুখ উদ্ভাসিত হয়ে গেল। যেন তার অনেকদিনের স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত হল।

আর একটু খাবে? রাহাত জিজ্ঞেস করল ফরিদাকে। আর এক বোতল বিয়ার?

আর না। আজ আর খাব না। অন্যদিন। রাহাত ফরিদাকে বোতল থেকে মদ কিভাবে পেয়ালায় ঢালতে হয়, তারপর পেয়ালা কিভাবে ধরে মদ খেতে হয় সব তাকে স্কুলপড়ুয়া ছাত্রীর মত শিখিয়ে দিল।

রাহাত ও ফরিদা দুজনই চাকরি করে। ফরিদা এগলিন্টন এভিনিউতে একটা কসমেটিক কোম্পানিতে কাজ করে। রাহাত একটা কন্সট্রাকশন কোম্পানিতে সুপারভাইজার পদে কাজ করে।দুজনই দুহাতে কাজ করে আর প্রচুর ডলার হাতে আসতে থাকে। উইক-এন্ডেডাউন্টানের নাইটক্লাবে যায়। দুহাতে পয়সা ওড়ায়। প্রথম প্রথম ফরিদা আড়ষ্ট থাকত। ওর আড়ষ্টতা ভাঙ্গায় রাহাত। তাকে জোর করে ঠেলে দেয়, শাদাদের সঙ্গে নাচতে বলে। ফরিদা নাচে। রাহাত নেশাতুর চোখে তা তাকিয়ে দেখে। ফরিদার পরিবর্তন দেখে অবাক হয় সে। দক্ষ নাচুড়ের মতো সে নাচে এখন। এতটুকু জড়তা নেই।

দিন দিন এসবে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে ফরিদা। এখন রাহাতকে ছাড়াই ক্লাবে,পার্টিতে যায়। রাত করে ঢুলুঢুলু চোখে বাসায় ফেরে। ইদানীং নতুন নতুন বন্ধু নিয়ে বাসায় আসে,রাতে একঘরে থাকে।রাহাত থাকে অন্যঘরে। অসুস্থ রাহাত অসহায় চোখে তা দেখে। কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারে না।অন্য পুরুষের সঙ্গে ফরিদার এরকম অন্তরঙ্গতার দৃশ্য রাহাতের অসহায়ত্বকে বিব্রতকর অবস্থায় নিয়ে যায়, তার ভেতরে রক্তক্ষরণ ঘটে। সে বুঝতে পারে জীবন-যন্ত্রণার এই ফাঁদ থেকে সহজে বের হতে পারবে না।

রাহাত টের পেয়েছে,সংসারের ওপর কাল মেঘের ছায়া ঘনিয়ে এসেছে,ঈশাণ কোনে ঝড় উঠেছে, তুষার ঝড়ের মত তা যে কোন সময় তার এতদিনের গড়া সুখের সংসারকে ছিন্ন ভিন্ন করে দিবে।

ফরিদা,তুমি কিন্তু সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছ। নতুন নতুন বন্ধু নিয়ে আসছো বাসায়। অনেক সহ্য করেছি। আমি তোমার এসব নোংরামি আর সহ্য করব না। তুমি বাসায় বসে খাও,বাইরে খেও না।

বা তুমিতো বেশ ভাল মানুষ হয়ে গেছ। তুমিই তো আমাকে রাস্তা দেখিয়েছো। তবে এখন কেন তোমার এসব সহ্য হয় না? না আমি আমার মত চলবো। আমার ভালমন্দ নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না।

হ্যাঁ, শিখিয়ে ছিলাম। কিন্তু তখন তো জানতাম না তুমি সীমা অতিক্রম করে যাবে।

ফরিদা,কেন বুঝছো না?আগে নেশা তোমার নিয়ন্ত্রণে ছিল,আর এখন তুমি নেশার নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছ। তাই বলি কী নেশা টেশা কমিয়ে দাও। ভোগ-আনন্দই কি জীবনের সব?ঘর-সংসার,সন্তান-সন্ততি কি এসবের চেয়ে মূল্যবান নয়?তাছাড়া আমাদের ছেলে মেয়েরা যদি এই বয়সেই মদ চিনে ফেলে,ওদের ভবিষ্যৎ ওযে পিছলে হয়ে যাবে তাতে সন্দেহ নেই।

ফরিদা রেগে গিয়ে লাল হয়ে বলল,আমাকে জ্ঞান দিয়ো না। তুমি হলে বস্তির ভাঙা ঘরের ছেলে-নিজের জ্ঞান নিজের কাছে রাখো। তোমার সঙ্গে অনেক হয়েছে। তোমার মত আন রোমান্টিক ছেলের সঙ্গে আর ঘর করা নয়। আমি ববের কাছে চলে যাচ্ছি। সবকিছু কোর্টে সেটেল্ড হবে। বলে হন হন করে দোতলায় উঠে গেল। হাতে একটা ব্যাগ নিয়ে নিচেনামল, প্রচণ্ড শব্দে বাইরের দরজা বন্ধ করে গটগট করে সে বাসা থেকে বের হলো।বব ওর কলিগ ও বন্ধু। একসাথে কস্মেটিক কোম্পানিতে চাকরি করে। বিপত্নিক, মধ্যবয়সী, দেখতে কৃমির মত শাদা ও বিবর্ণ। চোখদুটো তীক্ষ্ণ, বাজপাখির মত চাহনি। উদার ও ফূর্তিবাজমানুষ । শেপারড এন্ড ম্যাকোয়ান এলাকায় বাসা।

রাহাত বসে রইল সদ্যপাওয়া মানসিক ধাক্কা সামলানোর জন্য। কয়েক সেকেন্ড থতমত ভাব কাটিয়ে আবার স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করল। ফরিদার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি যেতে চাচ্ছ যাও। তবে জেনে রাখ আমার মত শুভাকাঙ্ক্ষী ছেলে আর দুনিয়াতে পাবে না। দেখি তোমার ঐ শাদা চামড়া কয়দিন তোমার খরচা দেয়? আমাকে সব সময় আনরোমান্টিক বলে যেগালিগালাজ ও দোষারোপ করেছ-তার ছিটে ফোঁটাও ওকে করতে পারবে না। তোমাদের এই হানিমুন কয়েকদিনেই হাওয়া হয়ে যাবে। শাদা চামড়ার শখ অচিরেই মিটে যাবে। বুঝবে, ফরিদা একদিন বুঝবে।

রায়হানকে ফোন করে রাহাত সব বলল।বুঝলে রায়হান, ফরিদাকে বিয়ে করে ছয় মাসের মাথায় এদেশে নিয়ে এলাম, বাড়ি-গাড়ি, পিয়ারকার্ড, সিটিজেনশিপ, ছেলে-মেয়ে, সমাজে পরিচিতি সবদিলাম, এখানকার রাস্তাঘাট চেনালাম আর আমাকেই লাথি মারলও! ভাবতে পারো? এগুলো ও নিজে নিজে করতে পারত? রায়হান একনাগাড়ে তার কথা শোনে। তারপর বলে, অসুখ-বিসুখে অসহায় হয়ে পড়া তোর মত একজন মানুষের যখন বড়বেশি একটি সুখকর স্পর্শের প্রয়োজন, তখনই তোর বউ দূরে চলে গেল। এটা বড়ই দুঃখজনক। বেশি ফ্রি করতে গিয়ে তোর বউ হাত ছাড়া হয়ে গেল। আরও আগে থেকেই তোর এদিকে নজর রাখা উচিৎ ছিল।

রায়হানের কথার কোন জবাব দেয় না রাহাত। খুব নিঃশব্দে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল শুধু। দেয়ালে টাঙ্গানো ফরিদার ছবির দিকে পুরু লেন্সের ভেতর দিয়ে ঝাপসা চোখে তাকায়, কয়েক ফোটা অশ্রু গাল বেয়ে নিচে গড়িয়ে পড়ে। নানান ভাবনা রাহাতের মাথায় এসে ভর করে। ফরিদা কেন এতদ্রুত বদলে গেল তা রাহাতের ভাবনা চিন্তার মধ্যে আসে না। যেন ফরিদা নয়,ফরিদার ভেতর থেকে এক অন্য ফরিদার জন্ম হয়েছে। খুবই অসহ্য মনে হচ্ছে রাহাতের। কিন্তু সে ফরিদাকে খুব ভালবাসে। ফরিদা তার প্রাণের বন্ধু। ও আগে এতজেদী আর অস্থির প্রকৃতির ছিল না। তাই পরক্ষণেই ভাবে, ফরিদা আসলে বদলায়নি, মানুষ ফরিদা একই আছে। বদলেছে পরিস্থিতি,বদলেছে স্থান,বদলেছে সময়। সময় তাকে বদলে দিয়েছে। সময় আমাদের প্রতিমুহূর্তে,প্রতিদিনএভাবেই বদলে দিয়ে যায়।

রাহাত তার পুরুলেন্সের চশমাটা চোখের ওপর থেকে নামাল, ক্লান্তচোখের পাতায় আঙুল দিয়ে মৃদুস্পর্শ করল, চোখের কোনা বেয়ে জল পড়তে লাগল। ঝুলে থাকা লম্বা পর্দা সরিয়ে জানালার কাঁচ দিয়ে বাইরে তাকাল। আকাশে একখণ্ড শাদা মেঘ ধীরে ধীরে উড়ে যাচ্ছে,শান্তসমুদ্রে একখণ্ড হিমাবহের গড়িয়ে চলার মতো। তার বুকের গভীরে ও যেন এরকম একখন্ড হিমাবহ গড়িয়ে পড়ছে। তলানিতে পড়ে থাকা ফরিদার জন্য তার ভালবাসাটুকু ছায়ামূর্তিতে পরিণত হয়ে তাকে তাড়া করছে।

এমনি করে কয়েক মাস কেটে গেছে।রায়হান রাহাতের খোঁজ খবর নেয়। বন্ধুর বিপদে পাশে এসে দাঁড়ায়। বেশ কিছুদিন ধরে ফেডারেল নির্বাচনের প্রচার চলছে। দেখে শুনে মনে হচ্ছে কনজারভেটিভ পার্টির স্টীফেন হারপার ও লিবারেল পার্টির জাস্টীন ট্রুডোর মধ্যে হাড্ডা হাড্ডি লড়াই হবে। রায়হান রাহাতকে নির্বাচনের পরের দিন উইক-এন্ডে তার বাসায় দাওয়াত দেয়। রাহাত সে দাওয়াত সানন্দে গ্রহণ করে। নির্বাচনের দিন শেষে রাতে যখন রায়হান বিয়ার নিয়ে সোফায় বসে আছে আর টিভিতে ভোটের ফলাফল দেখে উত্তেজনার আগুন পোয়াচ্ছে, ঠিক সেই সময় রাহাত ফোন করল। ‘কী রে রায়হান, তোরতো এবার কোনও পাত্তাই নেই। কী ব্যাপার বলতো! তুই অন্যদলে চলে গেলি নাকি রে? অবশ্য একটু পয়সা হলে সব কানাডিয়ান বাঙালিই দল পাল্টায়।” রায়হান বলল, ‘‘কী যে বলিস রাহাত! যাক ভোটের টক ঝাল গল্প করা বাদ দে। তুই এই উইক-এন্ডে আমার বাসায় আসছিস তো?

না রে, এই উইক-এন্ডে আমার তোর বাড়ি আসা হবে না। ফরিদা গতকাল আমাকে ফোন করেছিল। দেখা করতে চায়। ওকে বেশ অনুতপ্ত মনে হল। ও বলছে আগামীকাল বাসায় আসবে। ছেলে মেয়েদের খুব দেখতে ইচ্ছে করছে ওর। আমাকে বাসায় থাকতে বলেছে। হাজার হোক নিজের বউ তো- ভাবছি কাল বাসায় থাকব, কোথাও বের হব না। রায়হান দেখল ওর গলার স্বর খুশি- খুশি। রায়হান খুব খুশি খুশি মুখে বলল, দারুণ খবরতো, রাহাত। আগে বলিস নি কেন? রাহাত রায়হানকে বলল, কাল বিকেল পাঁচটার মধ্যে বাসায় আসবি কিন্তু! আমার ছেলে মেয়েরা থাকবে, ফরিদা আসবে, অনেক মজা হবে। কি আসবি তো? রায়হান মাথা নেড়ে বলল, নিশ্চয়!

পরদিন বিকেলে রায়হান রাহাতের বাসায় এল।এলাহিকাণ্ড! ফরিদা রান্না-বান্না করছে, ছেলে মেয়েরা খুশিতে হৈ চৈ করছে। রাহাত ঘরের এক কোনায় সোফায় বসে তা দেখছে, মুখটা খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।