মুহাম্মদ আবু তৈয়ব, খুলনা : পুলিশের নির্যাতনে ক্ষুদ্র সবজী ব্যবসায়ী মো. শাহজালালের চোখ তুলে ফেলার ঘটনার মামলা তদন্তে নতুন মোড় নিয়েছে। চোখ উঠানোর আগেই শাহ জালালকে নিয়ে পুলিশ খালিশপুর ক্লিনিকে গিয়েছিল। সিসি ক্যামেরার সে ফুটেজও পাওয়া গেছে। তবে তদন্তের স্বার্থে এই মুহূর্তে কিছু বলতে রাজি নন পুলিশ ব্যুরো অব ইনভিষ্টেগশন।

অপরদিকে অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তাকে বদলী না করায় বাদী পক্ষ ও মানবাধিকার সংস্থা হতাশা ব্যক্ত করেছে।

ঘটনার সূত্রপাত, গত ১৮ জুলাই খালিশপুর থানা এলাকার গোয়ালখালীতে। চোখ হারোনো শাহ জালাল আর তার পরিবারের দাবি, ঘটনার দিন সাদা পোষাকে খালিশপুর থানার সরকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) রাসেলসহ দুইজন রাত ৮টার দিকে হঠাৎ তাকে ছিনতাইকারী আখ্যা দিয়ে আটক করে স্থানীয় যুবলীগের অফিসে (যাত্রী ছাওনিতে যুবলীগ নেতারা বসে তাই যুবলীগ অফিস হিসাবে পরিচিত) নিয়ে রাখে। পরে পুলিশের গাড়ি এসে তাকে খালিশপুর থানা হাজতে নিয়ে যায়। এই সময় এএসআই রাসেল ও সোর্স দুই লাখ টাকা দাবি করে। টাকা দিতে না পারায় রাত সাড়ে দশটার দিকে থানা থেকে বের করে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে তাকে দুই চোখ হারানো অবস্থায় খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাওয়া যায়।

আর পুলিশের দাবি, ঘটনার দিন রাত ১১টা ৫০ মিনিটে দিকে ছিনতাই করতে গিয়ে ধরা পড়ে শাহজালাল। পরে গণপিটুনিতে তার দুটি চোখ তুলে দেওয়া হয় । এ ব্যাপারে সেদিন রাতেই সুমা আক্তার বাদী হয়ে দুই জনকে আসামী ছিনতাই মামলা দায়ের করে। ইতিমধ্যে শুধু শাহজালালকে অভিযুক্ত করে চাজর্শীট দাখিল করা হয়েছে দ্রুত বিচার ট্রাইবুনালে।

সরেজমিনে ঘুরে এবং অনুসন্ধানে জানা গেছে, খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের খালিশপুর থানার হাজত, প্রবেশ-বর্হিগমন পথ সব সিসি ক্যামেরায় আওতাধীন। শাহ জালালের দাবি তাকে সুস্থ অবস্থায় থানা হাজাতে রাখা হয়েছিল অন্য আসামীদের সাথে, যা সিসি ক্যামেরায় খোঁজ করলে পাওয়া যাবে।

সিসি ক্যামেরায় ১৮ জুলাই রাতের ফুটেজে জালালকে দেখা গেছে কি-না তা সেই ফুটেজ পরীক্ষা করা হয়েছে কি-না সে ব্যাপারে জানতে চাইলে খালিশপুর থানার ভার্রপপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নাসিম খান জানান, তারা ১৮ জুলাই রাতের ফুটেজ পরীক্ষা করে দেখেছেন। তার ভিতর শাহজালালের কোন ফুটেজ নাই। তিনি আরো জানান, বিষয়টি পরীক্ষা করে দেখেছেন কেএমপির তদন্ত কমিটি। এই সময় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে ডেপুটি পুলিশ কমিশনারের বক্তব্য ভিন্ন বলে দৃষ্টি আকর্ষন করলে তিনি আবার বক্তব্য পরিবর্তন করে বলেন, ডিসি স্যার ভাল জানেন। কারণ উনারা তদন্ত করে দেখেছেন।

এ ব্যাপারে কেএমপি ডেপুটি কমিশনার উত্তার মো: জাহাঙ্গির হোসেন জানান, ১৮ জুলাই ঘটনার সময় সিসি ক্যামেরা খারাপ ছিল। ফলে ওই সময়ের কোন ফুটেজ নাই। ফলে শাহজালাল থানায় গিয়ে ছিল কি-না তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

তিনি বলেন, যেহেতু মামলাটি বিচারাধীন তাই কিছু বলা যাবে না।

খলিশপুর থানা হাজত থেকে শাহ জালালকে রাত সাড়ে দশটার দিকে বের করে প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য খালিশপুর ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয় তা তাদের সিসি ক্যামেরায় ধরা পড়ে।

এ ব্যাপারে খালিশপুর ক্লিনিক স্বত্বধিকারী ডা: মুজাহিদুল ইসলাম জানান, তিনি কর্তব্যরত ডাক্তারের কাছে শুনেছেন ঘটনার দিন রাত সাড়ে দশটার পর পুলিশ একজন আসামীকে ফাষ্ট এইড দেবার জন্য এই ক্লিনিকে নিয়ে আসে। তাকে চিকিৎসার পর আবারও পুলিশ নিয়ে যায়। তবে সেই সময় তার নাম এন্ট্রি করা হয়নি।

তিনি আরো জানান, তদন্তকারী দল তাদের সেই ফুটেজও নিয়ে গিয়েছে। তিনি জানান, পরে তিনি জেনেছেন চোখ উঠানো সেই শাহজালালকেই রাতে এই ক্লিনিকে প্রাথিমক চিকিৎসা দেওয়া হয়।

বিষয়টি নিয়ে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেষ্টিগেশন খুলনা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আনিসুর রহমানের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, তদন্তাধীন বিষয় কোন কিছু বলা যাবে না।

তিনি জানান, আদালতে তাদের ২৬ ডিসেম্বর তারিখের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলেছে।

খালিশপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো: নাসিম খান জানান, সাংবাদিকরা শুধু শাহজালালের চোখ উঠানোর ঘটনা নিয়ে লিখা লেখি করছে। তাবে শাহজালাল আর তার বাবা যে ২৭ মামলা আসামী তা লিখিছে না।

শাহজালালের মা রেনু বেগমের দায়ের করা আসামী রাসেলের বাবা লুৎফর রহমান জানান, খালিশপুর থানার ওসি নাসিম খান ও এএস আই রাসেলকে জিজ্ঞাসবাদ করলেই প্রকৃত তথ্য পাওয়া যাবে, কেন তারা চোখ উঠালো। তিনি জোর দিয়ে বলেন, পুলিশ সব জানে। আর সেই পুলিশ কর্মকর্তাদের কেন এখনও বদলী করা হয়নি তা রহস্যজনক।

উল্লেখ্য, শাহজালালের মা রেনু বেগম বাদী হয়ে ৭ সেপ্টেম্বর আদালতে একটি মামলা দায়ের করেন। এই মামলার আসামীরা হলেন- খালিশপুর থানার ওসি নাসিম খান, এসআই রাসেল, এসআই তাপস রায়, এসআই মোঃ সেলিম মোল্লা, এসআই মিজান, এসআই মামুন, আনসার সিপাই আফসার আলী, আনসার ল্যান্স নায়েক আবুল হোসেন, আনসার নায়েক রেজাউল, এসআই নূর ইসলাম, এএসআই সৈয়দ সাহেব আলী, শুকুর আহম্মেদের মেয়ে সুমা আক্তার (২০) এবং শিরোমনি বাদামতলার লুৎফর হাওলাদারের ছেলে রাসেল (৩০)।

আদালত মামলাটি তদন্তের জন্য খুলনা পিবিআইকে নির্দেশ দিয়েছে। আদালত ১৮ অক্টোবরে মধ্যে রিপোর্ট দাখিল করার কথা ছিল। ওই দিন পিবিআই আরো সময়ের আবেদন করলে আগামী ২৬ ডিসেম্বর পরবর্তী দিন ধার্য করা হয়েছে।

(দ্য রিপোর্ট/এনটি/নভেম্বর ১৫, ২০১৭)