তৃষা চামেলির চারটি কবিতা
মাটির উর্বশী
এ আমার প্রিয়তম দেশ
পথের দু'ধারে সবুজ গুল্মের ফাঁকে উঁকি দেয়
নাম না জানা হলুদ কুসুমিত ঠোঁট
সারি সারি অড়হর, বেগুন পটল ঝিঙে কুমড়োর ক্ষেত
দলে দলে আনাগোনা মৌ-লোভি মৌমাছি
রঙিন প্রজাপতির ঝাঁক;
আম জাম হিজলের মনোময় ছায়া
দিগন্ত ছুঁয়ে যাওয়া সবুজের মায়া
এ আমার প্রিয় জন্মভূমি
পরতে পরতে যার পাহাড়ি গিরিখাদ
সুডৌল উপত্যাকা নদী, ডোবা, খালবিল, সাগরের তান
স্বপ্নের সাতরঙে সুশোভিত মেঘজল
তারকাপুঞ্জে খচিত আকাশের খাতা
অনিঃশেষ ভালবাসার প্রেমময় টান
কেমনে তোমায় ছেড়ে পালাব অন্য কোথা
অথবা যাব চলে শীতল মৃত্যুপুরী!
যেখানে রূপকথা পাখা মেলে, রূপের ঝাঁলর বুনে
পাখির কূজনে ভাসে মিঠেল বাতাস
যেখানে বৃষ্টির রিমঝিম ধুয়ে দেয় হৃদয়-গহন
ঋতুচক্রে দোল খায় নিসর্গের নাগরদোলা
জোনাকির ঝাড়বাতি নিঝুম অন্ধকারে
বসায় নক্ষত্রের মেলা;
এ আমার প্রাণের মাতৃকা, প্রেমার্ত স্বপ্নভূমি
অপরূপ নিসর্গ যাকে সমস্ত সৌন্দর্য ঢেলে
করেছে অমরাবতী;
চিরহরিৎ জলবতি বসন্ত বালিকা
নন্দনতত্ত্বে তাঁর চির নাম মাটির উর্বশী
আমার জন্মান্তরের ফিরে ফিরে আসার
মোহময় নেশাকাতর শ্যামাঙ্গী মুগ্ধতা।
স্বপ্নবৃক্ষের তলে
মধ্যরাতে ঘুম জাগানিয়া এক ভিনদেশি পাখি
ডানা ঝাঁপটায় আমার বিভোল স্বপ্নের সমুদ্রে
কোলাহল যতো তীব্র হয় ততোই গাঢ় হয়
স্বপ্নসময়
তাকে ধরতে গেলেই সে অদৃশ্য হয়ে যায়
তবু গহীন নির্ভরতায় ছুঁয়ে থাকে ঠোঁট
ঝুঁকিহীন মধ্যরাতেও কোথায় যেন উঁকি দেয় বেহায়া রোদ্দুর
ঘুমঘুম চোখ তবু পান-চুন ঠোঁটের মতো
গাঢ় লাল হয়ে যায়
অবসন্ন আবেশে অনুপম ঊর্মিমালা
নরোম তোলপাড়ে ভাঙে ঊষর সৈকত
কী এক নিঝুম সুগন্ধে ভরে যায়
হৃদয়ের জ্বলন্ত দুপুর
প্রতিরাতে তাই অতন্দ্র ঘুমের দুয়ার ঢেকে বসে থাকি
স্বপ্নবৃক্ষের নীচে
স্বপ্নপ্লাবন ভিজিয়ে দেয় যতো রুক্ষতা
অনন্ত বোধিসঙ্গমে।
মেঘের বীর্যপাত
কাল সারারাত ধরে অবিরাম বৃষ্টি হলো প্রবল প্রতাপে
ভেসে গেল বেড়িবাঁধ, ইটের সলিং,বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ
খালবিল, নালাডোবা, বাঁধানো পুকুর
সকল বৈষম্য ভুলে গলায় গলায়
সাম্যের মিতালি
পৃথিবীর বুক জুড়ে যেন নিমেষেই
নেমে এলো প্রশান্তির ছায়া
অথচ সেই তুমুল বর্ষণে একটুও
ভিজলো না আমার হৃদয়ের মাঠ
একটুও জুড়ালো না উত্তপ্ত এবুকের পাটাতন
তুমি বৃষ্টি নিয়ে চলে গেছো কোন মেঘেদের দেশে!
আমার তৃষ্ণার্ত পৃথিবীর সীমানা পার হয়ে
কোন গ্রহের জলসায় বসে গাইছো জলজসুরে বোনা বৃষ্টির গীতমালা;
প্রবল বানে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছো কার নীল অববাহিকা
আমার পৃথিবীর জল নিয়ে মেঘ বুনে বুনে
কার পৃথিবীতে বসে আঁকছো সুনিপুণজলের তৈলচিত্র
তৃষ্ণাকে মেঘের ছায়ায় ঢেকে ঢেকে নির্জ্জলা
এ মনের আর কতো হবে উপবাস!
একদিন ঠিক আমিও ভয়ঙ্কর বেপরোয়া হয়ে যাবো
দুর্নিবার শাসন আর ক্ষুধা-তৃষ্ণার জ্বালা বুকে নিয়ে
লিখে নেবো সর্বভূক খাদকের খাতায় নাম;
একদিন ঠিক আমিও মাদকরসে প্লাবিত এক পরজীবী ফুল হয়ে যাবো
গন্ধের উন্মাদনায় রাত্রির ঘুম নেব কেড়ে
নদীকে ন্যাংটা করে চেটে খাবো সবখানই জল।
একদিন আমিও কামার্ত মাটি হয়ে যাবো
হবো মাতাল গন্ধে ভেজা যমজ ব-দ্বীপ
আকাশের বাঁধন ছিড়ে আনবোই পেড়ে
তুলতুলে মেঘের বর্ণচ্ছটা
আমার তৃষ্ণার্ত মাটিতেই শুষে নেব
সেই ধবল মেঘের বীর্যপাত।
মেঘের জলকাব্য
বৃষ্টি মানেই প্রাণের মাঠে মেঘময় মৌসুম
রৌদ্রতাপে চৈত্রদগ্ধ হৃদয় ভেজানো ধুম।
বৃষ্টি মানেই হঠাৎ আঁধার সূর্য লুকানো দিন
সারারাত ভর টিনের চালে রিম ঝিমা ঝিম বীণ।
বৃষ্টি মানেই ঘুম ঘুম ঘুম রোদহীন নরোম দুপুর
তোমার কোমল পদ্মপায়ে পরা যে মেঘের নূপুর।
বৃষ্টি মানেই উঠোন জুড়ে নতুন কাদার গন্ধ
বাতাস জুড়ে মৌ মৌ মৌ জুঁই কামিনীর ছন্দ।
বৃষ্টি মানেই পথভোলা বেলা জীবনের স্বপ্ন গাথা
মাটির প্রাণে আছড়ে পড়া জলের মনের কথা।
বৃষ্টি মানেই সৃষ্টি সৃষ্টি সবুজোত্তম খেলা
আমার মনের গাঙুড়ে ভাসানো তোমার মেঘের ভেলা।
বৃষ্টি মানেই অরূপ বাংলার গঙ্গা যমুনা সিন্ধু
ফল্গু হৃদয়ে বয়ে যাওয়া যতো জলদ সে মহাবিন্দু।
বৃষ্টি মানেই পরিযায়ী দিন মেঘের খেয়ায় হাওয়া
ঈশানে ঊর্ধে চতুর্দিকে কারে যেন পেতে চাওয়া।
বৃষ্টি মানেই ফসলের সুখ ময়ূরীর কুহু কেকা
মেঘের কালিতে জলের খাতায় জলমেঘদূত লেখা।
বৃষ্টি মানেই কিশোর সে বেলা হারালো যেন কোথা
উদাস দুপুরে ডিঙি বাওয়া বিল খুঁজে ফিরি হেথা হোথা।
বৃষ্টি মানেই ষড়ঋতু ঘিরে লাল সবুজের মাঠ
অলস দুপুরে সুজন মাঝির ফেলে আসা খেয়া ঘাট।
বৃষ্টি মানেই নকশী কাঁথার ফোঁড়ে ফোঁড়ে আঁকা ছবি
ফুল ফসলের মৌসুম ঘিরে ছবি আঁকা কোন কবি।
বৃষ্টি মানেই তুমি আর আমি চোখাচোখি নিঝঝুম
ক্লান্তি শেষে চার চোখ জুড়ে শান্তিনগরে ঘুম।
বৃষ্টি মানেই মধুচন্দ্রিমা সিঁদুরে রাঙানো মাছ
জেলে জালের সুতোয় বাঁধা জলকেলির উচ্ছ্বাস
বৃষ্টি মানেই বৃষ্টিতে ভেজা উলঙ্গ আকাশ-ছাতা
দুঃখের স্যুটকেসে ভাঁজ করে রাখা অগোছালো খেড়োকথা।
বৃষ্টি মানেই আকাশামৃত অমিত অমিয় ধারা
সেই সুরা পানে আমরা আশিক নেচে গেয়ে হই সারা।
বৃষ্টি মানেই কুটোর ঘরে ধান শুকোবার ধুম
মজুরবিহীন পিতার শিশু ক্ষুধার্ত নির্ঘুম।
বৃষ্টি মানেই হৃদয়কাব্য লেখা সৃষ্টির পথে
বিভেদ ভুলে আষাঢ় আসে জগন্নাথের রথে।
বৃষ্টি আমার প্রেমিকার নাম আমি শ্রাবণ অঝোর
সারারাত জেগে সৃষ্টি নেশায় কদম কেয়ার প্রহর।
বৃষ্টি মানেই প্রণয়ের চিঠি বিরহের খোলা খামে
বিদেশ বিভুঁই বিষ্ণুপ্রিয়ার নাম লেখা দেহধামে।
বৃষ্টি মানেই বাঁধন ছেড়া উড়োচিঠি আকাশের
সবুজ শেকড়ের নিঃশ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকা বাতাসের।
বৃষ্টি মানেই খিচুড়ি ইলিশ ঝাঁঝালো মিঠেল গন্ধ
শোষকের চাপে শোষিত জীবনে ফ্যাকাসে বেসুরো ছন্দ।
বৃষ্টি মানেই শ্রাবণে প্লাবনে নয় বাঁধা বৈষম্য
মানুষে মানুষে প্রাণের মিতালি আকাশ মাটিতে সাম্য।
বৃষ্টি মনেই অনাবৃষ্টি অতিবৃষ্টির ধ্বনী
হতে পারে কভু অনাসৃষ্টির সুরহীন সিম্ফনি।
বৃষ্টি মানেই আমার মনের উজাড় উদোম ভূমি
তাতা থই থই সৃষ্টিনন্দে নেচে যাও শুধু তুমি।
বৃষ্টি মানেই অমৃতসুধা ধুয়ে যাক সব কালো
জলের ঘষায় জ্বলিয়া উঠুক জীবনের মহাআলো।
আজ এ হৃদয় রাশি রাশি মাটি চায় সে শুধু প্রেম
তাইতো খানিক মেখে নিলাম আ