পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) আজ
দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক : আজ ১২ রবিউল আউয়াল শনিবার (২ ডিসেম্বর), পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)। বিশ্বমানবতার মুক্তির দিশারী রহমাতুল্লিল আ’লামিন সাইয়েদুল মুরসালিন খাতামুন্নাবিয়ীন তাজদারে মদিনা জগত্কুল শিরোমণি সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলা আলিহি ওয়া সাল্লামের জন্ম ও ওফাত দিবস।
দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া পৃথক বাণী দিয়েছেন। বাণীতে তারা শুভেচ্ছা জানান এবং রাসুলের (সা.) আদর্শ নিজেদের জীবনে প্রতিফলন ঘটাতে আল্লাহর কাছে দোয়া করেন।
আজ থেকে এক হাজার ৪৪৭ বছর আগে আইয়্যামে জাহেলিয়তের যুগে ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দের এই দিনে সুবহে সাদেকের সময় আরবের মক্কা নগরীর সম্ভ্রান্ত কুরাইশ বংশে মা আমেনার কোলে জন্মগ্রহণ করেন তিনি।
জন্মের পূর্বেই পিতৃহারা হন এবং জন্মের অল্পকাল পরই বঞ্চিত হন মাতৃস্নেহ থেকে। অনেক দুঃখ-কষ্ট আর অসীম প্রতিকূলতার মধ্যদিয়ে চাচা আবু তালিবের আশ্রয়ে বড় হয়ে ওঠেন। চল্লিশ বছর বয়সে তিনি মহান আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীনের পক্ষ থেকে নবুওয়তের মহান দায়িত্ব লাভ করেন।
অসভ্য বর্বর ও পথহারা মানব জাতিকে সত্যের সংবাদ দিতে তাদের কাছে তুলে ধরেন তাওহীদের বাণী। কিন্তু অসভ্য-বর্বর আরব জাতি দাওয়াত গ্রহণ না করে তার ওপর নিপীড়ন শুরু করে। আল্লাাহর সাহায্যের ওপর ভরসা করে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য জীবন বাজি রেখে সংগ্রাম চালিয়ে যান তিনি।
ধীরে ধীরে সত্যান্বেষী মানুষ তার সাথী হতে থাকে। অন্যদিকে কাফেরদের ষড়যন্ত্রও প্রবল আকার ধারণ করে। একপর্যায়ে তারা রাসুলকে (সা.) হত্যার নীলনকশা প্রণয়ন করে। রাসুল (সা.) আল্লাাহর নির্দেশে জন্মভূমি ত্যাগ করে মদীনায় হিজরত করেন। মদীনায় তিনি ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে আল্লাাহর আইন প্রতিষ্ঠা করেন এবং মদীনা সনদ নামে একটি লিখিত সংবিধান প্রণয়ন করেন। মদীনা সনদ বিশ্বের প্রথম লিখিত সংবিধান হিসাবে খ্যাত। এ সংবিধানে ইহুদী, খ্রিষ্টান, মুসলমানসহ সকলের অধিকার স্বীকৃত হয়। ২৩ বছর অক্লান্ত শ্রম সাধনায় রাসুল (সা.) দ্বীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সফল হন। মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে তা পূর্ণতা লাভ করে।
নিরঙ্কুশ তৌহিদ ও সাম্য-মৈত্রীর শিক্ষা প্রদান শেষে ৬৩ বছর বয়সে ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে ঠিক এ দিনেই তিনি আল্লাহ তায়ালার ডাকে সাড়া দিয়ে মাওলার সান্নিধ্যে গমন করেন।
এ জন্য দিনটি বিশ্বের মুসলমানদের কাছে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। সর্বশেষ ও সর্বশেষ্ঠ নবীর জন্ম ও মৃত্যু একই দিনে হলেও মুসলিমরা দিনটিকে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী সা: বা জন্মোৎসবের দিন হিসেবে পালন করে থাকে।
দিনটি পালনে বাংলাদেশে বিগত বছরগুলোতে সরকারি ছুটি থাকলেও শনিবার হওয়ায় ছুটি ঘোষণার প্রয়োজন হয়নি। তবে স্কুল-কলেজসহ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে দিনটিতে ছুটি পালিত হবে। পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উদযাপনে বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে ধর্ম মন্ত্রণালয়।
সরকারি, আধা-সরকারি ভবন, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি ভবন ও সশস্ত্রবাহিনীর সব স্থাপনায় জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে। জাতীয় পতাকা ও ‘কালিমা তায়্যিবা’ লিখিত ব্যানার ঢাকা মহানগরীর গুরুত্বপূর্ণ ট্রাফিক আইল্যান্ড ও লাইট পোস্টে প্রদর্শন করা হবে।
এ ছাড়া রাতে সরকারি ভবনগুলো ও সামরিক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় আলোকসজ্জা করা হবে। সারা দেশে সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, সশস্ত্রবাহিনী বিভাগ, বেসরকারি সংস্থাগুলোয় হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবন ও কর্মের ওপর আলোচনা সভা ও মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠান হবে।
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে মাসব্যাপী ইসলামি বইমেলার পাশাপাশি পক্ষকালব্যাপী বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হয়েছে। বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতারের পাশাপাশি বেসরকারি টেলিভিশন ও রেডিও দিবসটির যথাযোগ্য গুরুত্ব তুলে ধরে বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করবে। পত্রিকাগুলোয় বিশেষ নিবন্ধ প্রকাশ করা হবে। শিশু একাডেমি শিশুদের জন্য বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে। দেশের সব হাসপাতাল, কারাগার, সরকারি শিশুসদন, বৃদ্ধনিবাস, মাদকাসক্তি নিরাময়কেন্দ্রে উন্নতমানের খাবার পরিবেশন করা হবে। এ ছাড়া বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস ও মিশনগুলোতে যথাযথভাবে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী সা: পালন করা হবে। দেশের মসজিদ-মাদরাসাসহ বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে আলোচনা সভা, মিলাদ মাহফিলসহ বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে। সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে বিশেষ ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হয়েছে।
ঈদে মিলাদুন্নবীর গুরুত্ব ও তাৎপর্য :
ঈদ, মিলাদ আর নবী তিনটি শব্দ যোগে দিবসটির নামকরণ হয়েছে। ঈদ অর্থ আনন্দোৎসব, মিলাদ অর্থ জন্মদিন আর নবী অর্থ ঐশী বার্তাবাহক। তাহলে ঈদে মিলাদুন্নবীর অর্থ দাঁড়ায় নবীর জন্মদিনের আনন্দোৎসব। ১২ রবিউল আউওয়াল একই সাথে মহানবীর জন্ম ও মৃত্যু দিবস হলেও তা শুধু জন্মোৎসব হিসেবেই পালিত হয়। পৃথিবীর যেকোনো মানুষের মৃত্যুই তার পরিবার, সমাজ ও দেশের জন্য বিরাট শূন্যতা সৃষ্টি করে। কিন্তু মহানবীর মৃত্যু মানবসমাজ ও সভ্যতার কোনো পর্যায়ে কোনো শূন্যতার সৃষ্টি করেনি। যদিও তাঁর মৃত্যুর চেয়ে অধিক বেদনাদায়ক কোনো বিষয় উম্মতের জন্য হতে পারে না। তিনি প্রেরিত হয়েছিলেন সমগ্র পৃথিবীর জন্য আল্লাহর রহমত হিসেবে। চল্লিশ বছর বয়সে নবুওয়াত লাভের পর দীর্ঘ ২৩ বছর হজরত মুহাম্মদ (সা.) কঠোর পরিশ্রম ও শত বাধাবিপত্তি মোকাবেলা করে ইসলামের সুমহান আদর্শ প্রচার করে গেছেন। তার প্রতিটি কাজ ও কথা আমাদের জন্য আদর্শ। তার দেখানো পথেই পৃথিবীতে আসতে পারে শান্তি ও মানবতার মুক্তি। এরশাদ হয়েছে, আমি আপনাকে সমগ্র বিশ্বের জন্য রহমত হিসেবে প্রেরণ করেছি। (সূরা আল-আম্বিয়া : ১০৭)
মহান আল্লাহ রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর আদর্শকে জীবনে ধারণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। এরশাদ হয়েছে, ‘হে রাসূল! আপনি বলে দিন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবেসে থাক তাহলে আমাকে অনুসরণ করো, আল্লাহ তায়ালা তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের গুনাহগুলো মা করে দেবেন। আর আল্লাহ পরম মাশীল, অসীম দয়ালু। (সূরা আল-মায়িদা : ৩১) রাসূলুল্লাহ (সা.) চারিত্রিক শ্রেষ্ঠত্বের মাধ্যমেই একটি শ্রেষ্ঠ জাতি গঠন করেছিলেন। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, নিশ্চয়ই আমি সর্বোত্তম চরিত্রের পূর্ণাঙ্গতা সাধনের জন্য প্রেরিত হয়েছি। (ইবনে মাজা) রাসূলুল্লাহ (সা.) এর আদর্শ ধারণ করেই সাহাবায়ে কেরাম (রা.) যুগের সর্বোত্তম মানুষ হতে পেরেছিলেন। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, সর্বোত্তম মানুষ হলো আমার যুগের মানুষ, অতঃপর তাদের পরবর্তী যুগের মানুষ, তারপর তাদের পরবর্তী যুগের মানুষ। (সহীহ বোখারি)
এ জন্য রাসূল (সা.) সুন্নাতকে আমাদের জীবনে ধারণের লক্ষ্যে বেশি বেশি করে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর জীবনী পড়া উচিত। তবে শুধু রবিউল আউয়াল মাসেই রাসূল (সা.) এর ভালোবাসাকে সীমিত না রেখে বছরের প্রতিটি দিনে, প্রতিণে, প্রতি মাসে মোটকথা জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর সুন্নাতের অনুসরণের মাধ্যমে তাঁর রেখে যাওয়া জীবনাদর্শকে বাস্তবায়ন করা আমাদের দায়িত্ব। আসুন আমরা সবাই এ দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে নিজেদের ইহকালীন ও পরকালীন জীবনকে সমৃদ্ধ করি।
(দ্য রিপোর্ট/এনটি/ডিসেম্বর ০২, ২০১৭)