দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক : কবি ও প্রাবন্ধিক ফরহাদ মজহার বলেছেন, সাদাপোশাকের কিছু লোক র‍্যাবের কাছ থেকে আমাকে ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। অপহরণকারীরা আমাকে খুলনা-যশোর সীমান্তের দিক দিয়ে সীমান্তের ওপারে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। আর জিজ্ঞাসাবাদের নামে বলতে বাধ্য করা হয় যে, আমি বিনোদনের জন্য বেরিয়েছি।

শনিবার (৯ ডিসেম্বর) রাজধানীর শ্যামলীতে নিজ বাসায় এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন।

ফরহাদ মজহার বলেন, ওষুধ কেনার জন্য নিচে নেমে অপহরণের শিকার হই। তিনজন লোক আমাকে ঘিরে একটি সাদা মাইক্রোবাসে জোর করে তুলেই আমার চোখ বন্ধ বেঁধে ফেলে। সে সময় আমি আমার স্ত্রীকে ফোন করতে পারি। এরপর বাঁচার জন্য টেলিফোন করা, টাকা পাঠানোসহ যা কিছু অপহরণকারীরা করতে বলে, তা–ই আমি করি।

তিনি বলেন, যেখানে তারা ছেড়ে দেয়, তা আমি চিনি না। আমি বুঝতে পারি তারা আমার ওপর নজরদারি করছে। তাদের নির্দেশমতো সন্ধ্যায় হানিফ পরিবহনের গাড়িতে উঠলে গাড়িতে তারা আমাকে বাসের পেছনে বসিয়ে দেয়। আমি মৃত্যুভয়ে ভীত হয়ে পড়ি। শোরগোল শুনে জেগে উঠি। এরপর সাদাপোশাকের কিছু লোক জোর করে আমাকে আবার নামিয়ে আনার চেষ্টা করে।

ফরহাদ মজহার দাবি করেন, সাদাপোশাকের কিছু লোক র‍্যাবের দিকে বন্দুক তুলে শাসিয়ে আমাকে ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে প্রচণ্ড তর্কাতর্কি হয়। তবে র‍্যাব রীতিমতো ছোটখাটো যুদ্ধক্ষেত্রের মধ্য দিয়ে আমাকে তাদের গাড়িতে ওঠায়। কিন্তু সাদাপোশাকের লোকগুলো র‍্যাবের গাড়ি থেকে আমাকে নামানোর চেষ্টা করে।

এই কবি ও প্রাবন্ধিক বলেন, অপহরণকারীরা তখনো এলাকায় থাকতে পারে ভেবে র‍্যাব তাকে খুলনায় নিয়ে চিকিৎসা-বিশ্রামের পাশাপাশি তদন্ত করতে চেয়েছিল। কিন্তু কে বা কারা র‍্যাবের গাড়ির দুই দিকের রাস্তায় ট্রাক থামিয়ে পথরোধ করে রেখেছিল। পরে র‍্যাবের গাড়িসহ তাকে এক জায়গায় নিয়ে বলা হয় সেটি অভয়নগর থানা।

তিনি বলেন, আমি ভিকটিম হওয়া সত্ত্বেও আমাকে জোর করে র‍্যাবের গাড়ি থেকে নামানো হয়। আমার সঙ্গে প্রচণ্ড দুর্ব্যবহার করে। জিজ্ঞাসাবাদের নামে বলতে বাধ্য করা হয় যে, আমি বিনোদনের জন্য বেরিয়েছি। একটি গাড়িতে আমাকে নিয়ে উচ্চ স্বরে গান গাইতে গাইতে পুলিশ ঢাকার দিকে রওনা হয়।

ফরহাদ মজহার বলেন, আমি জীবিত ফিরে আসায় আমাকে সামাজিকভাবে হেনস্তা করে মুখ বন্ধ করার চেষ্টা হচ্ছে। আমি সারা জীবন মানবাধিকার নিয়ে কাজ করেছি। বাংলাদেশে গুমের এ সংস্কৃতি বন্ধ করতে হলে, সব মান-অপমান সহ্য করে হলেও বাংলাদেশে এযাবৎ গুম হয়ে যাওয়া মানুষ যেন তাদের পরিবারের কাছে ফিরে আসতে পারে, সে ক্ষেত্রে আমাদের সবাইকে কাজ করতে হবে।

তিনি উল্লেখ করেন, গত ১৮ জুলাই ডিবি তাদের অফিসে ডেকে নেয়। সুষ্ঠু তদন্তের পরিবর্তে পুলিশের প্রতিবেদনে সায় না দিলে সামাজিকভাবে আরও লাঞ্ছিত করা ও মামলা করার হুমকি দেয়। এরপর থেকে চরম নিরাপত্তাহীনতায় আছেন।

আদালতে দেওয়া নিজের ১৬৪ ধারার জবানবন্দি প্রসঙ্গে লিখিত বক্তব্যে ফরহাদ মজহার বলেন, শারীরিক ও মানসিকভাবে বিধ্বস্ত অবস্থায় আমাকে ঢাকার আদাবর থানায় নিয়ে আসা হয়। প্রতিশ্রুতি দিয়েও আমাকে আমার পরিবারের কাছে যেতে দেওয়া হয় না। পরে ডিবি অফিসে নেওয়া হয়। ডিবি অফিসে হতভম্ব, ক্লান্ত ও বিধ্বস্ত অবস্থায় আমাকে জেরা ও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেওয়ার জন্য একটি লিখিত কপি দিয়ে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে পাঠানো হয়। আমি আদালতকে প্রচণ্ড বিভ্রান্ত অবস্থায় এইটুকু শুধু বলতে পারি যে, আমার শারীরিক ও মানসিক অবস্থায় অত্যন্ত নাজুক। আমার ভীতি ও ট্রমা এখনো কাটেনি। ডিবি অফিস আমাকে দিয়ে যা লিখিয়ে নিয়েছে আমি তাই আপনাকে দিচ্ছি। এরপর তার (বিচারকের) অনুমতি নিয়ে তার কক্ষের একটি সোফায় এলিয়ে পড়ি।

গত ৩ জুলাই ভোরে শ্যামলীর রিং রোডের ১নং হক গার্ডেনের বাসা থেকে বের হওয়ার পর নিখোঁজ হন ফরহাদ মজহার। পরে স্ত্রীকে নিজের মোবাইল ফোনে জানান, কে বা কারা তাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। তাকে মেরেও ফেলা হতে পারে। সন্ধ্যা পর্যন্ত ছয়বার ফোন করে ৩৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়। নিখোঁজ হওয়ার সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাৎক্ষণিক উদ্যোগ নিয়ে মোবাইল ফোন ট্র্যাকিং করে তার অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হয়। প্রায় ১৯ ঘণ্টা পর যশোরের অভয়নগরে হানিফ পরিবহনের বাস থেকে তাকে উদ্ধার করে পুলিশ।

ফরহাদ মজহারের নিখোঁজের ঘটনায় ওইদিন রাতেই স্ত্রী ফরিদা আক্তার বাদী হয়ে আদাবর থানায় একটি জিডি করেন। পরে অপহরণ মামলা দায়ের করেন। এ ঘটনায় ফরহাদ মজহারের স্ত্রী ফরিদা আক্তারের করা মামলার তদন্ত শেষে চূড়ান্ত রিপোর্ট দিয়ে পুলিশ বলেছে, ফরহাদ মজহারকে অপহরণের প্রমাণ পাননি তারা। পাশাপাশি মিথ্যা মামলা দায়েরের অভিযোগে মজহার ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে পাল্টা মামলা করার অনুমতি চাওয়া হয়। গত বৃহস্পতিবার তাদের ওই প্রতিবেদন গ্রহণ করে মামলা করার অনুমতি দিয়েছে আদালত।

(দ্য রিপোর্ট/এনটি/ডিসেম্বর ০৯, ২০১৭)