চার বছর মর্গে থাকা লাইজুর লাশ মুসলিম রীতিতেই দাফন
দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক: হিন্দু না মুসলিম, কোন রীতিতে হোসনে আরা লাইজুর (নীপা রানী রায়) লাশ দাফন হবে তা নিয়ে টানা চার বছর আদালতে লড়াই শেষ হলো আজ বৃহস্পতিবার (১২ এপ্রিল)। আইনী এই লড়াই শেষে দীর্ঘ এই চার বছর রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে থাকা নীলফামারীর লাইজুর লাশ ইসলামিক রীতি অনুযায়ী দাফনের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
জীবিত কালেই লাইজু হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলিম হওয়ায় এই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে এই আদেশ লিখিত আকারে হাতে পাওয়ার তিন দিনের মধ্যে একজন ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশের সহযোগিতায় তা বাস্তবায়ন করতে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসনের প্রতি নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। হোসনে আরা লাইজুকে দাফনের আগে তাকে পরিবারকে দেখার সুযোগ দিতে বলা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (১২ এপ্রিল) এক আবেদনের চূড়ান্ত নিষ্পত্তি শেষে বিচারপতি মো. মিফতাহ উদ্দিন চৌধুরীর একক হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন। আদালতে মেয়ের বাবার পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট সমীর মজুমদার। অন্যদিকে ছেলের বাবার পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট এ কে এম বদরুদ্দোজা।
নীপা রানী রায় ধর্মান্তরিত হয়ে হন হোসনে আরা লাইজু
মামলার বিবরণ অনুসারে, নীলফামারীর ডোমার উপজেলার বামুনিয়া ইউনিয়নের খামার বামুনিয়া গ্রামের অক্ষয় কুমার রায় মাস্টারের মেয়ে নীপা রানী রায়ের (২০) সঙ্গে একই উপজেলার পূর্ব বোড়াগাড়ী গ্রামের জহুরুল ইসলামের ছেলে হুমায়ুন ফরিদ লাজুর (২৩) প্রেমের সম্পর্ক ছিল। তারা ২০১৩ সালের ২৫ অক্টোবর পালিয়ে যান। এরপর নীপা রানী রায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তিনি মোছাঃ হোসনে আরা বেগম লাইজু নাম ধারণ করেন। নীলফামারী নোটারি পাবলিক ক্লাবের মাধ্যমে অ্যাভিডেভিটে দুই লাখ ১ হাজার ৫০১ টাকা দেনমোহরে হুমায়ুন ফরিদ লাজুকে বিয়ে করে। এরপর তারা স্বামী-স্ত্রী হিসেবে বসবাস করে আসছিলেন। এ অবস্থায় মেয়েটির বাবা অক্ষয় কুমার রায় ২০১৩ সালের ২৮ অক্টোবর বাদী হয়ে নীলফামারী নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালতে একটি অপহরণ মামলা দায়ের করে। মামলার পর তারা স্বামী-স্ত্রীর পরিচয়ের সব কাগজপত্রসহ আদালতে হাজির হয়ে জবানবন্দি দেন। পরে আদালত সার্বিক বিবেচনায় অপহরণ মামলাটি খারিজ করে দেন।
মেয়ের বাবা মামলার খারিজ আপিলে তার মেয়েকে অপ্রাপ্তবয়স্ক ও মস্তিস্ক বিকৃতি রয়েছে (পাগল) দাবি করে আদালতে কাগজপত্র দাখিল করে। আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে মেয়েটির শারীরিক পরীক্ষার জন্য রাজশাহী সেফ হোমে পাঠিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন। লাইজু সেফ হোমেই অবস্থান করছিলেন।
পরে ২০১৪ সালের ১৫ জানুয়ারি লাইজুর স্বামী হুমায়ূন ফরিদ ওরফে লাজু ইসলাম বিষপান করে আত্নহত্যা করেন। লাজুর আত্নহত্যার বিষয়টি আদালতে উপস্থাপন করে লাইজুর বাবা তাকে নিজের জিম্মায় নিতে আদালতে আবেদন করেন। আদালত তা মঞ্জুর করলে ২০১৪ সালের ১৬ জানুয়ারি মেয়েকে নিয়ে বাবা তার বাড়িতে চলে যান। তবে মেয়েকে অপ্রাপ্তবয়স্ক ও মস্তিস্ক বিকৃতি (পাগল) দাবি করে আদালতে দায়ের করা মামলাটি চলমান থেকে যায়।
২০১৪ সালের ১০ মার্চ দুপুরে বাবার বাড়িতে নিজের শোয়ার ঘরে সবার অগোচরে কীটনাশক পান করেন লাইজু। পরে তাকে ডোমার উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ভর্তি করা হলে সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঘটনার তিনি মারা যান। ডোমার থানা পুলিশ হাসপাতাল থেকে মেয়েটির লাশ রাতেই উদ্ধার করে। পরের দিন (১১মার্চ) নীলফামারী জেলার মর্গে মেয়েটির লাশ ময়না তদন্ত করা হয়। ওইদিন পুত্রবধূ দাবি করে লাজুর বাবা জহুরুল ইসলাম ইসলামী শরিয়ত মোতাবেক লাইজুর দাফনের আবেদন করেন। তবে মেয়েটির বাবা অক্ষয় কুমার রায় হিন্দু শাস্ত্র অনুসারে মেয়ের সৎকারের জন্য নীলফামারী জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আবেদন করেন। আদালতে উভয়পক্ষের শুনানি নিয়ে লাইজুর লাশ তার শ্বশুরের কাছে হস্তান্তরের নির্দেশ দেন। ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের এই আদেশের বিরুদ্ধে লাইজুর বাবা আপিল করেন। এরপর জজ আদালত লাইজুর লাশ তার বাবার কাছেই হস্তান্তরের নির্দেশ দেন। কিন্তু সেই আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আবেদন করেন তার শ্বশুর। বৃহস্পতিবার সেই আবেদনের নিষ্পত্তি করে আদালত আদেশ দেন।
বিষয়টি নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত লাইজুর মরদেহ রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের হিমঘরেই থেকে যায়।
দীর্ঘ চার বছর পর এবার তার লাশ হিমঘর থেকে কবরে নেওয়া হবে।
দ্য রিপোর্ট/ টিআইএম/১২ এপ্রিল,২০১৮