তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের খোয়াব দেখবেন না!
সিরিয়া ইস্যুতে পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোর শিরোনাম দিনকে দিন পাল্টে গেছে। আজকে ১৫ এপ্রিল বিবিসি বাংলার একটি শিরোনাম ছিল ‘পশ্চিমা সামরিক আক্রমণ কি সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আসাদকে দমাতে পারবে’? এক সময় আমেরিকা-ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক মিডিয়াগুলো প্রশ্ন তুলত, ‘পশ্চিমারা কি আসাদকে হটাতে পারবে?’। এভাবে এখন আর শিরোনামই হয়না,কারন পরিস্থিতি পাল্টেছে। দুর্বল হওয়ার পরিবর্তে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের ভিত্তি আরো শক্ত হয়েছে। ইরান আর রাশিয়া যেকোন মূল্যে আসাদের পতন ঠেকাতে চেয়েছিল,তাতে তারা সফলও হয়েছে। কংকালময় কিছু শহর নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ভুতুড়ে রাষ্ট্র সিরিয়ার বেশিরভাগ এলাকা এখন আসাদেরই নিয়ন্ত্রণে। অথচ প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দায়িত্বে থাকা ভগ্নিপতির মৃত্যুর পর ধরেই নেওয়া হয়েছিল আসাদের বুঝি পতন হতে চলল!
কিন্তু প্রশ্নটা হলো সিরিয়ায় মিশন অর্জিত হওয়ার ঘোষণা দিয়েও আবার কেন সেখানে ঝাঁকে ঝাঁকে টোমাহক ক্রুজ মিসাইল ছুড়ে মারা হলো? অনেকে তাতে তৃতীয় বিশযুদ্ধের আলামতও দেখছেন! আমাকে কিন্তু সেরকম কিছু ভাবতে প্রলুব্ধ করেনা। আসল ঘটনা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র’সহ পশ্চিমারা আরব বসন্তের সুযোগ নিয়ে সেখানে একটি অন্যায় যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিল,নিজেদের প্রভাবিত গণমাধ্যমগুলোতে যুদ্ধের বৈধতা প্রতিষ্ঠার পক্ষে ইরাক যুদ্ধের মতই প্রপাগান্ডা চালাচ্ছিল; কিন্তু রাশিয়া আর ইরানের হস্তক্ষেপে তাদের ব্যাকফুটে যেতে হয়েছে। এখন তারা সিরিয়া থেকে সম্মানজনক প্রস্থানের অপেক্ষায় রয়েছে। নতুন এই মিসাইল হামলা তারই অংশ বৈকি! সেকারনেই কি সিরিয়ার বেসামরিক মানুষের উপর রাসায়নিক হামলার পাল্টা জবাবে পশ্চিমারা সিরিয়ায় মিসাইলগুলো ছুড়েছে? পশ্চিমারা ভাবছে, এতে তাদের ইমেজ বেড়েছে,বোঝানোর চেষ্টা হয়েছে আমরা নিরীহ সিরীয়দের সাথেই আছি। উদ্দেশ্যে অন্য হলে তো আসাদের সবকটি সামরিক ব্যারাকের দিকে ঝাঁকে ঝাঁকে মিসাইল ছুটে যাওয়ার কথা। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র,বৃটেন ও ফ্রান্স থেমে গেছে। ট্রাম্পও বলেছেন ’মিশন সম্পন্ন হয়েছে’।
যুক্তরাষ্ট্র আগেও বলেছে, তাদের লক্ষ্য বাশার আল-আসাদ যাতে আবারও রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার না করেন। সেজন্যে এই আক্রমণের মাধ্যমে তাকে একটি বার্তা দেওয়া হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমারা দুটি মিশন নিয়ে কাজ করেন ,প্রথমত ইসরায়েলকে সুরক্ষা দেওয়া আর দ্বিতীয় লক্ষ্যটি হলো আরব বিশ্বের তেলভান্ডারের উপর পশ্চিমা কোম্পানিগুলোর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠাতা। সাদ্দাম,গাদ্দাফি এবং সবশেষ বাশারকে টার্গেট করার কারন এতেই নিহিত,আরব সাধারণের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা কিংবা তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার যেসব কথা-বার্তা হয় সেগুলো ঢাহা মিথ্যা, স্রেফ প্রপাগান্ডা। আরো হাস্যকর বিষয় হলো,হিটলারের প্রচারমন্ত্রী গোয়েবলসকে নিয়ে এত এত আলোচনা হয়,সমালোচনা হয়,অথচ উড্রো উইলসনের প্রচার সেল নিয়ে পশ্চিমাদের কোনও মাতামাতি নেই। ‘যুদ্ধ নয়,শান্তি চাই’,এমন মন্ত্র জপতে জপতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে প্রেসিডেন্ট হলেন উইলসন। এরপর কিছু বিতর্কিত ব্যক্তিকে সাথে নিয়ে গড়ে তোলেন প্রপাগান্ড সেল,জার্মানদের খাটো করার চিন্তা-ভাবনা করতে করতে পরিস্থিতি বিষিয়ে তুললেন। অথচ তার বহুবছর পর ক্ষমতায় আসা হিটলারের প্রপাগান্ডা সেল নিয়ে এত কথা,এত আলোচনা।
ফিরছি আবারো সিরিয়ায়। অনেকে রাশিয়ার হুমকি নিয়ে শংকায় পড়েছিলেন। রাশিয়া যদি পাল্টা হামলা চালায় তাহলে কি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাঁধবে? কিন্তু কী দেখা গেলো? রাশিয়া নিশ্চুপ থেকেছে। চলুন একটু অন্যরকম চিন্তা করি, আসলেই কি রাশিয়া একরাতের এ যুদ্ধে খেলোয়াড় ছিল না? এস-ওয়ান টুয়েন্টি ফাইভ আর এস-টু হানড্রেড নামের যেসব অ্যান্টি ব্যালিস্টিক মিসাইল দিয়ে কয়েক ডজন টোমাহককে সিরিয়া আকাশেই শেষ করে দিলো,সেগুলো তো রাশিয়ারই সরবরাহ করা। আর এসব দেওয়া হয়েছিল আরব বসন্তের পর। এদিকে, তিন শক্তির হামলার পর রাশিয়া সিরিয়াকে এস-থ্রি হানড্রেডও দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। পুতিন এখানেই সবচেয়ে কৌশলী ভ’মিকা নিয়েছেন। তিনি সিরিয়ার রণাঙ্গনে এখনো পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে প্রক্সি খেলোয়াড় হিসেবেই আছেন। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো তুরস্ক আর ইসরায়েল হামলার ক্ষণ জানত,মার্কিন সামরিক কমান্ড আগেই তাদের জানিয়েছিল। এছাড়া, যেসব স্থাপনায় হামলা চালানো হয়েছিল সেগুলোকে আগেই খালি করে ফেলেছিল সিরিয়ার সরকার। কারন রাশিয়া আগেই বাশারকে সতর্ক করেছিল। যুক্তরাষ্ট্র ফলাও করে প্রচার করল ‘আমরা রাশিয়াকে হামলার বিষয়ে কিছুই জানাইনি’। তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়ালো,রাশিয়া জানত না অথচ সিরিয়া সরকার রুশদের পরামর্শে আগেই লোকজন সরিয়ে ফেলল?
তুরস্ক পশ্চিমা হামলাকে ম্বাগত জানিয়েছে,এতে অনেকেই বিস্মিত হয়েছেন। তুরস্ক বাশারকে সমর্থন করেনা বা সেখানে রেজিম পরিবর্তন চায় এটা তো পুরনো কথা। আসলে সিরিয়ার পরিস্থিতি এতটাই জটিল হয়ে পড়েছে যে আসাদের পতন হলে স্থানীয় পক্ষগুলোর মধ্যে তুরস্কেরই লাভ বেশি। কারণ এতে ব্রাদারহুড প্রভাবিত ফ্রি সিরিয়ান আর্মি সবচেয়ে বড় শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হবে। ইসরায়েলেরও লাভ আছে এখানে। অন্তত একটা প্রকাশ্য শত্রু তো কমবে। সিরিয়া হয়ে ইরানি রসদ আর হিজবুল্লার কাছে পৌঁছবে না। ডানা ছেটে দেওয়া যাবে হামাসেরও।