দ্য রিপোর্ট ডেস্ক : মহান মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর ও নৌ-চ্যানেলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পুঁতে রাখা মাইন অপসারনে রুশ নৌ-সেনাদের ভূমিকা নিয়ে আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রামাণ্যচিত্র ও আলোকচিত্রের অ্যালবাম প্রকাশ করেছে মুক্তিযুদ্ধ একাডেমি।

বুধবার (৯ মে) জাতীয় প্রেসক্লাব কনফারেন্স হলে প্রামাণ্যচিত্রের প্রিমিয়ার এবং আলোকচিত্রের অ্যালবামটি উদ্বোধন করেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশারফ হোসেন।

এ সময় বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের পরিচালক আলহাজ্জ মোঃ হারুন-অর-রশীদ খান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ হাবিবুর রহমান এবং উপব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী তউহীদ উল আলম।

এ সময় অন্যান্যের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ একাডেমির চেয়ারম্যান ড. আবুল আজাদ, ঢাকাস্থ রুশ বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি কেন্দ্রের পরিচালক আলেকজান্ডার পি. দামিন, ব্যাংকের কর্মকর্তাবৃন্দ এবং প্রামাণ্যচিত্রের পরিচালক সাংবাদিক ইব্রাহীম আজাদ সহ অন্যান্য অতিথি ও সাংবাদিকবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় চট্টগ্রাম বন্দর ও কর্নফুলী নদীতে পাকিস্তানি বাহিনী কর্ণফুলী নদী ও চট্টগ্রাম বন্দরের জলসীমানায় অসংখ্য মাইন পুঁতে রেখেছিল। তাছাড়া যুদ্ধের সময় অনেক নৌযান ডুবে যাওয়ায় দেশের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত এ বন্দরটি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে উঠেছিল।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়ন যেমন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নানাভাবে সহায়তা করেছে তেমনি একটি স্বাধীন কিন্তু যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনৈতিকভাবে পর্যুদস্ত একটি দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নেও যথাসাধ্য সহায়তা করেছে। আর তাই স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে সোভিয়েত ইউনিয়ন বেশ কয়েকটি শিল্প-কারখানা তৈরি করে দিয়েছিল, যা এখনো বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অবদান রেখে চলেছে।

১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি বাংলাদেশ ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। ফেব্রুয়ারি ১৯৭২-এ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সোভিয়েত সরকারের কাছে সহযোগিতা চেয়ে বার্তা পাঠান। তখন বিশ্বে স্যাটেলাইট ছিল দুটি দেশের। আমেরিকা ও রাশিয়ার।

রাশিয়া স্যাটেলাইট রিপোর্টে জানায়, বঙ্গোপসাগরে মাইন পুতে রাখা হয়েছে। এর পরই মার্চ ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু মস্কো সফর করেন। এই সফরের প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধু চট্টগ্রাম বন্দরের প্রবেশদ্বারে কর্ণফুলী নদীর মোহনায় মাইন অপসারণ ও ডুবে যাওয়া জাহাজ অপসারণে সোভিয়েত ইউনিয়নের সহযোগিতা চান।

সোভিয়েত সরকার বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে সাড়া দিয়ে ২২ মার্চ, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকারের সাথে একটি চুক্তি করেন যাতে নিঃশর্তভাবে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করার কথা উল্লেখ করা হয়। ১৯৭২ সালের ২ এপ্রিল প্রথম সোভিয়েত জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে প্রবেশ করে। বন্দরের অবস্থা ছিল অত্যন্ত শোচনীয়। কর্ণফুলী নদীর তলদেশে ৪০টিরও বেশি জাহাজ ডুবেছিল। ১৮টি জেটির মধ্যে ১২টিই ছিল ধ্বংসপ্রাপ্ত। ৩৭টি যুদ্ধ জাহাজের সোভিয়েত নৌবাহিনীর সদস্যরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব সফলতার সঙ্গে সম্পন্ন করেন, যদিও আবহাওয়া, পরিবেশ সবই ছিল তাদের জন্য বিরূপ ও নতুন।

২ এপ্রিল, ১৯৭২ থেকে একটানা ২৪ জুন, ১৯৭৪ পর্যন্ত চলে সোভিয়েত নৌবাহিনীর এই অভিযান, যার ফলে চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগ স্থাপিত হয় এবং বাংলাদেশের অর্থনীতি দ্রুত নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সুযোগ সৃষ্টি হয়, খাদ্যশষ্য আমদানি করা সম্ভব হয়, ত্রাণ সামগ্রী এসে পৌঁছাতে পারে, যা যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশের জন্য ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তারা ৪০টির বেশী ডুবন্ত জাহাজ উদ্ধার করে। একশো হাজার টন পলি, এক হাজার ৯শ’ টন স্ক্রেপ, অপসারণ করে। চট্টগ্রাম বন্দরের এক হাজার ২ স্কোয়ার মাইল জলসীমায় মাইন মুক্ত করণের কাজ করে।

ঝুকিপূর্ণ এই কাজ করতে গিয়ে ১৯৭৩ সালের ১৩ জুলাই ভিক্টোরোভিচ রেডকিন নামে এক সোভিয়েত নাবিক মারা যায়। তাকে পতেঙ্গায় নেভাল একাডেমীর ভেতরে নদীর মোহনায় সমাহিত করা হয়। এটি রেডকিন পয়েন্ট নামে পরিচিত। তবে এই অভিযোনে ঠিক কত জন সোভিয়েত নাবিক মারা যায় তার কোন সঠিক ইতিহাস বা দলিল খুঁজে পাওয়া যায়নি। সামরিক ভাষায় একটা কথা স্পষ্ট করে বলা হয়, কোন যুদ্ধ বা উদ্ধার অভিযানে কোন সেনা বা নাবিকের মৃতদেহ খুজে পাওয়া না গেলে তাকে ‘মিসিং’ বলে অভিহিত করা হয়।

সম্প্রতি বাংলাদেশে আসেন মস্কো স্টেট ইউনিভারসিটির অধ্যাপক ইরিনা। তিনি বঙ্গবন্ধুর দোভাষী হিসেবে কাজ করেন ১৯৭২ সালে মস্কো সফরের সময় । তিনি বলেছেন, ১৯৭৪ সালেও তিনি বঙ্গবন্ধুর আমন্ত্রণে এদেশে এসেছিলেন। তখন তাকে উদ্ধার অভিযান প্রত্যক্ষ করার জন্য এডমিরাল জোয়ানকো হেলিকপ্টারে করে চট্টগ্রামে নিয়ে যান । তখন জোয়ানকো তাকে বলেছিলেন ১৯ জন সোভিয়েত নাবিক মারা যান।

(দ্য রিপোর্ট/এনটি/মে ১১, ২০১৮)