গাজী মোঃ মাহবুব মুর্শিদ

(পূর্ব প্রকাশের পর)

নজরুলের সৈনিক জীবন নিয়ে চুলচেরা গবেষণা-লব্ধ গ্রন্থ ‘সৈনিক নজরুল’ -এর প্রণেতা মুহাম্মদ লুৎফুল হক নজরুলের পল্টনে যোগ দেওয়ার কার্যকারণ অনুসন্ধান শেষে যে সিদ্ধান্তে উপনীত হন, আমরা সে বিষয়ে সহমত পোষণ করি :

নজরুলের সৈনিক-জীবন বরণ করার পেছনে তার ব্যর্থ প্রেমের বিষয়টি অন্যতম কারণ হতে পারে, তবে দেশপ্রেম ও সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততা এর চেয়েও অধিক গ্রহণযোগ্য কারণ বলে মনে হয়। ... দেশপ্রেম বা বিপ্লববাদে উদ্বুদ্ধ হয়েই নজরুল যুদ্ধবিদ্যা শিক্ষা এবং সৈনিকদের মধ্যে সন্ত্রাসবাদ প্রচারের জন্য আরও কিছু বিপ্লবীর মতো পরিকল্পিতভাবেই সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। (লুৎফুল ২০১৩  : ২৬-২৭)

৫.

কাজী নজরুল ইসলাম সম্ভবত তাঁর সৈনিক-জীবনের পুরোটাই করাচির বাঙালি পল্টনে অতিবাহিত করেন। নজরুল যুদ্ধের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছিলেন তবে সম্মুখ সমরে তাঁকে শত্রুর মুখোমুথি হতে হয়নি। নজরুলের প্রথম পর্বের গল্পগুলো পড়লে পাঠকের মনে হতে পারে, যুদ্ধের ময়দানের এক যোদ্ধার অভিজ্ঞতা এখানে শিল্পিত ভাষ্যে রূপায়িত হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে নিজের প্রশিক্ষণ, সহযোদ্ধাদের অভিজ্ঞতা আর সৃষ্টিশীল কল্পনার মিশ্রণে ব্যথার দান ও রিক্তের বেদনের এই গল্পগুলো অকৃত্রিম রূপে মূর্ত হয়ে উঠেছে।

‘সৈনিক-জীবনের আগে নজরুল একটু আধটু লেখালেখি করলেও প্রকৃত অর্থে সৈনিক-জীবনেই তার শুভারম্ভ হয়।’ (লুৎফুল ২০১৩ : ৬৩) নজরুল নানাভাবে বইপত্র যোগাড় করে ‘স্কুলের গণ্ডীর বাইরে তাঁর স্বাধীন পঠনপাঠন’ অব্যহত রাখেন। সওগাতসহ কলকাতার বিভিন্ন পত্রপত্রিকার তিনি নিয়মিত গ্রাহক ছিলেন। বাল্যকালে নজরুলের ফারসি ভাষার সঙ্গে যৎসামান্য পরিচয় ঘটলেও পল্টন-জীবনেই তিনি ভাষাটিকে আত্মস্থ করেন। এ বিষয়ে নজরুল ইসলাম তাঁর অনূদিত রূবাইয়াৎ-ই-হাফিজ-এর ভূমিকায় বলেন :

আমি তখন স্কুল পালিয়ে যুদ্ধে গেছি। সে আজ ইংরেজি ১৯১৭ সালের কথা। সেইখানে প্রথম আমার হাফিজের সাথে পরিচয় হয়।

আমাদের বাঙালি পল্টনে একজন পাঞ্জাবি মৌলভী সাহেব থাকতেন। একদিন তিনি দীওয়ান-ই-হাফিজ থেকে কতকগুলি কবিতা আবৃত্তি করে শোনান। শুনে আমি এমনি মুগ্ধ হয়ে যাই, যে, সেইদিন থেকেই তাঁর কাছে ফার্সি ভাষা শিখতে আরম্ভ করি।

তাঁরই কাছে ক্রমে ফার্সি কবিদের প্রায় সমস্ত বিখ্যাত কাব্যই পড়ে ফেলি। (নজরুল-রচনাবলী চতুর্থ : ১২৭)

নজরুলের ছোটগল্পেও তাঁর ফারসি-প্রীতির পরিচয় মেলে। রিক্তের বেদন -এর ‘সালেক’ গল্পটি কবি হাফিজকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। সালেক (আরবি সালিক) অর্থ সাধনপথের পথিক বা সুফি সাধক। শহরে আবির্ভূত অচেনা দরবেশের দীক্ষা নিতে যেয়ে সম্মানিত কাজী সাহেব তাঁর অর্থ-কড়ি, পদ-পদবি, মান-সম্মান হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েন। সর্বস্বান্ত হয়ে কাজি যখন দরবেশের অন্বেষণে যান তখন ‘‘কার শান্ত-শীতল ক্রোড় তাঁকে জানিয়ে দিলে, ‘এই যে বাপ ! এস ! এখন তোমার মলিন বস্ত্র আর মলিন অহঙ্কার সব চোখের জলে ধুয়ে সাফ হয়ে গেছে।’’ (ন. র. ২ : ২৮৪) এরপর নদীতীরে দরবেশের খোঁজে গিয়ে কাজি সাহেব হাহাকার করে উঠলেন :

‘কে ? ওগো পথের সাথী ! তুমি কে ?

অনেকক্ষণ কিছু শোনা গেল না। নদীর নিস্তব্ধ তীরে তীরে দুলে গেল আর্ত-গম্ভীর প্রতিধ্বনি, ‘তু-মি -কে ?’

খেয়া পার হতে খুব মৃদু একটা আওয়াজ কাঁপতে কাঁপতে কয়ে গেল, মাতাল হাফিজ ! (ন. র. ২ : ২৮৪)

সুফিপন্থি আধ্যাত্মিকতার রসে জারিত নজরুলের ‘সালেক’ গল্পটি তুলনামূলক অনেক পরিণত, শিল্পগুণসমৃদ্ধ।

করাচি সেনানিবাস থেকে ‘সওগাতে’ নজরুল ইসলামের ‘বাউন্ডেলের আত্মকাহিনী’ ছাপা হওয়ার পরে তাঁকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। কয়েকটা কবিতা লিখলেও এ পর্যায়ে গল্পই ছিল তাঁর মূল চারণভূমি। নজরুলের ঘনিষ্ঠ বন্ধু শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় তাঁর স্মৃতিকথা ‘কেউ ভোলে না কেউ ভোলে’ গ্রন্থে এ-প্রসঙ্গে জানাচ্ছেন :

‘দেখলাম, নজরুলের চিঠি এসেছে। আমার পাশের খবর পেয়ে আনন্দিত হয়ে লিখেছে, ‘তোমাকেও একটা আনন্দের খবর দিই। এখান থেকে কলকাতার কয়েকটা কাগজে গল্প পাঠিয়েছিলাম। একটাও ফিরে আসেনি। সব ছাপা হয়ে গেছে। 49th Regiment-এর একজন বাঙালি সৈনিক করাচি ক্যান্টনমেন্ট থেকে লেখা পাঠাচ্ছে দেখে বোধহয় ভয়েই ছেপে ফেলেছে। এন্তার লিখছি এখানে বসে বসে।’ (শৈলজানন্দ ২০০৮ : ১৯৯-২০০)

ব্যথার দান ও রিক্তের বেদনের প্রায় সব গল্পই উত্তমপুরুষে বর্ণিত এবং আত্মকথনের ঢঙে উপস্থাপিত। ব্যতিক্রম - ‘সালেক’ ও ‘দুরন্ত পথিক’। ‘সালেক’ গল্পটির যৎসামান্য আলোচনা আমরা ইতোমধ্যে করার চেষ্টা করেছি। অন্যদিকে ‘দুরন্ত পথিক’ গল্প হিসেবে গ্রন্থভুক্ত হলেও নজরুল নিজে এটিকে কথিকারূপে চিহ্নিত করেছেন এবং তা যথার্থ। (দ্র. ন. র. ২ : ২৯৮) প্রকৃতপক্ষে ‘রাক্ষুসী’ ও ‘স্বামীহারা’ ছাড়া গ্রন্থদুটির অবশিষ্ট ছোটগল্পসমূহ শিল্পমানে পুরোপুরি উত্তীর্ণ-একথা বলা যাবে না। নজরুলের অপ্রকাশিত গল্পদুটি সম্পর্কেও একই কথা প্রযোজ্য। প্রাসঙ্গিক একটি সমালোচক-মন্তব্য আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির প্রায় অনুরূপ :

তাঁর গল্পগুলি আদ্যোপান্ত পড়লে প্রথমেই একটা কথা মনে না -হয়ে পারে না। তা হল শিউলিমালা নামক গল্পগ্রন্থের গল্পগুলি ছাড়া তার অন্যান্য গল্পগুলিকে প্রচলিত অর্থে ছোটোগল্পের পরিচিত সংজ্ঞায় বাঁধা খুবই মুশকিল। প্রেমের স্মৃতি, যুদ্ধের অভিজ্ঞতা, রাজনীতি-সমাজনীতির চাপে বিক্ষুব্ধ ব্যক্তি-শিল্পীর অনুভূতি অনেকক্ষেত্রেই তাঁর গল্পের ক্ষেত্রভূমি দখল করে নিয়েছে। (কৃষ্ণরূপ ২০১৪ : ২৩৮)

আসলে একজন রোমান্টিক তরুণ সাহিত্যিকের সূচনা-পর্বের সাহিত্যকর্মের বৈশিষ্ট্য যেমনটি হয়ে থাকে নজরুলের প্রথম পর্যায়ের ছোটগল্পগুলোও সমরূপ বিশিষ্টতাপূর্ণ। প্রেমের দুর্দান্ত আবেগ-স্মৃতি-হতাশা -ক্ষুব্ধতা -বেদনা-কাতরতা পৌনঃপুনিকভাবে যেন তাঁর প্রথম দিকের ছোটগল্পের অপরিহার্য অনুষঙ্গ। নজরুলের প্রথম পর্যায়ের প্রেম-বিরহ ভারাক্রান্ত গল্পগুলি হচ্ছে ‘বাদল-বরিষণে’, ‘অতৃপ্ত কামনা’, ‘রাজবন্দীর চিঠি’, ‘বাউণ্ডেলের আত্মকাহিনী’, ‘মেহের নেগার’, ‘সাঁঝের তারা’ । এ সব গল্পে লিরিক্যাল গদ্যে প্রেম-বিরহের হাত ধরে এসেছে প্রতিবেশ, প্রকৃতি। গল্পকার ভিন্ দেশের পটভূমিতে বিদেশিনী তরুণীর অনুপ্রেরণায় যে কথামালা সাজাচ্ছেন সেখানে তার অজান্তেই ফুটে উঠেছে বাংলার প্রকৃতি, বাংলার রমণী।‘বাদল বরিষণ’ থেকে :

পথের মাঝে দাঁড়িয়ে দেখলাম আকাশ বেয়ে হাজার পাগলা-ঝোরা ঝরছে - ঝম্ ঝম্ ঝম্। যেন আকাশের আঙিনায় হাজার হাজার দুষ্টু মেয়ে কাঁকর-ভরা মল বাজিয়ে ছুটোছুটি করছে। তপোবনে গিয়ে দেখলাম, সেই বৃষ্টি ধারায় ভিজে ভিজে মহা উৎসাহে বিদেশিনী তরুণীরা দেবদারু ও বকুল শাখায় ঝুলানো দোলনায় দোল খেয়ে কাজরী গাইছে। ঝড়-বৃষ্টির সাথে সে কি মাতামাতি তাদের! আজ তাদের কোথাও বন্ধন নেই, তাদের প্রত্যেকেই যেন এক একটা পাগলিনী প্রকৃতি। কি সুন্দর সেই প্রকৃতির উদ্দাম চঞ্চলতার সনে মানব-মনের আদিম চির-যৌবনের বন্ধ-হারা গতি-রাগের মিলন! - শাঙন মেঘের জমাট সুরে আমার মনের বীণায় মূর্ছনা লাগল। আমার যৌবন-জোয়ারও অমনি ঢেউ খেলে উঠল। মনের পাগল অমনি করে দোদুল দোলায় দুলে সুন্দরীদের এলো চুলের মতোই হাওয়ার বেগে মেঘের দিকে ছুটল, - হায় কোথায়, কোন্ সুদূরে তার সীমারেখা ! (ন. র. ১ : ২১৮)

রোমান্টিক এই গল্পগুলোর পাশাপাশি একই সময়ে তিনি লিখেছেন প্রেম ও যুদ্ধের যুগলবন্দি কয়েকটি গল্প - ‘ব্যাথার দান’, ‘হেনা’, ‘ঘুমের ঘোরে’, ‘রিক্তের বেদন’। নজরুলের প্রথম দিকে গল্পগুলোর নানা সীমাবদ্ধতা বিবেচনায় রেখেই একটি বিশেষ দিক হতে এগুলো যে বাংলা সাহিত্যে পথিকৃৎ -এর মর্যাদায় অভিষিক্ত, তা অনেক সময় আমরা বিস্মৃত হয়ে যাই। সেটি হচ্ছে, এ গল্পগুলোই বাংলা সাহিত্যের প্রথম যুদ্ধকেন্দ্রিক সাহিত্য বা সমর-সাহিত্য। নিস্তরঙ্গ বাঙালি জীবনধারায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে এসেছিল এক ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ মহাতরঙ্গ। কাজী নজরুল ইসলামের এই সব গল্পে সেই উর্মিমুখর সাগরদোলা অনুভব করেন বাঙালি পাঠক। ‘এক নতুনতর পটভূমিতে যুদ্ধ, ধ্বংস ও অনিবার্য মৃত্যুর মধ্যে গল্পের অবতারণা।’ (মোবাশ্বের ১৯৮১ : ১৯০) বাঙালি পল্টনের সৈনিক নজরুল আর গল্পকার নজরুল এখানে একাকার, ‘হেনা’ গল্প থেকে :

আঃ , যুদ্ধের এই খুনোখুনির কি মাদকতা-শক্তি ! মানুষ মারার কেমন একটা গাঢ় নেশা।

পাশে আমার চেয়ে অতবড় জোয়ানটা এলিয়ে পড়েছে, দেখছি ! আমি দেখছি, শরীরের বলের চেয়ে মনের বলের শক্তি অনেক বেশি।

লুইস্ গানে এক মিনিটে প্রায় ছয়-সাত শো করে গুলি ছাড়ছি। যদি জানতে পারতুম, ওতে কত মানুষ মরছে ! তা হোক এক দু কোণের দুটো লুইস্ গান্ই শত্রুদের জোর আটকিয়ে রেখেছে কিন্তু। কি চিৎকার করে মরছে শত্রুগুলো দলে দলে ! কি ভীষণ সুন্দর এই তরুণের মৃত্যু-মাধুরী ! (ন. র. ১ : ২০৪)

‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী, আর হাতে রণ-তূর্য!’ - ‘বিদ্রোহী’ কবিতার এই পংক্তি যেন মূর্ত হয়ে উঠেছে নজরুলের এই পর্বের গল্পগুলোয়। তবে প্রেম-বিরহ-যুদ্ধ পর্যায়ের ছোটগল্পসমূহের বৈচিত্র্য তুলনামূলক অপ্রতুল, ‘প্রায় গল্পই অতি পল্লবিত এবং রাগ্বাহুল্য।’ (মোবাশ্বের ১৯৮১ : ১৯৪) কিন্তু তারপরও ব্যাথার দান বাংলা সাহিত্যে নিয়ে এসেছিল নতুন আবাহন, হয়েছিল জনপ্রিয়।

(ক্রমশ)

লেখক: অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।

(দ্য রিপোর্ট/একেএমএম/ মে ২৫,২০১৮)