অর্থনীতি সমিতির ১২ লাখ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব
দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক: অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটের আকার ৪ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা হবে বলে ধারণা দিয়েছেন।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি মনে করে, বাজেটের আকার এর প্রায় তিনগুন বেশি হওয়া উচিত। দেশের অর্থনীতিবিদদের এ সংগঠনটি আগামী অর্থবছরের জন্য ১২ লাখ ১৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকার বিকল্প বাজেট প্রস্তাব পেশ করেছে।
শনিবার রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে অর্থনীতি সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত বিকল্প বাজেট প্রস্তাবের বিস্তারিত তুলে ধরেন।
২০১৫-১৬ অর্থবছর থেকে অর্থনীতি সমিতি এ ধরনের বিকল্প বাজেট প্রস্তাব করে আসছে। সমিতির সাধারণ সম্পাদক ড. জামাল উদ্দিন আহমেদ বাজেট প্রস্তাবের প্রাথমিক অংশ তুলে ধরেন। এ সময় সংগঠনের সহসভাপতি এজেডএম সালেহ, অধ্যাপক হান্নানা বেগমসহ সংশ্নিষ্টরা উপস্থিত ছিলেন।
বক্তব্যের শুরুতে আবুল বারকাত বলেন, এ প্রস্তাব সরকারের কাঠামোগত রূপান্তরের নিরিখে মৌলিক ও গতানুতিক নয়। যেকারণে এ প্রস্তাব আপাতত গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে। আবার রাজনৈতিক অর্থনৈতিক মতাদর্শের কারণেও এখনকার নীতিনির্ধারকদের কাছে বাতিলযোগ্য মনে হতে পারে। তবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশ বিনির্মাণে এ প্রস্তাব যুক্তিযুক্ত।
প্রস্তাবিত বাজেটে মোট রাজস্ব আয় দেখানো হয়েছে ৯ লাখ ৯০ হাজার ৮২০ কোটি টাকা। যার মধ্যে ৭৭ শতাংশ প্রত্যক্ষ কর আর ২৩ শতাংশ পরোক্ষ করা। বাকী ২ লাখ ২৫ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা বাজেটের ঘাটতি। এই ঘাটতির এক লাখ কোটি আসবে সরকারি-বেসরকারি যৌথ অংশীদারিত্বের মাধ্যমে।
বন্ড বাজার থেকে আসবে ৪৫ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা। সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণের মাধ্যমে আসবে ৬০ হাজার কোটি টাকা। আর ২০ হাজার কোটি টাকা আসবে দেশীয় ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে। ঘাটতি অর্থায়নে বৈদেশিক ঋণের কোনো ভূমিকা থাকবে না। তবে দেশের জন্য অনুকুল শর্তে বৈদেশিক ঋণ পাওয়া গেলে সেবিষয়ে ভাবা যেতে পারে।
সমিতির বাজেট প্রস্তাবে উন্নয়ন খাতে অনুন্নয়ন খাতের তুলনায় বেশি বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছে। যা বর্তমানে উল্টো। সরকারের বাজেটে উন্নয়ন খাতে অনুন্নয়ন বাজেটের তুলনায় বরাদ্দ কম থাকে। সমিতির প্রস্তাবিত বাজেটের ৬ লাখ ৬৮ হাজার ৭০০ কোটি টাকা ব্যয় হবে উন্নয়ন খাতে। আর অনুন্নয়ন খাতে ৫ লাখ ১৪ হাজার ২৬৫ কোটি টাকা করার প্রস্তাব এসেছে।
এই ব্যাপক উন্নয়ন বরাদ্দে মধ্যে সবচেয়ে বেশি শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে ব্যয় করার প্রস্তাব করেছে সমিতি। এ খাতে ২ লাখ ৬৪ হাজার ৮০৫ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে। এই বরাদ্দের ৫৮ শতাংশ অর্থ প্রাথমিক ও গণশিক্ষা এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা খাতে ব্যয় করার কথা বলা হয়েছে।
পর্যায়ক্রমে শিক্ষা খাতে ব্যয় জিডিপির ৮ শতাংশ করতে হবে। এরপর ২ লাখ ৫২ হাজার ৩০০ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে।
জনপ্রশাসন খাতে বরাদ্দ ধরা হয়েছে ২ লাখ ৪৫ হাজার ৪৬৮ হাজার কোটি টাকা। পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে ১ লাখ ২৮ হাজার ৭০০ কোটি টাকা, স্বাস্থ্যখাতে ৮৪ হাজার ৯৫০ কোটি টাকা এবং সামাজিক নিরাপত্তাখাতে ৭২ হাজার ৬০০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
বিশাল রাজস্ব আয়ের মধ্যে ৬ লাখ ৬৩ হাজার ৮৭০ কোটি টাকা আসবে রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে। আয় ও মুনাফার ওপর কর থেকে ৩ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আসবে। আর মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট থেকে আসবে ১ লাখ ৪৮ হাজার কোটি টাকা। আমদানি শুল্ক থেকে ৬০ হাজার কোটি টাকা। সম্পূরক শুল্ক থেকে আয় ৪৩ হাজার কোটি টাকা।
বিদেশি নাগরিকদের ওপর কর থেকে আসবে ৬ হাজার কোটি টাকা। সম্পদ কর ২৫ হাজার কোটি টাকা। মাদক শুল্ক থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকা, যানবাহন কর থেকে ২৫ হাজার কোটি টাকা, ভুমি রাজস্ব থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা। মোট কর থেকে ৭ লাখ ২৯ হাজার ৮৭০ কোটি টাকা আসবে বলে মনে করে সমিতি। আর ২ লাখ ৬০ হাজার ৯৫০ কোটি টাকা আসবে বলে প্রক্ষেপন করা হয়েছে।
আবুল বারকাত বলেন, বর্তমানে দেশে বড়জোর ১০০ জন ব্যক্তি বছরে ১ কোটি টাকা অথবা তার বেশি ব্যক্তিগত পর্যায়ে কর দেন। বাস্তবে এই সংখ্যা হওয়ার কথা কমপক্ষে ৫০ হাজার জন। যেখান থেকে বছরে ৫০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় করা সম্ভব।
তিনি আরও বলেন, বরাবরের মতোই এবারের বাজেটের সবচেয়ে চ্যালেঞ্জ ও দুর্বল দিক হলো সময়মত এবং মানসম্মত বাস্তবায়ন। বাজেট বাস্তবায়নের কার্যকারিতা বাড়াতে প্রত্যেক মন্ত্রণালয় ও সরকারি বিভাগকে দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে হবে। অন্যথায় তাদের শাস্তির বিধান করতে হবে।
তিনি বলেন, বাজেট প্রণয়নে আমরা সংবিধানের বিধান সমুহকে ভিত্তিহিসিবে ধরে নিয়েছি। সমিতির প্রস্তাবিত বাজেটে বিত্তশালী ও ধনীদের ওপর করের বোঝা অতীতের তুলনায় বাড়বে। যা সমাজে বৈষম্য দূর করবে। দীর্ঘমেয়াদী ও ব্যয়বহুল অসংক্রামক রোগের বিস্তৃতি বেড়ে যাওয়ায় প্রতিবছর ৫০ লাখ মানুষ দারিদ্রসীমার নীচে নেমে যাচ্ছে। তাই প্রস্তাবিত বিকল্প বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। অর্থনীতি সমিতি বাজেটসহ আর্থ সামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বিদেশ থেকে ধার করা নয়, নিজেদের উন্নয়ন দর্শন নিয়ে কাজ করে।
সমিতির সাধারণ সম্পাদক ড. জামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, বাজেটে প্রবৃদ্ধির সাথে সাথে বৈষম্য কমানোর দিক নির্দেশনা ষ্পষ্টভাবে থাকতে হবে। সরকারিভাবে দেশে বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ বলা হলেও দেশে প্রকৃত বেকারের সংখ্যা ১ কোটি ৭৫ লাখ। কর্মসংস্থান বাড়ানো ছাড়া বৈষম্য কমানো সম্ভব নয়। এখন যে কোটা আন্দোলন হচ্ছে তার জন্মদাতা বেকারত্ব। এজন্য সমিতি জাতীয় কর্মসংস্থান পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন কোষ গঠনের প্রস্তাব করছে।
অর্থনীতি সমিতির প্রস্তাবে কালো টাকা নিয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশ ও এ বিষয়ে কমিশন গঠনের কথা বলা হয়েছে। বারকাত বলেন, সমিতি আশা করছে চুড়ান্ত বাজেটে এ বিষয়ে ঘোষণা থাকবে।
এক প্রশ্নের জবাবে আবুল বারকাত বলেন, স্বাধীনকতার পর ১৯৭২ সাল থেকে এখন পর্যন্ত মাত্র ১৪-১৫ হাজার কোটি কালো টাকা সাদা করা হয়েছে। এর মধ্যে সরকার পেয়েছে মাত্র ৮ হাজার কোটি টাকার মতো।
(দ্য রিপোর্ট/এমএসআর/মে ২৬, ২০১৮)