ভারতে টাকা নিয়ে বিজেপির হিন্দুত্ব এজেন্ডা প্রচারে রাজী শীর্ষ ২৫ মিডিয়া গোষ্ঠি
দ্য রিপোর্ট ডেস্ক: উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় রাষ্ট্র ভারতে প্রায় সত্তর বছর ধরে গণতান্ত্রিক সরকার ও শাসনব্যবস্থা চালু আছে। ভারতীয় রাষ্ট্রের জনক মহাত্মা গান্ধী অহিংসা ও গণতন্ত্রের অগ্রদূত হিসেবে বিশ্বব্যাপী নন্দিত। এরপর যাদের নাম উল্লেখ করতে হয় তারা হলেন পণ্ডিত জওহর লাল নেহেরু, মওলানা আবুল কালাম আজাদ, সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল, খান আবদুল গফফার খান প্রমুখ। তারা সবাই ছিলেন অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের জনক।
আজ ৬৯ বছর পর ভারতে নতুন করে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে সাম্প্রদায়িকতার চর্চা শুরু হয়েছে। হিন্দুত্ববাদী বিজেপি পার্টি কয়েক বছর আগে ভারতের রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হয়েছে। বিজেপির আদর্শিক গুরু হচ্ছে উগ্র হিন্দুত্ববাদী দল রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস)। তাদের দৌরাত্ম্যে ভারত আসলে কোথায় যাচ্ছে চিন্তাশীল মানুষের কাছে ভাবনার বিষয়। কিন্তু সে ভাবনা তৈরির জন্য মিডিয়ার যে ভূমিকা থাকা দরকার, তা যে কী করুণ পর্যায় গিয়ে ঠেকেছ, লোভ ও আপোস কামিতার কাছে হার মেনেছে মিডিয়া কর্মীদের অনেকেই তারই একটি নজির আলোয় খুঁড়ে দেখিয়েছে ‘ কোবরা পোস্ট’। চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছ ন্যাক্কার জনক সত্যটি। এই নিয়ে ভারত জুড়ে চলছে তোলপাড়। তাই নিয়ে রিপোর্ট করেছেন অনেকেই। যেমনটি করেছেন বিবিসি। সেটি এখানে পত্রস্থ করা হলো।
অনুসন্ধানী নিউজ পোর্টাল - কোবরাপোস্ট ভারতে একটি অনুসন্ধানী নিউজ পোর্টাল তাদের চালানো স্টিং অপারেশনের ভিডিও অনলাইনে প্রকাশ করে দাবি করেছে, দেশের অন্তত ২৫টি প্রথম সারির মিডিয়া গোষ্ঠী কোটি কোটি টাকার বিজ্ঞাপনের বিনিময়ে তথাকথিত হিন্দুত্ব এজেন্ডার প্রসারে ও বিজেপিকে ক্ষমতায় রাখার চেষ্টাতে সামিল হতে রাজি হয়ে গিয়েছিল।
'কোবরাপোস্টে'র রিপোর্টারের গোপন ক্যামেরার সামনে দেশের বহু নামীদামী মিডিয়া হাউসের কর্মকর্তাদের এই 'ডিল' নিয়ে কথা বলতে দেখা গেছে।
তবে বিবিসি-র পক্ষে ওই ভিডিওর সত্যতা যাচাই করা সম্ভব হয়নি।
ভারতে বেশির ভাগ মিডিয়া হাউসকে যে 'কেনা যায়', এ ঘটনা তা প্রমাণ করে দিয়েছে বলে অনেকেই বলছেন, তবে টাইমস গ্রুপের মতো অভিযুক্ত অনেক মিডিয়া গোষ্ঠীই আবার দাবি করছে এই স্টিং মিথ্যায় ভরা।
কোবরাপোস্ট জানাচ্ছে, তাদের রিপোর্টার পুষ্প শর্মা একটি হিন্দু ধনী ধর্মীয় আশ্রমের প্রধান সেজে বিভিন্ন মিডিয়া গোষ্ঠীর কাছে একটি লোভনীয় প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিলেন।
প্রস্তাবটি ছিল, বিজেপিকে ২০১৯র ক্ষমতায় রাখার লক্ষ্য নিয়ে ওই পত্রিকা বা চ্যানেলগুলোতে প্রথমে শ্রীকৃষ্ণ ও ভাগবত গীতার প্রচার করতে হবে, তারপর বিজেপির প্রতিপক্ষ রাহুল গান্ধী-মায়াবতী-অখিলেশ যাদবের মতো নেতাদের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানাতে হবে এবং ভোটের ঠিক আগে চলবে খোলাখুলি হিন্দুত্বর প্রচার।
ওই আন্ডারকভার রিপোর্টার নিজের ছদ্মনাম নিয়েছিলেন 'আচার্য অটল', আর বলা হয়েছিল তিনি আরএসএসের হয়েই এ কাজ করছেন। ভিডিওগুলো বলছে, ২৭টির মধ্যে ২৫টি মিডিয়া হাউসই কোটি কোটি টাকার ওই প্রস্তাব একরকম লুফে নেয়।
দিল্লির সাংবাদিক-অ্যাক্টিভিস্ট আরফা খানুম শেরওয়ানির বলছেন, "বেশ কয়েক বছর ধরেই শোনা যাচ্ছে ভারতে মিডিয়া পয়সার জন্য যা খুশি করতে রাজি, তাদের অতি সহজেই কিনে নেওয়া সম্ভব - তবে এই প্রথম সেই অভিযোগের সমর্থনে কোনও অকাট্য সাক্ষ্যপ্রমাণ মিলল।"
"সকলে না-হোক, ভারতে মিডিয়ার একটা বিরাট অংশ যে সত্যিই পয়সার জন্য যা খুশি করতে পারে সেটা তো এখন দেখাই যাচ্ছে!", বলছিলেন তিনি।
কোবরাপোস্টের রিপোর্টারকে যাদের সঙ্গে কথা বলতে দেখা গেছে, তাদের মধ্যে আছেন ভারতের বৃহত্তম মিডিয়া গোষ্ঠী টাইমস গ্রুপের অন্যতম মালিক তথা ম্যানেজিং ডিরেক্টর ভিনিত জৈনও।
যাচাই না-করা ওই ভিডিওগুলোতে দেখা যাচ্ছে, টাইমস গ্রুপ পাঁচশো কোটি রুপির বিনিময়ে আচার্য অটলের দেওয়া এজেন্ডা বাস্তবায়নে রাজি, যার বেশিটাই আবার নগদ বা কালো টাকাতে নিতেও তাদের আপত্তি নেই।
টাইমস গ্রুপ এদিন অবশ্য দাবি করেছে ওই ভিডিও মিথ্যায় ভরা ও বিকৃত - ও তারা ওরকম কোনও চুক্তিতেও সই করেনি।
তবে 'দ্য ওয়ার' পোর্টালের কর্ণধার ও দ্য হিন্দুর সাবেক সম্পাদক সিদ্ধার্থ বরদারাজন এই সাফাইতে বিশ্বাস করছেন না।
মি বরদারাজন বলছেন, "ভারতে অধিকাংশ মিডিয়া হাউসের কাছে মুনাফাই যে শেষ কথা, এই স্টিং অপারেশন সেটা প্রমাণ করে দিয়েছে। যে এজেন্ডা দেশকে ভাগ করে দেবে, ভোটের আগে দেশকে পোলারাইজ করবে - সেটা জেনেবুঝেও লাভের জন্য তা রূপায়ন করতে তাদের এতটুকুও দ্বিধা হয় না।"
স্টিং-বিদ্ধ মিডিয়া গোষ্ঠীগুলির মধ্যে একটি আবার দিল্লি হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ নিয়ে তাদের নিয়ে তৈরি করা ভিডিওটির প্রচার আপাতত আটকাতে পেরেছে।
তবে কিছুটা আশ্চর্যজনকভাবে ভারতের বিরোধী দলগুলো কোবরাপোস্টের এই স্টিং অপারেশন নিয়ে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া দেওয়া থেকে এখনও বিরত থেকেছে।
রাজনীতিক ও সোশ্যাল অ্যাক্টিভিস্ট যোগেন্দ্র যাদব আবার টুইটারে আক্ষেপ করেছেন, কেন ভারতের মূল ধারার সংবাদপত্রগুলির একটিও এই স্টিং নিয়ে কোরও খবরই প্রকাশ করছে না?
তার সহকর্মী ও ভারতের শীর্ষস্থানীয় আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণ আবার অভিযুক্ত মিডিয়াগুলোকে বর্জন করার ডাক দিয়েছেন।
প্রশান্ত ভূষণ বলছেন, "ভারতের লোককে এখন স্থির করতে হবে যে সব চ্যানেল বা সংবাদপত্র জেনেবুঝে দেশকে ভাগ করার, দেশের মানুষকে পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্রে সামিল হতে রাজি হয়ে যায় তাদেরকে আমরা বয়কট করব কি না। এখন সময় হয়েছে এই সব তথাকথিত মিডিয়ার বদলে অন্য সূত্র থেকে খবর জোগাড় করার।"
ভারতে মিডিয়া জগতের বহু দিকপাল - যাদের সংস্থার নাম এই স্টিং বিতর্কে জড়ায়নি - তাদের অনেককেই এই স্টিং অপারেশন নিয়ে মুখ খোলার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিলেন যোগেন্দ্র যাদব।
তার জবাবে এডিটর্স গিল্ড অব ইন্ডিয়ার চেয়ারম্যান শেখর গুপ্তা টুইট করেছেন 'পেইড নিউজ' বা পয়সার বিনিময়ে লেখা খবর হল সাংবাদিকতার ইবোলা ভাইরাস - তবে তিনি স্টিং অপারেশনকে সাংবাদিকার এথিকস-বিরোধী বলেই মনে করেন।
এই গোটা বিতর্কে এটাও উল্লেখ করার মতো যে ২৭টি মিডিয়া হাউসের মধ্যে মাত্র দুটি কোবরাপোস্টের পাতা ফাঁদে পা দেয়নি এবং সরাসরি তাদের প্রস্তাব খারিজ করে দিয়েছিল - আর সে দুটিই কলকাতার পত্রিকা - দৈনিক বর্তমান ও সংবাদ।
(দ্য রিপোর্ট/একেএমএম/মে২৮,২০১৮)