সাইফা আনোয়ার

কৈশোর বয়স থেকে সাহিত্য সাধনার সাথে যুক্ত কবি শেখ মেহেদী হাসানের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘কালের কঙ্কাল’। গ্রন্থটির ৩৯ টি কবিতায় কবি তুলে ধরেছেন জীবনের নানা অনুভূতির সহজ পাঠ। গ্রন্থের ছোট-বড়  প্রতিটি কবিতার শরীরের বাঁকে-বাঁকে রয়েছে কাব্যরসের সমাহার। মূলত সমাজনীতি, রাজনীতি ও প্রেমের কবিতা নিয়েই রচিত হয়েছে ‘কালের কঙ্কাল’ কাব্যগ্রন্থটি। গ্রন্থের প্রতিটি কবিতা তার নিজ নিজ কাঠামো ও ভাব-বিন্যাসে স্বতন্ত্র। তাঁর কবিতা শুধু ‘প্রশিক্ষিত’ সুধীজনের জন্যই নয়, এতে সাধারণ পাঠকেরও আছে সমান হিস্যা। কবিতাগুলোর গাঁথুনিতে ছান্দিকতার পাশাপাশি কবির মনন ও ব্যঞ্জনার প্রতিফলন দেখা যায়। কবিতার ভেতর যেমন প্রেম-ভালবাসার নিখাদ রূপ পাওয়া যায়, তেমনি না পাওয়ার হাহাকার ও বেদনার চিত্রও পরিলক্ষিত হয়। জীবনের নানা চিত্র-বিচিত্র দিকের সমাহার খুঁজে পাওয়া যায় কবিতাগুলোতে।

গ্রন্থের প্রথম কবিতা 'অনুভবে অনুসন্ধান' এ কবি ভালবাসা কী তারই অনুসন্ধান করতে গিয়ে বাস্তবতার এক ভিন্ন প্রতিরূপকে তুলে এনেছেন-

‘এটা কি আর্ত চিৎকারের ঠিক আগের
অস্ফূট স্বরের তীব্র গোঙানি?
এটা কি মৃত্যুক্ষণে পরম বিচ্ছেদে
চোখ বেয়ে নামে আসা অশ্রুধারা?’

যখন পাঠ করি কবির ‘আঁধারে বসবাস’ কবিতাটি তখন মনে হয় আমাদের চারপাশের অন্ধকারের কথা। আমরাও কি ডুবে নেই অন্ধকারে এক মেকি ভণিতা আর কদর্যতার নীচে? কবিতার শেষ পঙক্তিতে কবি তাই বলেছেন-

‘এখানে সরলতা নীরব নিদ্রায় পড়ে থাকে
এখানে বেঁচে থাকি আঁধারে হাতড়িয়ে ঘুরে ফিরে।’

জীবনানন্দ দাশের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় কখনো কখনো কয়েকটি ছত্র-

‘আমি আকাশ দেখেছি,বাতাসের চোখে চোখ রেখেছি
আমি বিকেলবেলায় বৃষ্টি- জলে সৃষ্টিতে মেতেছি
আমি পাহাড় টপকে লেকের স্রোতে আছড়ে পড়েছি
আমি ঝড়ের রাতে অন্ধকারে সেই তোমায় খুঁজেছি...’

[ তোমাকে খুঁজি/ কালের কঙ্কাল]

আধুনিক কবিতার পরতে-পরতে যে দুর্বোধ্য জটিলতার বিষফোঁড়া দেখে পাঠকেরা মুখ ফিরিয়ে নেয়; শেখ মেহেদী হাসানের ‘কালের কঙ্কাল’ কাব্যের সহজ-সরল পরিচিত বাতাবরণ হতে চয়িত উপমা-উৎপ্রেক্ষা ও শব্দ সুষমা, পাঠককে সেই যন্ত্রণা কাতর অভিজ্ঞতা থেকে মুক্তি দেবে। নির্দ্বিধায় বলা যায়, শব্দ নির্বাচন ও উপমা ব্যবহারে কবির প্রাঞ্জল প্রাতিস্বিকতা কাব্যের আগ্রহ বাড়িয়ে দেয় অনেকখানি। আধুনিক যুগের কাব্য-ঘরাণায় যে জটিলতার চাষবাস চলছে সেখানে ‘কালের কঙ্কাল’ কাব্যগ্রন্থে তা নেই বললে অত্যুক্তি হয় না। অবশ্য এ-কথাও স্বীকার্য যে, কবির আধুনিক শব্দ চয়ন ও নতুন নতুন উপমা ব্যবহারেরও শৈল্পিক দক্ষতা আছে। এ-ক্ষেত্রে কবির প্রথম প্রয়াস প্রশংসার দাবিদার সন্দেহাতীতভাবে; কেননা তিনি অবলীলায় ছুঁয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন আধুনিক জীবনের যন্ত্রণাক্লিষ্ট হৃদয়ের উষ্ণভূমি। কবি বলেছেন-

‘তোমাদের অশ্লীল আনন্দের প্রতি শীতকারে আমি শুনি পুষ্টিহীন পোয়াতির বুক ফাটা চিৎকার
আর শত শিশুর বোবা কান্না জঠরে কিংবা কোলে
নির্বাক আমি দেখেছি , শুনেছি এবং বুঝেছি
মানবতার মৃত্যু দু-পেয়ো জানোয়ারের হিসাব-নিকাশে..."

[‘মানবতার মৃত্যু’]

খুব বেশি মোহিত করে ‘সময়ের আর্তনাদ’ কবিতার কয়েকটি লাইন-

‘জীবনের কিছু বেদনা আজ বিদ্রোহী
বিদ্রোহের কোপানলে আজ আমি খণ্ডিত,
জীবনের ক্রান্তিলগ্নে নিয়তির মুচকি হাসি
আজ আমি ক্লান্ত, শ্রান্ত
তবু স্বপ্ন আছে-
বুকের ভিতর বঞ্চিত ছোট্ট হৃদয়ে।"

কবি দ্রোহে ও সাহসে সমাজের গলিত রূপে থুথু ছিটিয়ে দিয়েছেন। কখনো টেনে ছিঁড়েছেন কুৎসিতের সুন্দর মুখোশ। প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থাকে তোয়াক্কা না করার অমিত সাহসের উচ্চারণ পাই তাঁর কবিতায়। যেমন-

‘তুমি ঝড় হয়ে আসবে
মৃতদের শহর থেকে
কোন বিজিএফ, বর্ডার
তোমায় থামাতে পারবে না,
তোমার নিয়তি নিংড়াবে না
জাতিসঙ্ঘের করিডোরের
কোন ঘেউ ঘেউ করা কুত্তা,
তুমি নিশ্চিত আসবে মহামারী রূপে....

['ঘুমাও বাছা'; নাফের স্রোতে ভেসে আসা নিথর শিশুটিকে নিয়ে লেখা কবির ইংরেজী কবিতা 'Sleep, Oh Child!' এর অনুবাদ]

‘শেষের পরে’ কবিতায় ধারণ করে আছে শুদ্ধ প্রেমিকের সত্য বয়ান-

‘আমি আর ঘর্মাক্ত গায়ে জোর পায়ে রুদ্ধশ্বাস ছুটি না
জানি আমার দেরিতে কেউ আর টোল গাল গোল করে বসবে না
আমি আর সেই ব্রান্ডের জুস আর ক্যান্ডি কিনি না
জানি সেই ঠোঁটে- দাঁতে ভাগাভাগির গল্প লেখা হবে না’...।

নিটোল প্রেমের আধুনিক চিত্রকল্প ‘আমি আছি এখনও’ কবিতাটি। প্রেমের কবিতার প্রাচীন উপমা-উৎপ্রেক্ষার জীর্ণ দেয়াল ভেঙে কবি নবতর বৈচিত্র্যে কবিতাটি লিখেছেন। এখানে প্রেমের প্রকাশ ভিন্নতর। যা পাঠককে নতুন মাত্রার দ্যোতনা দেয়।
এই আলোচনায় কাব্যগ্রন্থের কতকগুলো চমৎকার কবিতার সংক্ষিপ্ত পরিচয় না দিলেই ন। এই প্রসঙ্গে 'পোড়া ভালোবাসা', 'অনাদ্রিত অনুভূতি', 'চেয়েছি তোমাকে',' বন্দি সভ্যতা', 'আমার একুশ', 'পরিণতি', 'অন্তিম যাত্রা', 'আমার ভাষা'-ইত্যাদি কবিতার নাম উল্লেখযোগ্য। উল্লেখিত কবিতাগুলো নিঃসন্দেহে অসাধারণ কাব্যিক সুষমামণ্ডিত। এছাড়াও 'মশা', 'জালিয়াতি' 'দুখী চায় ভালবাসা' ও 'রাজনীতি-এই হাস্যরসাত্মক কবিতাগুলোতে কবি চমৎকার সব ছন্দের প্রয়োগ করেছেন। যা মনে নির্মল আনন্দের খোরাক যোগায়।
কাব্য রচনায় কবির মায়াবী-দরদী শব্দ-বাক্যের খেলা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। বস্তুত তাঁর কবিতায় সরল শব্দ গাঁথুনিতে সরল জীবনের সরল চিন্তাই খুঁজে পাওয়া যায়; যে শব্দগুলো দিয়ে তিনি লিখে গেছেন তাঁর বেঁচে থাকার গল্প-

‘তোমরা যারা জোছনা-জোনাকিতে রচে যাও কামনার কাব্য
আমি সাঁতরাই সময়ের স্রোতে
আর গেঁথে যাই বেঁচে থাকার গল্প।’

[বেঁচে থাকার গল্প]

আলোচনার শেষে এসে বলা যায়, ভিন্ন আঙ্গিকের বিচিত্র ভাবনার এই কাব্যগ্রন্থটিকে আমার অসাধারণ মনে হয়েছে কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ হিসেবে। কোমল ও মোলায়েম এর কাব্যভাষ্য। কোন রূঢ়তা নেই। ভাষা প্রকাশে কবির সাহসিকতা এবং ভাবনার মৌলিকত্ব তাঁর অবস্থান মূল্যায়নে যথেষ্ট এগিয়ে। বইটির প্রচ্ছদ এবং অলংকরণও খুবই আকর্ষণীয় ও উপভোগ্য হয়েছে। যা বইয়ের একটি বাড়তি আকর্ষণ। তাঁর কবিতাসমূহ পাঠক হৃদয় ছুঁয়ে যেতে সক্ষম অনায়াসে; এবং এখানেই কবির সার্থকতা। কবি শেখ মেহেদী হাসানের এই শুদ্ধস্বর আরো শুদ্ধতা নিয়ে সামনে এগিয়ে যাবে তা দেখার প্রতীক্ষায়।
কবি মেহেদী হাসান যশোরের বাতাসে কাটিয়েছেন শৈশব, কৈশোর। পড়ালেখা করেছেন যশোর জিলা স্কুল ও ক্যান্টমেন্ট কলেজে। পরে জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং শেষে ভারতীয় সরকার প্রদত্ত সার্ক বৃত্তিপ্রাপ্ত হয়ে ভারতের হায়দরাবাদে অবস্থিত বিশ্বখ্যাত The English and Foreign Languages University (formerly CIEFL) (formerly CIEFL) থেকে ২০১৩ সালে ইংরেজি সাহিত্য ও সংস্কৃতি অধ্যয়নে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।
বর্তমানে তিনি ময়মনসিংহের ত্রিশালে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে সহকারী অধ্যাপক হিসাবে কর্মরত আছেন।
২০১৮’র অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত হয় কবি শেখ মেহেদী হাসান’র প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘কালের কঙ্কাল’। গ্রন্থটি প্রকাশ করছে কবি ও কথাশিল্পী এনাম রেজার প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ‘চমনপ্রকাশ’। প্রচ্ছদ করেছেন মাঝি বাঁধন। বছর জুড়ে পরিবেশনায় থাকবে ‘রকমারি ডট কম’।

(দ্য রিপোর্ট/একেএমএম/ জুন ০১,২০১৮)