ইয়ার ইগনিয়াসের গুচ্ছ কবিতা
পলাতক প্রতিবিম্ব
তরুণ সূর্যের নিচে একদিন হারিয়েছি যে ছায়া, তার খুঁজে ভেদ করেছি দিকচক্রবালের অজস্র চক্রব্যূহ। ছায়ার সন্ধ্যানে সতত ঘুরেছি জরিপীয় জনপদ-জলপথ ও বনপথে। ভাস্কো দা গামা'র মতো ঘুরে ঘুরে নির্ণয় করেছি অজস্র অনির্ণীত পথ -আড়ালে থেকে গেছে আরাধ্য আদল। মল্লযুদ্ধে হেরে যাওয়া সৈনিকের মত অবসন্ন হয়ে বুদ্ধের মুদ্রায় বসে আছি বোধিবৃক্ষতলে -না, কোনো নির্বাণ লিপ্সায় নয়; প্রশস্ত প্রশান্তির নিচে জিরিয়ে নিচ্ছি ধ্যানী বক।
তীব্র মধ্যাহ্নে আজও ইশকুল ফেরত ইশকন বালিকাদের ভিড়ে খুঁজি -হারানো রৌদ্রাভাব, পলাতক প্রতিবিম্ব।।
রাখাইন রমণী
মৃগ কি তোমার গর্ভদিনের সবুজ-সহিস?
আসান অবধি তাহার পাশে যে শয়ান তোমার!
পিপার-পিয়ার অবিকল হরিণী তাই হয়তো
শৈলজ শিখরে বিচরণ বলে
বুকেও ফোটে না পর্বত-পুষ্প
এ কথা শুনিয়া খলখল হাসে রাঙা রাখাইন
হেসো না ওভাবে বাঁকিয়ে অধর
সাতিশয় শীতে দীঘল করো না ঠোঁটের ফাটল
নিষ্পল্লব বিরাণ বেলায়
কোথাও পাবে না গুলঞ্চ পাতা।।
চাঁদের ছায়া
আসান হয়ে এলে অমা আর রাতের রতিকাল
কালো শার্সিটা সরিয়ে নেয় চাঁদ
সমস্ত অন্ধকার সঞ্চিত রেখে তোমার তিমির তিলে
উর্বী উদ্ভাসিত হয় তাদের বীর্য-বিভায়
মাতালেরা ভাবে পূর্ণিমা
যারা গুলিয়ে ফেলে মদ ও জোছনার রঙ
এ গ্রহঘরে গোলবারের অবিকল চাঁদও নিসঙ্গ
অপসৃয়মান বাউণ্ডলে মেষ-মেঘ
পরী-পাখিরাও কোথাও খেলছে চড়ুইভাতি
পাললিক আকাশ? সেও অদূরবীণতম দূরত্বে
এমত রাতে চিলেকোঠায় এঁকে যাই
স্বতন্ত্র সময়ের টেরাকোটা।।
না-হওয়া কথারা
না-হওয়া কথারা জেগে থাকে ঘুমগন্ধিরাতে
এই অশীতিপর অন্ধকারও ঝরা বকুল -সূর্য ওঠার আগে। রোদের বাগানে হেসে ওঠে ভ্রমররহিত ভোরফুল।আকাশের আর্কাইভ থেকে এইদৃশ্য চিরপ্রচারিত।
না-হওয়া কথারা জেগে থাকে তবুও
নিকষিত নিকোটিনের আলোয় -ভাঙা অর্গান বাজিয়ে বাজিয়ে কাটিয়ে দেয় নিরন্ন-দুপুর।
স্মৃতিপুরে কাঠঠোকরার ন্যায় ঠুকরে ঠুকরে খায় কৃষকায় আত্মার ফসিল।
না-হওয়া কথারা জেগে থাকে বুকের ব্যাসে
সন্ধ্যার আঁধার নিয়ে।।
বেদনার বিউগল
বিরতিহীন বেজে যাচ্ছে বেদনার বিউগল
নিকোটিন পুড়াতে পুড়াতে যে জল
বহমান -বাকখালী মোহনায়
তার উৎসমূল তো আমারই দু'চোখ
সে ভাসানে হারাচ্ছে - কতিপয়
ছিন্নমূল সুখের বোচকা
তাকে নিরখা-ও কুহেলি
তোমার সুখদ সঙসারে অন্ন হবে
পালিতা পায়রার।
মৃণ্ময়ী
প্রণতি মৃণ্ময়ী
বিজন বনে ধ্যানের অতলে
আমি সিদ্ধার্থ
মন কায়া সপি তব নাম জপি
হৃৎপিণ্ড এক শোকার্ত নির্ঝর
রক্ত-স্ফুরণে ভেজায় বুক;
ভেজায় পথ তোমার আসার
আয়তলোচনা হে
তোমার তাচ্ছিল্যের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি
ক্যাকটাস-কন্টকসম বিঁধে
মরমের মেমব্রেনে
বোশেখী ঝড়ে বিনাশ করো
বিন্যস্ত আস্থায় গোছানো সংসার
ফিরে এসো
অ্যাডাম ও ঈভের মতো
প্রার্থনায় প্রার্থনায়
যাবতীয় আরাধনা শিঁকেয় তোলে
মিলনের প্রার্থনায় মুখর হোক আবার
প্রাচীন পৃথিবী।
পুনর্জন্ম
বাবা মারা যাওয়ার পর প্রায় প্রতিদিন-ই আমার সাথে কথা হতো, টিউলিপ-দলে শিশিরের মতো ঝরঝরে ভাষায়, স্বল্পদৈর্ঘ্য স্বপ্নে। প্রতিমার ঔরসে যেদিন পুত্র পললের জন্ম হলো,ওইদিন থেকে আজতক না-স্বপ্নে না-কল্পে তিনি আর আসেননি।
তর্জনী তর্জমা
দেশ-অম্বিকা হে, তোমার নীল অম্বরে বিচরিত শকুনের ঠোকরে -
বুকের সবুজে বয়েছিলো যে শোণিত-ধারা -
শুকিয়ে ধারণ করেছে আজ প্রবীণা পত্রের মুখোশ
অধ্যুষিত শীতের শিভেরিতে ঝরে যাওয়া এইসব পাতায়
ডিসেম্বর আঁকতে গিয়ে প্রকট হয় ডিলেমা -
দূরবীণে দৃশ্যমান অশনির রোশনাই;
কুয়াশায় ভিজে ফের অনতিক্রম্য অতীত।
রাজপথ আজও সহসা সুযোগে চুষে নেয় রক্তের রং
অবারিত ও অবিরত অবরোধে স্বাধীনতার মৃত্তিকাও মৃতপ্রায়
কোষে কোষে বিস্ময়; বিষময় পরাগ পরাধীনতার
ধ্বংসের ধ্বজা উড়াইতেছে জালিম জীবাণু
তবে কি পণ্ড এ রক্ত জবানি?
না-কি স্বাধীনতার এ অস্ফুট দৈন্য
একাত্তরটি তরঙ্গে থেমে গেছে যে রক্তগঙ্গা
সে পাবে কি ফিরে হৃত যৌবন?
ভাসাবে সমূলে যতো অশিব সাজশ
বেহুলা-বরের ভেলার অবিকল?
কিংবা ডালি নেবে দেদীপ্যমান অশুভ বাতিঘর?
রেসকোর্সের তর্জনী তর্জমায়
ফুটে আছে প্রত্নবিপ্লব প্রজন্ম চত্বরে।।
[ কবি পরিচিতি: ইয়ার ইগনিয়াসের জন্ম ১৯৯০ সালের ২২ এপ্রিল কক্সবাজার সদর থানার মধ্যনাপিতখালী গ্রামে। দশ ভাইবোনের সংসারে তিনি ষষ্ঠ। বাবার সংগ্রহে থাকা বইগুলোর মাধ্যমে মূলত পাঠ-অভ্যাস তৈরি। সেজো ভাই রফিকুল ইসলাম রিফেলও লিখতেন ছোট কাগজ, স্থানীয় ও জাতীয় দৈনিকে। তার দেখা দেখি একদিন ইগনিয়াসও তুলে নেন কলম। পেয়েছেন নিরব সমর্থন, আর থামেন নি।
কবি বর্তমানে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। তার প্রকাশিতব্য কবিতাকিতাব: ঠুনকো অনুভূতির বিপরীতে।]
(দ্য রিপোর্ট/একেএমএম/ জুন ০১, ২০১৮)