অর্থবিল পাস : যেসব পণ্য-সেবায় কর হ্রাস-বৃদ্ধি
দ্য রিপোর্ট ডেস্ক : ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে কিছু পণ্য ও সেবা খাতের ওপর কর প্রস্তাব বাড়িয়ে ও কমিয়ে জাতীয় সংসদে পাস হয়েছে অর্থবিল ২০১৮-১৯। জাতীয় সংসদে তিন সপ্তাহ আলোচনার পর এই অর্থবিল পাস হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরামর্শক্রমে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত অর্থবিলে এসব পরিবর্তন আনেন।
গত ১ জুন জাতীয় সংসদে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেট উত্থাপনের পর ৭ জুন সংসদে অর্থবিল উত্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। বিল পাসের প্রস্তাবের আগে অর্থমন্ত্রী বাজেটের ওপর সমাপনি বক্তব্যে কিছু পণ্য ও সেবা খাতে কর প্রস্তাব হ্রাস-বৃদ্ধির ঘোষণা দেন। এরপর সংসদে বাজেট ও অর্থবিলের ওপরে গত তিন সপ্তাহ ধরে আলোচনা চলে।
বুধবার (২৭ জুন) বিকেলে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে শুরু হয় অধিবেশন। পরে অর্থবিলের ওপর বেশ কয়েকজন সরকার ও বিরোধী দলের সংসদ সদস্য আলোচনায় অংশ নেন। বিরোধী দলের ছয় জন সংসদ সদস্য বিলের ওপর জনমত যাচাই-বাছাই কমিটিতে পাঠানো ও সংশোধনীর প্রস্তাব আনেন। কিন্তু তাদের জনমত যাচাইয়ের প্রস্তাব নাকচ হয়ে রাত ৯টা ৪০ মিনিটে কণ্ঠভোটে সংসদে অর্থবিল ২০১৮ পাস করা হয়।
যেসব পণ্য ও সেবায় কর কমলো
আগামী ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর ভ্যাট, ট্যাক্স ও সম্পূরক শুল্ক আরোপের ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি প্রস্তাব পরিবর্তন আনা হয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হলো— তথ্যপ্রযুক্তির খাতে প্রসারের জন্য ইন্টারনেট সেবার ওপর থেকে আরোপিত ভ্যাট ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ নির্ধারণ এবং ব্যবসায়ী পর্যায়ে কম্পিউটার ও এর যন্ত্রাংশের ওপর আগের ধারাবাহিকতায় মূসক অব্যাহতি প্রদান করা হয়। এ ছাড়া, এছাড়া দেশীয় মোবাইল ফোন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের ওপর বর্তমান ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা বহাল রেখে এ শিল্পের সংযোজনকারী প্রতিষ্ঠানের জন্য শুধুমাত্র স্থানীয় উৎপাদন পর্যায়ে ৫ শতাংশের অতিরিক্ত ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়। একইসাথে সোস্যাল মিডিয়া ও ভার্চুয়াল বিজনেস সেবা এবং তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর সেবার সংজ্ঞা সংশোধন করে যুগোপযোগী করা হয়। এ ছাড়া, সিমকার্ড ও স্মার্ট কার্ড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের জন্য কাঁচামাল আমদানি শুল্ক ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে।
শীতের দিনে গ্রামের মানুষের মধ্যে ব্যবহারের প্রবণতা রয়েছে বলে বিলে পেট্রোলিয়াম জেলির ওপর থেকে সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়েছে। আর হেপাটাইটিস-সি রোগের ওষুধ বর্তমানে দেশে তৈরি হওয়ায় এর কাঁচামালের ওপর শুল্ক অব্যাহতি দেওয়া হয়। ওষুধ শিল্প খাতের অন্যতম উপকরণ মোড়ক তৈরিতে পিভিসি ফিল্ম ও আনপ্রিন্টেড নায়নলন ফিল্মের ওপর থেকেও বিদ্যমান শুল্ক ১০ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়।
এদিকে, আবার মোটরসাইকেল শিল্পের অধিকতর বিকাশের লক্ষ্যে দেশীয় মোটরসাইকেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের ওপর ভ্যাট অব্যাহতি বহাল রেখে সংযোজনকারী প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র স্থানীয় উৎপাদন পর্যায়ে ৭ শতাংশের অতিরিক্ত মূল্য সংযোজন কর অব্যাহতি প্রদান করা হয়। প্রস্তাবিত বাজেটে ডাবল কেবিন পিকআপ আমদানিতে সম্পূরক শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশ করা হয়েছে। পাশাপাশি ব্যাটারি শিল্পে ব্যবহৃত ন্যাচারাল বেরিয়াম সালফেটে প্রস্তাবিত শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়। ড্রাই মিক্সড ইনগ্রেডিয়েন্টের প্রস্তাবিত শুল্কও কমিয়ে ১০ শতাংশ বহাল রাখা হয়।
এ ছাড়া, ফিলামেন্ট বাল্বের ওপর থেকেও ১০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়েছে। ক্রেডিট রেটিং এজেন্সির বিপরীতে প্রযোজ্য ১৫ শতাংশ ভ্যাটের পরিবর্তে নিট ৭ শতাংশ করার হয়। বিলে বর্তমানে কেবল ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইট পরিচালনার ক্ষেত্রে এয়ারলাইন্সগুলোর বন্দর সেবার বিপরীতে ১৫ শতাংশ ভ্যাট বহাল রাখা হয়।
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘কর আরোপ, প্রযোজ্য ক্ষেত্রে মওকুফ, বিদ্যমান কর হার ও কর ভিত্তির যৌক্তিকীকরণ প্রস্তাবসহ আমার পেশ করা অন্যান্য পদক্ষেপ মহান সংসদে গৃহীত হলে একটি ব্যবসায় ও করদাতাবান্ধব অনুকূল পরিবেশ তৈরি হবে। পাশাপাশি ২০১৮-১৯ অর্থবছরেও মূল্য সংযোজন কর আহরণের প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে।’
যেসব পণ্য ও সেবায় কর বাড়লো
দেশে ধূমপায়ীর সংখ্যা কমিয়ে আনতে অর্থবিলে নিম্নস্তরের সিগারেটের দাম প্রতি ১০ শলাকায় ২৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩৫ টাকা এবং অতি উচ্চস্তরের সিগারেটের দাম প্রতি ১০ শলাকায় ১০১ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১০৫ টাকা করা হয়। বাজেটে সিগারেটের অন্যান্য স্তরেও দাম বাড়ানো হয়েছে। বর্তমানে শুল্ক-করসহ মূল্যের পূর্বের অভিঘাত অপরিবর্তিত রেখে প্রতি গ্রাম জর্দার ট্যারিফ মূল্য ১.২০ টাকা এবং প্রতি গ্রাম গুলের ট্যারিফ মূল্য ০.৬০ টাকা নির্ধারণ করা হয়।
বিলে ফিল্ড মিল্ক পাউডার বাল্কে আমদানিতে এর আমদানি শুল্ক ২৫ শতাংশ বহাল রাখা হয়। অন্যদিকে, অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, আর্গন, কার্বন-ডাই-অক্সাইডের আমদানি শুল্ক ৫ শতাংশ নির্ধারণ করে রেগুলেটরি ডিউটি শূন্য থেকে বাড়িয়ে ২০ শতাংশ আরোপ করা হয়। নিউজপ্রিন্ট কাগজ আমাদানিতেও সম্পূরক শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২০ শতাংশ করা হয়।
এ ছাড়া, গুণগত মানসম্পন্ন কোল্ড রোল্ড ও কালার কোটেড কয়েল বা শিটের আমদানি শুল্ক বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ করা হয়। বিলেরেফ্রিজারেটর ও এয়ার কন্ডিশনারের কাঁচামাল ০.২৫ এমএম পুরুত্বের ফ্ল্যাট রোল্ড প্রোডাক্টের ওপর ১০ শতাংশ শুল্ক নির্ধারণ করা হয়। লিফ স্প্রিং আমদানিতে সম্পূরক শুল্ক ২০ শতাংশ, ৭৫০ ওয়াট ক্ষমতার মোটর তৈরি উৎসাহিত করতে এর আমদানিতে ৫ শতাংশ শুল্ক ও ১৫ শতাংশ ভ্যাট, ৫ শতাংশ অগ্রিম আয়কর এবং ৫ শতাংশ অগ্রিম ভ্যাট আরোপ করার প্রস্তাব করেন। টেলিভিশনের ওপেন সেল আমদানিতেও আলাদা এইচএস কোড তৈরি করে ৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক নির্ধারণ করা হয়।
এই অর্থবিল ২০১৮ সালের ১ জুলাই থেকে কার্যকর করারও বিধান করা হয়েছে সংসদে। পরে উত্থাপিত বিলের ওপর কয়েকটি সংশোধনী গ্রহণ করা হয়।
অর্থবিলের ওপর আলোচনার শেষের দিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘ভালো একটি বাজেট দেওয়ার জন্য আমি অর্থমন্ত্রীকে স্বাগত জানাই। আমি আশা করছি, দেশের জন্য আরো বেশি বাজেট দেবেন তিনি।’
এদিকে, আগামীকাল বৃহস্পতিবার (২৮ জুন) জাতীয় সংসদে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেট পাস হবে। অতীতের রেওয়াজ ভেঙে এই প্রথমবারের মতো ৩০ জুনের পরিবর্তে ২৮ জুন বাজেট পাস হতে যাচ্ছে।
সংসদে বাজেটের ওপর আরো বক্তব্য রাখেন সংসদ সদস্য শিরিন নাঈম, আমাতুল কিবরিয়া কেয়া, মোহামম্মদ আমাউল্লাহ, মো. ছলিম উদ্দীন তরফদার, নুরুল মজিদ হুমায়ুন, ইকবালুর রহিম, জয়া সেনগুপ্ত, হোসনে আরা লুতফা, মো. মুজিবুল হক ও আ স ম ফিরোজ।
(দ্য রিপোর্ট/এনটি/জুন ২৮, ২০১৮)