সমাজের প্রতি যে অনুভূতির বার্তা দিল ধ্রুব ও লুব্ধ
দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক: বিচ্ছেদ হওয়া মা-বাবাকে একসঙ্গে কাছে পেতে ছোট দুই শিশু ধ্রুব ও লুব্ধ আদালতে যে অনুভূতি প্রকাশ করেছে সেটা এই সমাজের প্রতি একটি বার্তা বলে অভিহিত করেছেন হাইকোর্ট।
আদালত বলেন, বিচ্ছেদ হওয়া সন্তানরা ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং তাদের সবার অনুভূতি একই রকম। তবে তারা সেটা প্রকাশ করতে পারে না।
বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলম সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ বিচ্ছেদ হওয়া এক দম্পতিকে উদ্দেশ করে বুধবার এমন মন্তব্য করেন।
এজলাস কক্ষে উপস্থিত বিচ্ছেদ হওয়া মা-বাবাকে উদ্দেশ আদালত বলেন, আপনারা উচ্চশিক্ষিত, আপনারাই হতে পারেন সমাজের উদাহরণ। নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন মানুষের কাছে কী বার্তা গেছে? আপনাদের দিকে তাকিয়ে আছে সবাই। আপনাদের একটি সিদ্ধান্ত সমাজের প্রতি উদাহরণ হয়ে থাকবে।
এর আগে গত ২৫ জুন দুই শিশু ধ্রুব, লুব্ধ ও তাদের বিচ্ছেদ হওয়া বাবা-মায়ের উপস্থিতিতে হাইকোর্টে এক হৃদয়বিদারক পরিবেশের সৃষ্টি হয়। দুই শিশুর অনুভূতি ও বাবা-মাকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কান্না শুনে আদালতে উপস্থিত বিচারপতি, আইনজীবী, গণমাধ্যমকর্মীসহ সবার চোখে পানি চলে আসে। এক পর্যায়ে আদালতের কাছে বড় ছেলে ধ্রুব বলে, আমরা আর কিছু চাই না। বাবা-মাকে একত্রে দেখতে চাই। একসঙ্গে হতে না পারলে বাবা-মা কেন হয়েছে? একসঙ্গে না হতে পারলে আমরা কারও কাছেই যাব না।
বড় ছেলের এমন বক্তব্যের পর বাবা-মাকে নিয়ে খাস কামরায় কথা বলেন বিচারকরা। পরে ৪ জুলাই পর্যন্ত শুনানি মুলতবি করে আদালত বলেন, ওইদিন পর্যন্ত শিশুসন্তান দুটি মায়ের হেফাজতে থাকবে। এই সময়ে তাদের বাবা শিশু দুটির দেখাশোনা করার অবারিত সুযোগ পাবেন।
সেই ধারাবাহিকতায় বুধবার বিচ্ছেদ হওয়া বাবা-মা ও দুই শিশু সবাই আদালতে হাজির হন। শুনানি শুরু হলে আদালত জানতে চান, এই ক'দিনে ওনাদের পরিস্থিতির উন্নতি কতটুকু? তখন শিশু দুটির বাবার পক্ষের ব্যারিস্টার তাপস কান্তি বল বলেন, তাদের সম্পর্ক কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে আরও সময় লাগবে। মা ছুটি নিয়ে বাচ্চাদের নিয়ে ঘুরেছেন। বাবাও বাচ্চাদের সময় দিয়েছেন। কিন্তু এর মধ্যে একটি সমস্যাও দেখা দিয়েছে। ছোট বাচ্চাটি তার বাবাকে মায়ের বাসায় রাতে থেকে যাওয়ার আবদার জানালে বাবা রাজি হলেও মা রাজি হননি। রাত ১টায় বৃষ্টির মধ্যে বাবাকে বের হয়ে যেতে হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, পারিবারিক সমস্যার কারণে ব্যাংকে অভিযোগ দেওয়ার কারণে ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে বাবার চাকরি চলে যায়।
পারিবারিক এ বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিয়ে আদালত বলেন, এ ঘটনা মিডিয়ায় কীভাবে গিয়েছে দেখেছেন? জনমত সেটাকে কীভাবে দেখেছেন। এটা একটি স্পর্শকাতর বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা চাই বাচ্চা দুটি মা-বাবার স্নেহে থাকুক। আপনারা দেখেছেন, সেদিন ওরা কীভাবে তাদের অনুভূতি ব্যক্ত করেছে। সবাই তো এভাবে করতে পারে না। ওরাই আসলে এই সমাজে বিচ্ছেদ হওয়া পরিবারের সন্তানদের মনের অব্যক্ত অনুভূতি সেদিন তুলে ধরেছে। যেটা একটি বার্তা।
এ সময় তাপস কান্তি বল বলেন, বাবা শিশুদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন। বাচ্চারা যেভাবে চাইবে বাবা সেভাবে করবেন।
পরে মায়ের পক্ষের আইনজীবী ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, এটা পুরোপুরি পারিবারিক ইস্যু। তাই দুইজনের মধ্যে সম্পর্কের উন্নয়নের জন্য আরও সময় লাগবে।
তখন আদালত বলেন, এটা তো রাতারাতি উন্নতি হবে না। সময় লাগবে।
রুহুল কুদ্দুস বলেন, বাচ্চা দুটি ইতিমধ্যে ঢাকায় স্কুলে ভর্তি হয়েছে। বাচ্চারা খুশি প্রতিদিন মা স্কুলে আনা-নেওয়া করছেন। এ সময় আদালত বলেন, ঠিক আছে। কিন্তু বাচ্চাদের অভিপ্রায় উপেক্ষা করে স্কুলে ভর্তি করলে হবে না। উভয়পক্ষকে মনে রাখতে হবে, আদালতের নমনীয়তায় যদি তারা অন্য কিছু ভেবে থাকেন তাহলে সেটা ঠিক হবে না। আদালতের হাত খাটো না। বাচ্চাদের ভবিষ্যৎ মঙ্গল চিন্তা করে আদালত যে কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারেন। এ সময় তাপস কান্তি বল বলেন, বাচ্চারা যদি চায় বাবাকে যেন বাসায় থাকার অনুমতি দেওয়া হয়। প্রয়োজনে ড্রয়িং রুমে থাকবেন। তখন আদালত বলেন, অপেক্ষা করুন, সমঝোতা হয়ে গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে।
এরপর আদালত শিশু ধ্রুব ও লুব্ধকে এজলাসের সামনে ডাকেন। ওরা এগিয়ে গেলে জ্যেষ্ঠ বিচারপতি বলেন, কেমন আছো তোমরা? উত্তরে দুই শিশু জানায়, তারা ভালো আছে। তোমার আব্বু বাসায় যান? জবাবে তারা জানায়, হ্যাঁ, আব্বু বাসায় আসেন।
বিচারপতি এবার ধ্রুব ও লুব্ধর কাছে জানতে চান তারা বিশ্বকাপে কে কোন দল সাপোর্ট করে। উত্তরে ধ্রুব জানায়, সে ব্রাজিলের সাপোর্টার আর লুব্ধ বলে সে আর্জেন্টিনা। অবশেষে আদালত ধ্রুব-লুব্ধর মা-বাবাকে সামনে ডাকেন। তারা এগিয়ে এলে জ্যেষ্ঠ বিচারপতি বলেন, আপনাদের এ বিষয়টি মিডিয়ায় এসেছে। আপনারা উচ্চশিক্ষিত মানুষ। সবাই কিন্তু আপনাদের সিদ্ধান্তের দিকে তাকিয়ে আছেন। আপনাদের এই বিষয়টি বুঝতে হবে। আপনাদের একটি সিদ্ধান্ত সমাজের প্রতি উদাহরণ হয়ে থাকবে।
এরপর আদালত এ বিষয়ে পরবর্তী আদেশের জন্য ১ আগস্ট দিন ধার্য করেন। এ সময় আদালত বলেন, সমঝোতা প্রক্রিয়ার উন্নতি হয়েছে। আরও উন্নতির জন্য দু'পক্ষই সময় চেয়েছেন। এ পর্যায়ে আদালত পরবর্তী আদেশের জন্য আগামী ১ আগস্ট দিন ধার্য করেন।
রাজশাহীর মেয়ে কামরুন্নাহার মল্লিকার সঙ্গে ছাত্রজীবনে রাজধানীতে পরিচয় হয় মাগুরার মহম্মদপুরের ছেলে মেহেদী হাসানের। এরপর দু'জনের প্রেম, ভালোবাসা। ২০০২ সালে বিয়ে করেন তারা। মল্লিকা পেশায় স্কুল শিক্ষিকা। মেহেদী বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা। বিয়ের পর তাদের ঘর আলোকিত করে আসে ফুটফুটে দুই সন্তান। দাম্পত্য জীবন তাদের ভালোই চলছিল। এক পর্যায়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মনোমালিন্যের সৃষ্টি হয়। যার সমাপ্তি ঘটে বিচ্ছেদের মাধ্যমে।
বিচ্ছেদের কিছুদিন আগেই দুই সন্তানকে মাগুরায় গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দেন মেহেদী। বড় ছেলের বয়স এখন ১২, আর ছোট ছেলে ৯ বছরের। বোনের তত্ত্বাবধানে মাগুরা জেলা শহরের একটি স্কুলে সন্তানদের ভর্তি করিয়ে দেন মেহেদী। এর মধ্যে এক বছর দুই সন্তানের দেখা পাননি মা মল্লিকা। শেষ পর্যন্ত সন্তানদের নিজ হেফাজতে নেওয়ার জন্য হাইকোর্টে আবেদন করেন তিনি। এ আবেদনের পর গত ২৯ মে শিশু দুটিকে হাইকোর্টে হাজির করতে সংশ্নিষ্ট থানার পুলিশ ও বাবা মেহেদীকে নির্দেশ দেন। পরে ২৫ জুন তাদের হাজির করা হয়।
(দ্য রিপোর্ট/একেএমএম/ জুলাই ০৪,২০১৮)