ভাঙা হাড় নিয়ে রামেক ছাড়তে হলো তরিকুলকে!
দ্য রিপোর্ট ডেস্ক: ছাত্রলীগের হাতুড়ি পেটায় কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তরিকুল ইসলামের ডান পায়ের হাড় ভেঙে গেছে। তিনচার জন না ধরলে প্লাস্টার করা পা নিয়ে তিনি নড়াচড়া করতে পারেন না। মাথায় দিতে হয়েছে নয়টি সেলাই। সেখানে সারাক্ষণ অসহ্য ব্যথা। পায়ের ভাঙা হাড় জোড়া লাগতে সময় লাগবে কমপক্ষে তিন মাস। একদিন আগেও চিকিৎসক বলেছিলেন কমপক্ষে ১৫ দিন হাসপাতালে থাকার পর তিনি বাড়ি যেতে পারবেন।
গুরুতর অসুস্থ সেই তরিকুলকে ছাড়পত্র দিয়ে হাসপাতাল ছাড়তে বাধ্য করেছে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (রামেক) অর্থোপেডিক বিভাগ। তরিকুলের এখন ঠাঁই হয়েছে নগরীর লক্ষ্মীপুর এলাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে! গত সোমবার বিকেলে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটকের সামনে পতাকা মিছিল বের করলে রামদা, লোহার রড, হাতুড়ি ও বাঁশের লাঠি দিয়ে হামলা করে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী। তখনই মাটিতে ফেলে লাঠি ও হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে আহত করা হয় তরিকুল ইসলামকে।
এই পিটুনির একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তাতে দেখা যায়, মাটিতে ফেলে তাঁকে চারপাশ থেকে ঘিরে লাঠি দিয়ে দিয়ে পেটাচ্ছে কয়েকজন। এর মধ্যে হলুদ গেঞ্জি পরা একটি ছেলে এসে হাতুড়ি দিয়ে তরিকুলকে মারছে। পরে জানা যায় ওই হাতুড়ির আঘাতে তরিকুলের ডান পায়ের দুটি হাড়ই ভেঙে গেছে। হলুদ গেঞ্জি পরা যে তরিকুলকে হাতুড়ি পেটা করেছে, তাঁর পরিচয়ও জানা গেছে। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসম্পাদক আবদুল্লাহ আল মামুন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ৪র্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। আহত হওয়ার পর গত সোমবারই রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৩১ নম্বর ওয়ার্ডে অর্থোপেডিক বিভাগে ভর্তি করা হয় তরিকুলকে। এক্স-রে রিপোর্টে দেখা যায়, তরিকুলের ডান পায়ের হাড় ভেঙে গেছে। তাই ওই পা প্লাস্টার করে দিয়েছেন হাসপাতালের চিকিৎসকরা।
গুরুতর রোগীর হাতে দেওয়া হলো ছাড়পত্র
হাসপাতালে তরিকুলের সঙ্গে থাকা তার স্বজন ও সহপাঠীরা জানান, বৃহস্পতিবার দুপুর একটার দিকে হাসপাতালের ওয়ার্ড থেকে তরিকুলের ছাড়পত্র তুলে দেওয়া হয় সেখানে তার পাহারায় থাকা পুলিশকে। এর আগে হাসপাতালে ভর্তির পর থেকে তরিকুলের পাহারায় রাখা হয় পুলিশ। ফলে পুলিশের হাতে ছাড়পত্র দেওয়ায় তরিকুলের স্বজন ও সহপাঠীদের মধ্যে গ্রেপ্তার আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
ছাড়পত্র হাতে পেয়ে সেখানে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা মহানগর পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এরপর বেলা সাড়ে ৩টার পর পুলিশ তরিকুলের হাসপাতাল ত্যাগের ছাড়পত্র তাঁর স্বজনদের হাতে তুলে দেয়। এ সময় সেখানে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা জানায়, তরিকুলের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ নেই। ফলে তরিকুলকে তার স্বজনরা যেখানে খুশি নিয়ে যেতে পারবে। এর পরই গুরুতর অসুস্থ তরিকুলকে নগরীর লক্ষ্মীপুর এলাকার বেসরকারি রয়েল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তরিকুলের সাথে সার্বক্ষণিক থাকা তার সহপাঠী মতিউর রহমান জানান, রয়েল হাসপাতালে অর্থোপেডিক বিশেষজ্ঞ ডা. সাঈদ আহমেদ তরিকুলের চিকিৎসা তদারকি করছেন। সাঈদ আহমেদ আগামী শনিবার নতুন করে তরিকুলের এক্স-রে করার পরামর্শ দিয়ে জানান, সেদিনের এক্স-রে রিপোর্ট দেখে তিনি বলতে পারবেন তরিকুলের পায়ে অস্ত্রোপচার করতে হবে কি না। তবে সাঈদ তরিকুলের স্বজনদের বলেছেন, ৮০ ভাগ সম্ভাবনা আছে তরিকুলের অস্ত্রোপচার করতেই হবে। সাঈদ আহমেদ বলেছেন, ‘তরিকুলের পায়ের ভাঙা হাড় জোড়া লাগতে কমপক্ষে তিন মাস লাগবে। গায়ে এবং মাথায় মারের ফলে যে ব্যথা রয়েছে তা সারতে দুইতিন সপ্তাহ লাগবে।
ব্যথার জন্য তরিকুলকে ব্যথানাশক ইনজেকশন, এন্টিবায়োটিক ও স্যালাইন দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ব্যথার যন্ত্রণায় তরিকুল ছটফট করায় তাকে মাঝেমধ্যে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হচ্ছে।’ ‘যা চিকিৎসা প্রয়োজন তা দেওয়া হয়েছে’ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রয়েল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তরিকুল ইসলাম জানান, হাতুড়িপেটায় ডান পায়ের হাড় ভেঙে যাওয়ায় তিন-চারজন না ধরলে তিনি বিছানা ছেড়ে উঠতেই পারেন না। মাথায় সেলাইয়ের ব্যথা সারাক্ষণ টনটন করে। সারা গায়ে মারধর করার ব্যথাও অসহ্য লাগে। তারপরও হাসপাতাল থেকে তাকে কেন ছুটি দেওয়া হয়েছে, তা তিনি কিছুতেই বুঝতে পারছেন না। তরিকুল জানান, বুধবার সকালে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের চিকিৎসক ডা. সুব্রত কুমার প্রামানিক তাঁকে দেখতে গেলে তিনি তাঁর শারীরিক সব সমস্যার কথা জানিয়েছিলেন। ওয়ার্ডের চিকিৎসকরা তাঁকে জানিয়েছিলেন, ভাঙা হাড় জোড়া লাগতে অন্তত তিন মাস সময় লাগবে। চার সপ্তাহ পায়ের প্লাস্টার রাখা হবে। এখন সম্পূর্ণ বিশ্রাম দরকার। অন্তত ১৫ দিন হাসপাতালে থাকার পর তিনি বাড়ি যেতে পারবেন। এর আগে নড়াচড়া করলেও পায়ের ভাঙা হাড় জোড়া লাগতে সমস্যা হবে। চিকিৎসকরা এ কথা বলার পরের দিনই হাসপাতাল থেকে তাঁর ছাড়পত্র দেওয়াটা তার কাছে রহস্যজনক মনে হচ্ছে বলে জানান তরিকুল।
অসুস্থ থাকার পরও তরিকুলকে কেন এত দ্রুত ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে, তা জানতে চিকিৎসক সুব্রত কুমার প্রামাণিককে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি। তবে রামেক হাসপাতালের অর্থোপেডিক বিভাগের প্রধান ডা. এম এ কে শামস উদ্দিনের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, তিনি বগুড়ায় আছেন। তাই বিস্তারিত বলতে পারবেন না। তবে তিনি শুনেছেন যে, তরিকুলের এই মুহূর্তে যা যা চিকিৎসা প্রয়োজন তা দেওয়া হয়েছে। আগামী দুই সপ্তাহ হাসপাতালে তেমন কোনো কাজ নেই। এই সময়টা বাড়িতে থাকাই ভালো। তাই তাঁকে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। তরিকুলের সহপাঠী মতিউর রহমান বলেন, ‘তরিকুলকে যখন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ছাড়পত্র দেওয়ার উদ্যোগ নেয়, তখন আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের সাথে যোগাযোগ করি হাসপাতাল থেকে যাতে এখনই ছাড়পত্র দেওয়া না হয়। রামেক হাসপাতালে সরকারি খরচে চিকিৎসার সুযোগ দেওয়ার অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে প্রক্টর তার কিছুই করণীয় নেই বলে জানিয়ে দেন।’ তরিকুলের সহপাঠীরা রামেক হাসপাতাল থেকে বেসরকারি রয়েল হাসপাতাল পর্যন্ত তরিকুলকে নিয়ে যেতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাম্বুলেন্স পাঠানোর অনুরোধ করলেও এতেও সাড়া দেয়নি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলরা।
চাঁদা তুলে চলছে চিকিৎসা
তরিকুল ইসলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী। বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের রাবি শাখার যুগ্ম আহ্বায়ক তিনি। গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সুন্দরখোল উত্তরপাড়া গ্রামে তাঁর বাড়ি। তার বাবা খোরশেদ আলম একজন কৃষক। তিন ভাইবোনের মধ্যে তরিকুল মেজ। রয়ের হাসপাতালে তরিকুলের শয্যাপাশে থাকা তাঁর বোন ফাতেমা বেগম জানান, ভাইকে পেটানোর খবর পেয়ে তাঁর বাবা খোরশেদ আলম ও মা তাহমিনা বেগম অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। অসুস্থ ছেলেকে দেখতে তারা এখনো রাজশাহী আসতে পারেননি। তরিকুলের বড় ভাই তৌহিদুল ইসলাম হাসপাতালে এসেছিলেন। গ্রামের বাড়িতে নানাভাবে কে বা কারা তরিকুলের মা-বাবাকে হুমকি দিচ্ছে, এমন খবর পেয়ে তিনি বৃহস্পতিবার গ্রামের বাড়ি চলে গেছেন। এখন বাবা-মা-ভাই ছাড়া তরিকুলের চিকিৎসা নিয়ে চরম বেকায়দায় পড়েছেন ফাতেমা খাতুন। তবে তার ভরসা তরিকুলের কয়েকজন সহপাঠী সারাক্ষণ হাসপাতালে তরিকুলকে সঙ্গ দিচ্ছেন। তাঁরা নিজেরাই চাঁদা তুলে তরিকুলের চিকিৎসার খরচ চালাচ্ছেন।
রামেক হাসপাতালে চিকিৎসাকালীন তরিকুলকে ঘিরে পুলিশের অবস্থানের বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী মহানগর পুলিশের মুখপাত্র সিনিয়র সহকারী কমিশনার ইফতেখায়ের আলম বলেন, ‘গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে আহত রোগীদের আমরা সব সময় নিরাপত্তা দেই। সে জন্য তরিকুলকেও নিরাপত্তা দেওয়া হয়েছিল, যাতে চিকিৎসাকালীন সময়ে আর কোনো অঘটন না ঘটে।’
হামলাকারীদের সবার ছবি ভিডিওতে স্পষ্ট। এ নিয়ে আইনি কোনো ব্যবস্থাও নেওয়া হয়নি এখন পর্যন্ত। এ বিষয়ে জানতে চাইলে নগরীর মতিহার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহাদত হোসেন খান বলেন, ‘বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ব্যাপার। তারা যেভাবে চাইবে, সেভাবেই আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ আর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক লুৎফর রহমান বলেছেন, হামলায় কে বা কারা জড়িত সে ব্যাপারে আমরা খোঁজ-খবর নিচ্ছি। অবশ্যই জড়িতদের ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ব্যবস্থা নেবে। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হবে।’
(দ্য রিপোর্ট/একেএমএম/জুলাই ০৫,২০১৮)