আল মাহমুদের কাব্যভাষায় জাদুর ঝিলিক
আল মাহমুদ পঞ্চাশ দশকের অন্যতম প্রধান কবি। তিনি তাঁর কবিতায় ঐতিহ্যের নিদর্শন রেখেছেন নানাভাবে। উপমা-উৎপ্রেক্ষা, চিত্রকল্প, স্বতন্ত্র নন্দনতত্ত্ব কবিতায় স্থাপন করে শ্রেষ্ঠত্বের স্থানে পৌঁছে গেছেন। তিনি বক্তব্যের সংকীর্ণতা পেছনে ফেলে উপমা প্রযুক্ত করে বক্তব্যকে উচ্চকিত করেন। উপমার নান্দনিক সৌন্দর্য তার কবিতাকে মানুষের হৃদয়ে বিভিন্ন বক্তব্যের রূপায়ণ ঘটায়। আল মাহমুদের কবিতার পরিমণ্ডলে উপমার বিপুল ব্যবহার বক্তব্যকে স্পষ্ট করতে সহায়ক হয়ে ওঠে। আগামীর একটি বিশুদ্ধ সময় মানুষের জন্য অপেক্ষায় আছে- এধরনের নির্মল বিশ্বাসের প্রতিভাস তার বিশুদ্ধতা ফুলের পাঁপড়ির মতো পেলবতা মখমল সৌন্দর্যে জাগরুক। তার প্রাণবন্ত কবিতা মানুষের মনোজগতে নানাভাবে জায়গা করে নেয়। জাগতিক জীবনের বিভিন্ন অনুভূতি আল মাহমুদের কবিতায় অনুরণিত হয়।
রাজনৈতিক ঘটনাবলি, প্রেমস্মৃতি, নিসর্গ প্রভৃতি তাঁর কবিতায় অন্তর্ভুক্ত হতে দেখ যায়।
তিনি উপমাকে প্রাধান্য দিতে মনোযোগী হন। উপমাকে অবলম্বন করে তিনি কবিতাকে সংজ্ঞায়িত করেন। তার কবিতা উপমাপ্রধান। কিন্তু কোনো উপকরণ তার কাছে উপেক্ষিত নয়। আল মাহমুদ উপমার পাশাপাশি অন্যান্য উপাদান দিয়ে নানা বিষয়কে কবিতায় উপজীব্য করেন। তাঁর কবিতার স্থাপনায় সব রঙের স্পর্শ করান তিনি সযত্নে। তাঁর লৈখিক নৈপুণ্যে কবিতা ভিন্ন আস্বাদে উপস্থাপিত হয়। তাঁর সংক্ষুব্ধ উচ্চারণ কবিতাকে চৌচির করে না । বরং তার সংঘবদ্ধ প্রতিবাদ অখণ্ড বিক্ষোভে বাতাসকে খণ্ডিত করে। আল মাহমুদ কবিতায় বহুমুখি অনুষঙ্গের বিস্তার ঘটান। বিষয়ের বিস্তর গেরস্থালী তাঁর কবিতায় লক্ষ্য করা যায়। তিনি কবিতাকে সংজ্ঞায়িত করেন নানা বিষয়ের আবর্তে। উপমাকে অবলম্বন করে তিনি উচ্চারণ করেন-
‘কবিতা তো কৈশোরের স্মৃতি
সেতো ভেসে ওঠা ম্লান
আমার মায়ের মুখ।
নিম ডালে বসে থাকা হলুদ পাখিটি
পাতার আগুন ঘিরে রাত জাগা
ছোট ভাই বোন।
আব্বার ফিরে আসা
সাইকেলের ঘণ্টাধ্বনি
রাবেয়া রাবেয়া...
আমার মায়ের নামে খুলে যাওয়া
দক্ষিণের ভেজাল কপাট।’
আল মাহমুদের কবিতায় খণ্ড খণ্ড ছবি দুলে ওঠে। নাগরিক জীবনের দুর্বার কোলাহলের বাইরের একটা শীতল স্নিগ্ধ শান্ত চঞ্চল অনুভূতির জীবন সন্ধান তাঁর কবিতায় খুঁজে পাওয়া যায়। তাঁর চেতনা ও মননে সমাজের যে সব ঘটনা প্রবাহ তোলপাড় তোলে সে সব বিষয় তিনি কবিতায় তুলে ধরেন । তাঁর কবিতায় শব্দবদ্ধ হয় সমাজ প্রগতির ভাবনা ও জীবনঘনিষ্ঠতা। আল মাহমুদের কবিতা উপমার মাধ্যমে ঘটনা প্রবাহ ও দৃশ্যমানতা তৈরি করে। কুয়াশায় ঢাকা পথ ভোরের আজান, বাঁশঝাড়ে ঘাসে ঢাকা দাদার কবর কিংবা মক্তবের মেয়ে চুল খোলা আয়শা আক্তারের মতো প্রসঙ্গের সংযোজন তাঁর কবিতাকে বহু অর্থময় এবং বহু চিত্রে চিত্রিত করে।
এই বিরলপ্রজ কবি আল মাহমুদ ১৯৩৬ সালের আজকের দিনে (১১ জুলাই) ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থসমূহ ‘কালের কলস’, ‘সোনালি কাবিন’, ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠে’, ‘আল মাহমুদের কবিতা’। এসবগুলো গ্রন্থই পাঠক মহলে বিশেষভাবে সমাদৃত হয়েছে। আল মাহমুদের সমগ্র লেখালেখিতে সাহিত্য ভাবনার নানামাত্রা অঙ্কিত তাঁর কবিতায় পরিণত মনের প্রতিফলন স্পষ্টভাবে দেখা যায়।
ধ্বংসের তুমুল উৎসবের মধ্যে তিনি সৃষ্টির উল্লাস করেন। বৈরী বাতাসে লণ্ডভণ্ড হওয়া সাজানো ভুবন আল মাহমুদ কবিতার মতো বিনির্মাণ করতে ব্রতী হন। তিনি গোটা সমাজকে সুসজ্জিত ও সুনির্মিত করতে তাঁর প্রাজ্ঞ ভাবনা কবিতায় তুলে ধরেন। প্রত্যাশিত সীমানা তিনি প্রতিদিন স্পর্শ করেন। মানুষ জীবন সংগ্রামের বিচিত্র প্রবাহে নিজস্বতা থেকে ক্রমশ সরে যায়। শেকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এগিয়ে যায় সামনে ভিন্ন পথে অজানা গন্তব্যে। নিরাসক্ত এ যাত্রা জীবন থেকে ফেরা হয় না সহজে। প্রত্যাবর্তন যদি কখনো ব্যর্থতার হয় তাও হতে পারে আনন্দের, সুখের ।
এখানে আল মাহমুদের ‘প্রত্যাবর্তনের লজ্জা’ কবিতার উদ্বৃতি দেয়া যেতে পারে। শেষ ট্রেন ধরবো বলে এক রকম ছুটতে ছুটতে স্টেশনে পৌঁছে দেখি নীল বর্ণ আলোর সংকেত। হতাশার মতোন হঠাৎ দারুণ হুইসেল দিয়ে গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে। যাদের সাথে শহরে যাওয়ার কথা ছিল তাদের উৎকণ্ঠিত মুখ জানালায় উবুড় হয়ে আমাকে দেখছে। হাত নেড়ে সান্ত্বনা দিচ্ছে। আসার সময় আব্বা তাড়া দিয়েছিলেন গোছাতে গোছাতেই তোর সময় বয়ে যাবে। তুই আবার গাড়ি পাবি! আম্মা বলছিলেন আজ রাত না হয় বই নিয়েই বসে থাক কত রাততো এমন থাকিস। এক নিঃস্বপ্ন নিদ্রায় নিহত হয়ে থাকলাম। অবশেষে গাড়ি হারিয়ে ফিরে আসা। মায়ের মোহন মুখ থেকে বেরিয়ে আসে সেই চিরাচরিত বাণী ভালোই হলো তোর ফিরে আসা। তুই না থাকলে ঘর বাড়ি একেবারে শূন্য হয়ে যায়। এভাবে গাড়ি হারানোর ব্যর্থতাকে ফিরে আসার আনন্দে প্রিয় মুখদের সান্নিধ্য সুখে আল মাহমুদ রূপান্তরিত করেন। তার কবিতায় আনন্দ-বিষাদের মিলিত ছবি দুলে ওঠে। অবলোকন শক্তির কাছে আল মাহমুদের কবিসত্ত্বা সমর্পিত হয়। সত্যের সন্ধানে তিনি উদয়াস্ত পরিভ্রমণ করেন পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তর। তাঁর যাত্রাপথ সত্যের সতত আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। তিনি স্বপ্নের সানুদেশে কবিতার অসংখ্য বীজ রোপণ করেন। সেই বীজ থেকে বৃক্ষ পুষ্প পত্রাবলিতে পরিপূর্ণ, পরিণত হয়। তাঁর কবিতায় নিসর্গের নিবিড় সম্পর্ক পরিস্ফুটিত হয় । তাঁর কবিতার বিষয় এবং উপকরণের মিশ্র রূপ আমাদের সমস্ত হৃদয়স্ত গ্রাস করে। নিসর্গ আর উপমা তাঁর কবিতায় এক সাথে উঠে আসে। তিনি উপমার উপস্থাপন কৌশলে নিসর্গকে নির্ধারণ করেন। তিনি নিসর্গকে নিপুণভাবে কবিতায় প্রযুক্ত করেন। তিনি নিসর্গ চেতনায় আপ্লুত হন। তাঁর কবিতার কলস্বরে নিসর্গ মুখরিত হয়ে ওঠে। তিনি লেখেন :
‘একদা এক অস্পষ্ট কুঁয়াশার মধ্যে আমাদের যাত্রা
তারপর দিগন্তে আলোর ঝলকানিতে আমাদের পথ
উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো। বাতাসে ধানের গন্ধ
পাখির কাকলিতে মুখরিত অরণ্যানী।
আমাদের সবার হৃদয় নিসর্গের এক
অপরূপ ছবি হয়ে ভাসতে লাগলো।’
আমাদের আভূমি ঘিরে শত্রুদের উল্লসিত উৎসব মাখন আহত করে রাখে। তখনও পালাবার প্রাণান্ত চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায় অন্তর্ভেদী সব ঘটনাবলি আল মাহমুদ অবলোকন করে শব্দসমুদ্রে অবগাহন করেন। তিনি কবিতা দিয়ে অশুভ দৃশ্যের আঘাত রোধ করেন।
‘পলাতক বলে লোকে। বুকে বড়ো বাজে।
আমিতো এখন জীবনের জলাধারে হতে চাই
তুমুল রোহিত।
কোথায় পালাবো আমি যেখানে রাতেও
নারীর নিঃশ্বাস এসে চোখে মুখে লাগে
বুকে লেগে থাকে ক্লান্ত শিশুর শরীর।
বলো পালাবো কোথায়।’
জীবনের পক্ষে তাই সারাদিন দরোজা ধরে থাকি। বেদনার বিপুল আঘাত মেনে নিয়ে চির সহিষ্ণুতার মতো স্বসীমানায় অনড় দাঁড়িয়ে সযত্নে কবিতার মধ্যে নানা দায়বদ্ধতা অক্ষমতা সাফল্য স্বপ্নের বৃত্তান্ত আল মাহমুদ তুলে ধরেন। যাপিত জীবনের বহু অর্জন এবং অপ্রাপ্তির হতাশা তার কবিতায় মর্মরিত হয়। আল মাহমুদের কবিতা জাগতিক জীবনের রকমারি ঘটনা বিষয় বৈচিত্র্য উপমার প্রয়োগ নিসর্গের নিবেদন এবং শব্দ যোজনার একান্ত ঐক্যে ঐতিহ্যপূর্ণ। আল মাহমুদের স্বনির্মিত বৈভব নিজস্ব নান্দনিকতায় উজ্জ্বল। তার কবিতার কাছে পরাজিত হয়ে আঁধার আত্মত্যাগী হয়। তার কবিতা স্তব্ধতাকে চলমান করে। নিস্তব্ধতাকে ভেঙে দেয় সরব কোলাহলে। স্থির অনুভূতিকে তরঙ্গিত করে। আল মাহমুদ কবিতায় একই সাথে বহু বক্তব্যকে ধারণ করেছেন। মানুষকে মহৎ করে তার মানবিক বোধ। হৃদয় হয়ে ওঠে মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের পরিচালক। কবিরা কখনো পরাজিত হন না। এই উপলব্ধিতে তিনি সগৌরবে উচ্চারণ করেন :
‘সোনার দিনার নেই দেনমোহর চেয়ো না হরিণী
যদিও নাও দিতে পারি আমার কাবিনবিহীন হাত দুটি
আত্ম বিক্রয়ের স্বর্গ কোনো কালে সঞ্চয় করিনি।
আহত বিক্ষোভ করে চারিদিকে চতুর ভ্রুকুটি
ভালবাসা দাও যদি আমি দেব আমার চুম্বন।
ছলনা জানি না বলে আর কোনো ব্যবসা শিখিনি’
আল মাহমুদের বহুমাত্রিক কবিতার বাণী কল্লোলিত করে এদেশের কাব্যজগত। তিনি কবিতার আস্বাদ ছড়িয়ে হেঁটে যান আদিগন্তে। তার ফেলে যাওয়া পথ আলোকিত হয়। বর্ণিলতা ধুসর দিগন্তকে আবৃত করে। মুক্ত বাতাসে তার কবিতার সতেজ শিল্প বেরিয়ে পড়ে। প্রবাহিত হয় সর্বত্র।
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক