এবারের বিশ্বকাপকে কি সহজে ভুলে যাওয়া যাবে?
দ্য রিপোর্ট ডেস্ক: অনেকেই বলছেন, এবারের মতো বিশ্বকাপ নাকি অনেক দিন হয় নি।
বিবিসি জানাচ্ছে, আজ ফাইনাল, কাল থেকেই অতীত হয়ে যাবে বিশ্বকাপ ফুটবল ২০১৮। ফ্রান্স বা ক্রোয়েশিয়া - এ দুটি দেশের কোন একটি আজ জিতে নেবে ট্রফি, যবনিকাপাত হবে এক মাসের বিশ্ব কাঁপানো ফুটবল উৎসবের।
কিন্তু এবারের এই টুর্নামেন্টকে কি ভুলে যাওয়া যাবে এত সহজে? অনেকেই বলবেন, এবারের বিশ্বকাপের মতো অপ্রত্যাশিত নাটকীয়তা-উত্তেজনায় ভরা, সব হিসেবনিকেশ উল্টে দেয়া বিশ্বকাপ বোধ হয় নিকট অতীতে হয় নি।
গ্রুপ পর্ব থেকেই শুরু হয়েছিল নাটকীয়তা
একবার মনে করে দেখা যাক, যেদিন বিশ্বকাপ শুরু হয়েছিল সেদিন ফুটবলপ্রেমীরা কি বলছিলেন।
কে হবেন এবারের চ্যাম্পিয়ন? ভক্ত থেকে সমর্থক, ফুটবল পন্ডিত থেকে বিশ্লেষক সবাই বলছিলেন ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, জার্মানি, স্পেন বা পর্তুগালের নাম।
বলা হচ্ছিল, ২০১৪ সালে নিজের দেশে ৭-১ গোলে জার্মানির কাছে হারার লজ্জা এবার ঘুচিয়ে দেবেন নেইমার-কুতিনিও-মার্সেলোরা।
কেউ বলছিলেন, পৃথিবীর সেরা ফুটবলার হয়েও লিওনেল মেসির বিশ্বকাপ জিততে না-পারার অসম্পূর্ণতা এবারই শেষ হবে।
কেউ ভেবেছিলেন, রোনাল্ডো পর্তুগালকে ইউরো জিতিয়েছেন, এবার বিশ্বকাপও জেতাবেন তিনি।
অন্য অনেকে মাথা নেড়ে বলেছিলেন, না - জার্মানি। ঠান্ডা মাথার জার্মানি। বড় বড় তারকা সমৃদ্ধ দলকে ঠান্ডা মাথায় উড়িয়ে দিয়ে জার্মানিই হবে চ্যাম্পিয়ন, যা তারা আগে অনেকবার করেছে।
কিন্তু শেষে কি হলো? ফ্রান্সের নাম অনেকে করেছিলেন বটে, কিন্ত ক্রোয়েশিয়া? জুন মাসে কেউ ফাইনালিস্ট হিসেবে ক্রোয়েশিয়ার নাম বললে লোকে তাকে হয়তো হেসেই উড়িয়ে দিতো, বা পাগল ভাবতো।
কিন্তু ৪০ লাখ লোকের দেশ সেই ক্রোয়েশিয়া আজ ফাইনাল খেলছে। ফ্রান্স গ্রুপ পর্বে তেমন উজ্জ্বল ছিল না কিন্তু শেষ ১৬তে আর্জেন্টিনাকে হারানোর পরই তাদের খেলায় এক অন্যরকম আত্মবিশ্বাস এসে গেল।
কিন্তু ব্রাজিল কোয়ার্টার ফাইনাল পার হতে পারলো না - হেরে গেল ইউরোপের নতুন শক্তি বেলজিয়ামের কাছে।
লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনা শেষ-১৬তে হেরে গেল ফ্রান্সের কাছে। জার্মানি - যারা গতবারের চ্যাম্পিয়ন -গ্রুপ পর্ব পার হতে পারলো না।
তারকা সমৃদ্ধ দল স্পেন সবাইকে স্তম্ভিত করে বিদায় নিল রাশিয়ার কাছে হেরে - যে রাশিয়াকে শুরুতে ধরা হয়েছিল দুর্বলতম স্বাগতিক দেশগুলোর একটি হিসেবে।
আর ক্রিস্টিয়ানো রোনাল্ডোর পর্তুগালও কোয়ার্টার শেষ-১৬তে বাদ পড়লো উরুগুয়ের কাছে হেরে।
তীব্র উত্তেজনাপূর্ণ এক একটি খেলা
এবারের বিশ্বকাপে একের পর এক তীব্র উত্তেজনা আর প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ভরা ম্যাচ উপভোগ করেছেন ফুটবলপ্রেমীরা।
একেবারে শুরুতেই বলতে হয় স্পেন আর পর্তুগালের ম্যাচটির কথা, রোনাল্ডোর সেই বাঁকানো ফ্রিকিকে ৮৮ মিনিটে ৩-৩ সমতা আনার কথা।
গ্রুপ পর্বে জার্মানি কিভাবে শেষ মুহুর্তের ফ্রি কিকে সুইডেনকে হারালো, বা দক্ষিণ কোরিয়া কিভাবে জার্মানিকে হারালো - সেই ম্যাচগুলোর স্মৃতি সহজে ভোলার নয়।
তেমনি আরেকটি তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ম্যাচ ছিল জাপান আর বেলজিয়ামের মধ্যেকার গ্রুপ পর্বের খেলাটি - যাতে নাসের চাদলি একেবারে শেষ মুহুর্তের গোলে জয় এনে দেন বেলজিয়ামকে।
এমনকি ফ্রান্স যে খেলাটিতে ৪-৩ গোলে আর্জেন্টিনাকে হারায় - তাতেও শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত টান-টান উত্তেজনা ছিল।
ক্রোয়েশিয়া এগিয়েছে অপ্রতিহত গতিতে
ক্রোয়েশিয়ার কথা সম্ভাব্য ফাইনালিস্ট হিসেবে শুরুতে কেউ ভাবেননি। যখন তারা তাদের গ্রুপের খেলায় আর্জেন্টিনাকে তিন গোলে হারালো, তিনটি খেলাতেই পুরো পয়েন্ট তুলে নিলো - তখনই হয়তো সবার নড়ে চড়ে বসার কথা।
বলতেই হবে ক্রোয়েশিয়া এবার বিশ্বকাপে অপ্রতিহত গতিতে এক একটি ধাপ পার হয়েছে - কেউ তাদের আটকাতে পারে নি।
দেখা গেল, তারকা সমৃদ্ধ ল্যাটিন আমেরিকান দলগুলোকে একের পর এক বিদায় করে দিচ্ছে ইউরোপের দলগুলো - তাদের পরিকল্পিত, সুশৃঙ্খল এবং পরিশ্রমী ফুটবল দিয়ে।
ফুটবলে এলো ভিডিও রেফারি
ফুটবল খেলায় ভিডিও রেফারি চলবে না - এমন বহু আপত্তি সত্বেও শেষ পর্যন্ত বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর এই বিশ্বকাপেই প্রথম ব্যবহৃত হলো ভিডিও এ্যাসিস্টেন্ট রেফারি বা ভি এ আর।
কিছু বিতর্ক থাকলেও সাধারণভাবে সবাই স্বীকার করেছেন ফুটবলে এ এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
অনেক খেলার ফল বদলে গেছে ভি এ আরের কারণে।
দারুণ সব ফ্রি-কিক, দারুণ সব গোল
ডেভিড বেকহ্যামের বাঁকানো ফ্রি-কিক এতই বিখ্যাত হয়েছিল যে পরবর্তীকালে একটি সিনেমার নাম হয়েছে 'বেন্ড ইট লাইক বেকহ্যাম' - যা হয়তো অনেকেই দেখে থাকবেন।
কিন্তু এখন বলতে হবে, এ যুগের ফুটবলাররা অনেকেই এমন ফ্রি-কিকের কৌশল বেশ ভালো ভাবেই শিখে গেছেন।
পর্তুগালের ক্রিস্টিয়ানো রোনাল্ডো, ব্রাজিলের ফেলিপ কুতিনিও, জার্মানির টোনি ক্রুস, এমনকি ইংল্যান্ডের কিয়েরান ট্রিপিয়ারও এবার প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডারদের ফাঁকি দিয়ে জালে-ঢুকে-যাওয়া অবিশ্বাস্য সব ফ্রি-কিক থেকে গোল করেছেন।
মেসি আর রোনাল্ডো
এ যুগের দুই সেরা ফুটবলার - যারা সর্বকালের সেরাদেরও অন্যতম বলে মানা হয়। তারা নিজ নিজ দেশকে বিশ্বকাপ এনে দিতে পারেন কিনা, তা ছিল ভক্তদের এক বড় আকাঙ্খার বিষয়।
যেমনটা পেরেছেন পেলে, মারাডোনা, জিনেদিন জিদান, বা ব্রাজিলিয়ান রোনাল্ডো।
মেসি আর রোনাল্ডো এটা না পারলে যেন বিশ্বসেরা ফুটবলারদের হল অব ফেমে জায়গা পাবেন না - এমনই কথা বলা হচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত পারেন নি তারা, ভক্তদের হতাশায় ডুবিয়ে বিদায় নিয়েছেন।
বিশ্বকাপে কি আর দেখা যাবে মেসি বা রোনাল্ডোকে? হয়তো যাবে, হয়তো না।
আগামি বিশ্বকাপ নাগাদ রোনাল্ডোর বয়েস হবে ৩৭, মেসির ৩৫।
যদি তাদের আর দেখা না যায়, তাহলেও ২০১৮র বিশ্বকাপকে ভক্তেরা মনে রাখবেন হয়তো তাদের প্রিয় তারকার শেষ বিশ্বকাপ হিসেবে।
(দ্য রিপোর্ট/একেএমএম/জুলাই ১৫,২০১৮)