রিকসাশিল্পের কথকতা-শেষ
রঙের জ্বলন্ততা
বাংলা চিত্রকলার গোড়ার কথা আসলেই আমাদের পটচিত্রে ফিরে যেতে হয়। আর পটচিত্রের কথা এলেই অতি উজ্জ্বল রং-তুলির সরু বলিষ্ঠ রেখা, নানা পৌরাণিক বীরত্বগাথা গল্পের কথা মনে এসে যায়। পটচিত্র বাংলার একান্ত নিজস্ব রীতি, ঠিক তেমনি রিকসাচিত্রের দিকে তাকালে আমরা আমাদের সেই রীতি, পরম্পরা অনুসরণ করবার চেষ্টা দেখতে পাই। রিকসাশিল্পে এখনো রং ব্যবহারের ক্ষেত্রে খুবই উজ্জ্বল রং-কে প্রাধান্য দেয়া হয়। ফ্লোরোসেন্ট সবুজ, গাঢ় লাল এর মত রং ব্যবহার করা হয়। রিকসা যেহেতু আপাদমস্তক শিল্পধারা বহন করে, ফলে রিকসার এমন একটি ইঞ্চিও পাওয়া যায় না যেখানে রঙের উজ্জ্বলতা নেই। তা কখনও রঙে, কখনও বা রঙিন প্লাস্টিক ব্যবহারের মাধ্যমে। রিকসার হুড, পেছনের বোর্ড থেকে সামনের সিট কিংবা হ্যান্ডেলের সামনে তার বডিতে প্রতিটি কোণায় শিল্পের ছোয়া যেন “একটি স্বপ্নময় রঙিন চলন্ত জগৎ”।
শিল্পের মান বিচার
লেখক জোয়ানা কির্ক প্যাট্রিক তার রিকশাশিল্পের সংজ্ঞায় বলে, “এটা সম্প্রদায় শিল্প বিবেচনা করি”। যেহেতু এটা ঋড়ষশষড়ৎরপ; ফলে ধর্মীয়, রাজনৈতিক, সামাজিক সকল বিষয় রিকশাচিত্রে দেখা যায়। শিল্পের মান বিচারে বলতে গেলে পটচিত্র যেমন আমাদের অতি সমৃদ্ধ চিত্রকলা হিসাবে বিবেচিত, তেমনি রিকশাচিত্রকে তারই অনুসারী হিসাবে বিবেচিত করা যেতে পারে। রিকশা চিত্রশিল্পীরা তার কাল্পনিক জগতকে আরও রঙ্গিন করে উপস্থাপন করেন। প্লেটো বলেন,“চিত্রকলা, ইমিটেশন বা নকল যা সত্যের চেয়েও অধিক সত্য”। আমরা যদি পাশ্চাত্যেও প্রোথিতযশা শিল্পী কনস্টেবল বা টার্নার এর ল্যান্ডস্কেপ দেখি, এক অতি বাস্তবিক-স্বপ্নময় জগৎকে চিত্রগুণে সমৃদ্ধ করে হাজির করেছেন তারা। আবার আমরা fauvism শিল্পীদের ছবিতে অতি গাঢ় রঙের যে ব্যবহার দেখি, তাতে করে আমাদের পটচিত্রের অনুযায়ী রিকসাচিত্রও আমাদের স্বপ্নময় অথচ এক রঙ্গিন দুনিয়ায় নিয়ে হাজির করে। শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিল্পের সংজ্ঞায় বলেছিলেন, “সুন্দর তাই সুন্দর”। সুন্দরকে কোনো ফ্রেমে বন্দি করা যায় না। এটি উপলব্ধিগত বিষয় মাত্র। তা একটি নয় প্রত্যেকটি ইন্দ্রিয়কে নাড়া দিতে সক্ষম। রিকসাশিল্পের মান বিচারে তা একটি জনগোষ্ঠীর নিজস্ব ধারণাকে বহন করে বেড়াচ্ছে সদর্পে।
বিষয় আঙ্গিকের দিকে তাকালেও আমরা দেখি তা অত্যন্ত আধুনিক। বর্তমান সময়কে প্রাধান্য দিয়ে চিত্ররীতি ঠিক রেখে এক-একটি চিত্র রচিত হচ্ছে। সময়কে প্রাধান্য দিয়ে চলাই আধুনিক চিত্রকলার মূল বক্তব্য হওয়া উচিত বলে মনে হয়। সেই অনুযায়ী রিকসাচিত্রও আধুনিক সময়ের বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। আবার সব সময়ের অনুভূতির অপরিবর্তিত বিষয়গুলোও থাকে। ফলে রিকসাশিল্পকে শিল্পের মান বিচারে আধুনিক শিল্পের একটি অংশ হিসাবে বিবেচিত করা যায়।
একজন শিল্পী প্রকৃতির কাছে, সমাজের কাছে, একটি বা জাগতিক পৃথিবীর মনুষ্যকূলের কাছে নানা দিক থেকে ঋণী হয়ে থাকে। সেই ঋণ পরিশোধ করবার একমাত্র পথ হিসেবে সে চিত্রপটে সেই বিষয়গুলোকে তুলে ধরে। আমরা রিকসাশিল্পীদের চিত্রপটে দেখি পরম যত্নে মাকে স্মরণ করতে কিংবা ধর্মীয় অনুভূতিগুলোকে পরম বিশ্বাসের সাথে যত্নসহকারে প্রকাশ করতে। আবার প্রতিবাদী চরিত্র হয়ে নানা পশুপাখির প্রতিরূপকে ব্যঞ্জনাময় অবস্থানে রেখে তা প্রকাশ করতেও দেখি। বর্তমান পৃথিবীর রাজনৈতিক অবস্থার বিষয়কে সামনে আনতেও দেখা যায়। শিল্পী মানেই তো সচেতন এবং তা নিয়ত। রিকসাশিল্পীরা শিল্পের মান বিচারে কোথায় অবস্থান করেন তা বিবেচনা করা কঠিন। তবে, তাদের শিল্পরীতি মেনে চলার যে দৃঢ়তা তা অনুসরণযোগ্য বলে মনে হয়।
শিল্প-ইতিহাসের দর্পণ। ইতিহাসকে প্রতিবিম্বিত আয়নার মত করে শিল্প দেখিয়ে দেয়। সেই দিক থেকে রিকসাচিত্রও কালের সাক্ষীর মত করে চলমান অবস্থায় শিল্পকে হাজির করছে; শিল্প রসবোধ সমৃদ্ধ মানুষের কাছে। শহর সবসময়ই আধুনিকতাকে ধারণ করে চলে। ফলে রিকসাশিল্পের শিল্পীরাও আধুনিকতাকে ধারণ করে তা বিষয়বস্তু নির্বাচনের ক্ষেত্রে দেখা যায়। আবার, শিল্পী যে সমাজের মধ্যে বাস করে, তার নিজস্ব ধারণাও তার বাইরে নয়। নিজের চিন্তার মননও ওই সমাজেরই অংশ বিশেষ। ফলে নিজেকে ও সমাজকে একই ফ্রেমে এনে তিনি চিত্র রচনা করে থাকেন। অতি আধুনিকতা কখনও কখনও নিজস্বতাকে ধ্বংস করে। অতি যান্ত্রিকতা মনন প্রক্রিয়ায় চলা বোধগুলোকে স্থুল করে দেয়। তাই সূক্ষ্মবোধগুলো থেকে যায় ধারণার অগোচরে।
আমাদের এই প্রিয় শহরগুলোতে প্রতিদিন জীবিকার প্রয়োজনে হাজারো রিকসা চলাচল করে। গড়ে প্রতিদিন ৪০,০০০ হাজার রিকসা চলে রাজধানী শহর ঢাকায়। জীবিকার প্রয়োজনে রিকসাকে সাথে করে একজন শ্রমজীবী মানুষ শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে চলছে ঠিকই, কিন্তু নেপথ্যে অজান্তেই একটি শিল্পধারাকে সে বয়ে বেড়াচ্ছে।
‘আমি যে রিকসাওয়ালা, দিন কি এমনই যাবে
বরাবর পাগলা ভোলা-
নিশিদিন ফুল কুড়ায়ে, আমি যে রিকসাওয়ালা।’
গানের কথাগুলোর মতই দিন কি এমনই যাবে! আধুনিকতার ছোঁয়ায় রিকসায় এখন ইঞ্জিন এর ব্যবহার দেখা দিচ্ছে। দেখা দিচ্ছে তার সাজসজ্জার পরিবর্তন। পটপরিক্রমায় রিকসাশিল্পীরা যে রিকসাচিত্রকেই পেশা হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন, তারাই আজ শিল্পী জীবন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। নতুন শিল্পীর আগমনী বার্তাও যেন ক্ষীণকায়। শিল্পের মান বিচারে যে শিল্পের এতটা গৌরবময় উৎকর্ষতা, তা কি বেঁচে থাকবে আধুনিক বিশ্বায়নের এই মহাজাগতিক পৃথিবীতে?
লেখক : চিত্রশিল্পী ও সমালোচক
(দ্য রিপোর্ট/একেএমএম/জুলাই ২১,২০১৮)