ইমরান খানকে সন্দেহের চোখেই দেখছে দিল্লি
ক্রিকেটার থেকে রাজনীতিবিদে পরিণত হওয়া ইমরান খান ইসলামাবাদে ক্ষমতায় আসার ফলে ভারত পাকিস্তান সম্পর্কে ঠিক কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে, তা নিয়ে দুদেশের পর্যবেক্ষকরা যে একমত তা কিন্তু বলা যাচ্ছে না।
যেমন, ইমরানের মতো ব্যক্তিত্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ফলে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক নতুন করে ঝালিয়ে নেওয়ার একটা চমৎকার সুযোগ এসেছে বলে ইসলামাবাদে অনেকেই মনে করছেন।
কিন্তু আবার দিল্লিতে ভারতীয় বিশেষজ্ঞদের ধারণা, ইমরান খানের সাফল্যের পেছনে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর যে প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছিল তাতে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরও তিনি কতটা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবেন সেই সংশয় থেকেই যাচ্ছে।
পাকিস্তানের পালাবদল দুই দেশের সম্পর্কে আদৌ কোনও পরিবর্তন আনবে কি না, তা নিয়ে দুই দেশের পর্যবেক্ষকদেরই মতামত জানার চেষ্টা করেছিলাম।
একুশ বছরের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কেরিয়ারে ভারতের বিরুদ্ধে বহু স্মরণীয় জয় পেয়েছেন ইমরান খান।
কিন্তু ঠিক বাইশ বছর আগে রাজনীতিতে নামার পর দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি যে সেকেন্ড ইনিংস শুরু করতে যাচ্ছেন, তাতে তিনি কীভাবে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ককে অ্যাড্রেস করবেন তা নিয়ে আসলে এখনও বহু প্রশ্ন।
তবে পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব ও দিল্লিতে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করে যাওয়া রিয়াজ খোকার কিন্তু বেশ আশাবাদী।
মি খোকার বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, "দেখুন একজন সম্পূর্ণ আনকোরা নতুন নেতা, নতুন ব্যক্তি আর নতুন দল ক্ষমতায় এল - যেটা আমার মতে ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশের জন্যই সম্পর্কটা শুধরে নেওয়ার দারুণ একটা সুযোগ। তার জয়টা প্রশংসনীয় ছিল, ভারতও নিশ্চয় সেটা খেয়াল করবে।"
"আর ইমরানের পরিচিতি তো শুধু দক্ষিণ এশিয়াতে নয়, সারা দুনিয়া জুড়ে। তাকে ভারত সরকার উষ্ণ অভিনন্দনবার্তা পাঠালে আমি মনে করি সেটা দারুণ সৌজন্য হবে, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে এক নতুন সূচনারও জন্ম দিতে পারে।"
কিন্তু রাজনীতিবিদ ইমরান খান নানা সময়ে যে সব ভারতবিরোধী বিবৃতি দিয়েছেন, কিংবা কাশ্মীরে আত্মঘাতী হামলাকারীদের প্রতি পর্যন্ত সমর্থন জানিয়েছেন তাতে তাকে নিয়ে ভারতে একটা সন্দেহের বাতাবরণ আছেই।
ভারতের প্রাক্তন পররাষ্ট্র সচিব সালমান হায়দার অবশ্য মনে করেন, প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের ব্যক্তিগত ক্যারিশমা সেই ছবিটা কিছুটা পাল্টাতেও পারে।
মি হায়দার বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, "ইমরান খান একজন গগনচুম্বী ব্যক্তিত্ব, জীবনের নানা ক্ষেত্রে তিনি সাফল্য পেয়েছেন তাতে কোনও সন্দেহ নেই। তাকে এতদিন অত সিরিয়াসলি না নিলেও ভারতও এখন দেখছে তার দল ভাল ফল করছে, এবং অনেক চ্যালেঞ্জ সামলেও রাজনীতিবিদ হিসেবে তিনি নিজেকে ক্রমশ পরিণত করে তুলছেন।"
তবে ইমরান খানকে নিয়ে ভারতের সন্দেহের সবচেয়ে বড় কারণ, তিনি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর 'পছন্দের লোক'।
সালমান হায়দারের কথায়, "এই যে ইমরান খানকে আর্মির 'চোজেন ওয়ান' বলা হচ্ছে - তাতে তার কাজকর্মে কতটা স্বাধীনতা থাকবে সেটাই কিন্তু দেখার বিষয়। আমি এত তাড়াতাড়ি এটা নিয়ে কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছতে চাই না, তবে তারপরেও এটা নিয়ে প্রশ্ন কিন্তু থাকছেই।"
সাবেক পাকিস্তানি শীর্ষ কূটনীতিক রিয়াজ খোকারের মতে আবার এই আশঙ্কাটা একেবারেই অমূলক।
তিনি যুক্তি দিচ্ছেন, "নির্বাচন কিন্তু খুবই সুষ্ঠু ও অবাধ হয়েছে - এখানে কোনও প্রতিষ্ঠান বিশেষ কাউকে বেছে নিয়েছে তা মোটেও নয়। বিদেশি পর্যবেক্ষকরাও নির্বাচনী প্রক্রিয়ার প্রশংসা করেছেন, আর নওয়াজ শরিফের পার্টির জনপ্রিয়তাতেও যে ভাঁটা পড়েছিল তাতেও কোনও ভুল নেই।"
যদিও ভারতের ক্যাবিনেট সচিবালয়ে সাবেক স্পেশাল সেক্রেটারি রানা ব্যানার্জি এই যুক্তি মোটেও বিশ্বাস করছেন না।
মি ব্যানার্জির কথায়, "যদিও ইমরান বেশ ভালভাবেই জিতেছেন, এই জয়টা যে আর্মির সঙ্গে তার চুক্তি মোতাবেকই হয়েছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। ফলে আমি নিশ্চিত অন্তত পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে প্রথম দিকে তিনি আর্মির শেখানো বুলিই বলবেন।"
"হি উইল প্যারট দ্য আর্মি'জ পোজিশান। কাজেই পাকিস্তানের ভারত-নীতিতে চট করে কোনও পরিবর্তন হবে বলে আমি মনে করছি না।"
কিন্তু আবার পাকিস্তানে বেসামরিক সরকার ও আর্মির মতামত যদি একই হয়, সেক্ষেত্রে নতুন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ডিল করা ভারতের জন্য তো সুবিধাজনকও হতে পারে?
ভারতের সাবেক গোয়েন্দা প্রধান মি ব্যানার্জি জবাবে বলছেন, "পাকিস্তানি আর্মি আবার সেটাও পছন্দ করে না যে সিভিলিয়ান লিডারের মাধ্যমে কথাবার্তা বলা হোক। কারণ তারা চায় দেশের সিভিল সোসাইটির ওপর তাদের যে দাপট সেটা বজায় থাকুক!"
"এখন আবার নতুন একটা ভাবনাও হাওয়ায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছে ... পাকিস্তানি আর্মির সাবেক ব্রিগেডিয়ার ফিরোজ হাসান খান, যিনি এখন মার্কিন নাগরিক ও মন্টেরে-তে ইউএস ন্যাভাল স্কুলে পড়ান, তিনি হালে লিখেছেন পাকিস্তানি ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর মধ্যে সরাসরি আলোচনাটাই সম্পর্ক উত্তরণের একমাত্র রাস্তা!"
বিষয়টা নিয়ে যে দুদেশের নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের মধ্যে বেশ চর্চা হচ্ছে, তিনি সেটাও উল্লেখ করতে ভোলেননি।
ফলে ইমরান খানের জমানায় পাকিস্তান ও ভারতের সেনাবাহিনীর মধ্যেও সরাসরি একটা সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা হতে পারে, এই ইঙ্গিতও তাই উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে।
কিন্তু ইমরান খানকে নিয়ে ভারত যে খুব আশাবাদী বা তিনি দুদেশের সম্পর্ককে রাতারাতি বদলানোর ক্ষমতা রাখেন বলে দিল্লি বিশ্বাস করে - বিষয়টা মোটেও সেরকম নয়!
সূত্র: বিবিসি
(দ্য রিপোর্ট/একেএমএম/জুলাই ২৬,২০১৮)