গল্প
বুলেট, মাদক ও আমি
প্রান্ত সাহা
হতাশায় মোড়ানো ছোট্ট হৃদয়টাকে নিয়ে একা এক গভীর রাতে হাঁটছিলাম। হাতে সফরসঙ্গী কালো কোকাকোলার বোতলটা। উদ্দেশ্য গলা শুকিয়ে গেলে একটু ভিজিয়ে নিব।
হাঁটছি তো হাঁটছি। সেদিন পথটাও বুঝি শেষ না হবার জেদ করেছে।
হঠাৎ কারা যেন পেছন থেকে ডাকছে। দাঁড়া....দাঁড়া বলছি। আমি একটু ভয় পেয়ে গেলাম। তারপর ভেবে বসলাম, "তারাও বুঝি আমার মতই হতাশায় হাবুডুবু খাওয়া রোগী। মনে মনে খুশি হলাম। জীবন্ত সফরসঙ্গী পেলাম বুঝি এবার।
ঠুস...ঠুস...ঠুস-ঠুস-ঠুস...ভাল করে সবগুলো শব্দ কানে আসার আগেই আমি ভূমি মাতার বাহুতে শুয়ে পড়লাম। কী হলো? আমার শরীর থেকে রক্ত পড়ছে। চোখ পুরো অন্ধকার।
একটু একটু শুনছিলাম। "মাদক-ব্যবসায়ী মারলাম আরেকটা।"
কেউ একজন আমাকে ভাল করে হয়তো দেখে বলল, "আরে এ কী করলাম! ওর হাতে তো কোকাকোলার বোতল। আমাদের সন্দেহের বুলেট আরেকজনের শরীরে! কী হবে?"
এরমধ্যে আমার সুখপাখি আমার শরীর ত্যাগ করেছে।যমরাজ স্বয়ং উপস্থিত আমাকে নিতে। কী সৌভাগ্য বলুন!
খুব অনুরোধ করে বললাম,"প্রভু আমার তো অকাল মৃত্যু হয়েছে। সব ইচ্ছা পূরণ করতে পারলাম না। আপনি তো প্রভু (তেল মারছিলাম আরকি) আপনি কি আমার মাএ একটা ইচ্ছা পূরণ করবেন না?"
-আচ্ছা আচ্ছা বলে ফেল। এটা আবার কী কঠিন ব্যাপার! নিজ প্রাণ ছাড়া যা চাও সব পাবে।
-আমার আত্মাটাকে আপনি দয়া করে আজকের দিনটার জন্য পৃথিবীতে থাকার অনুমতি দিন। দিন শেষ হতেই আমি আপনাকে স্মরণ করব। আমাকে নিয়ে যাবেন আপনার সাথে।
যমরাজ বললেন, "ঠিক আছে, যাও একদিন।"
২.
পাশে দাঁড়ানো বয়স্ক চাচা পুলিশটা বলতেছিল, "এখন এই লাশের কী জবাব দিব ? আমরা তো ভুল মানুষকে ফায়ার করলাম। এখন কী হবে?"
-"আরে চাচা আপনি ভয় পাবেন না। আমরা সব দেখে নিব।"
তারা আলোচনা করল। অনেক আলোচনা। রাত প্রায় শেষ। আলো ফুটবে প্রায়।
সকাল হলো, সাংবাদিক এলো, জনতা এলো। আমার পাশে কোকাকোলার বোতলটা নেই! এটা কী হলো ?
পাশে পড়ে আছে ২০০ ইয়াবা, একটা মদের বোতল। বলতে ভুলে গেছি, আমার পকেটের কলমটারও হদিস পাই নি। তবে নতুন কিছু ছিল। একটা চকচকে পিস্তল। বাহ্। জীবনের আরেকটা সখ মরে গিয়ে পূরণ হলো। ছোট বেলায় কতো গুলি করেছি। সব নকল বন্দুক। আসল বন্দুক পকেটে থাকবে স্বপ্ন ছিল। আজ মরে গিয়ে পূরণ হলো।
চারদিকে ক্যামেরা, ছবি তোলা হচ্ছে। লাইভ ক্যাভারেজ। আজ পুলিশের অভিযানে এক মাদক ব্যবসায়ী নিহত। আরো খোঁজ নেওয়া হলো।
-নাম-প্রান্ত সাহা।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাএ। আরো তোলপাড় হচ্ছে।
ক্যাম্পাসের কেউ কাঁদছে, কেউ চুপ-হতবাক। প্রান্ত এমন ছিল? ছিঃ..ছিঃ
আমি দেখছি। অবাক হচ্ছি। আমি হাসছি-আমিও কাঁদছি। বাবা-মা-বোন কাঁদছে যে।.......
আমাকে শশ্মানে নেওয়া হলো। আজ মানুষ কম।মাদক ব্যবসায়ী তো আমি। আসবেই বা কেন? কথায় যুক্তি আছে না ?
সময় শেষ, কথা রাখতে হবে। যমরাজ বলার আগেই উপস্থিত।কী জানি, কচি আত্মার প্রতি তার লোভ বেশী হবে হয়তো।
আমি আকাশ ভেদ করছি। সপ্ত আকাশ শেষ। আমি যমালয়ে। একটু পর আমার ইহকালীন পাপ-পুণ্যের হিসাব হবে। কিন্তু আমি ভেবেই চলেছি,"এখন আমার বাবা-মার কি হবে?"
আমার কী পাপ ছিল?
(উৎসর্গ:`বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত নিরপরাধ মানুষদের জন্য।)