দ্য রিপোর্ট ডেস্ক : সিরিয়ার শেষ বিদ্রোহী অধ্যূষিত অঞ্চল ইদলিবে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে অভিযান চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে সিরিয়ার সরকারি বাহিনী ও তাদের মিত্র রাশিয়া। এর মাধ্যমে সাত বছর ধরে চলতে থাকা সিরিয়া যুদ্ধ হয়তো চূড়ান্ত পর্বে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। খবর- বিবিসির।

ইদলিব কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?

গত সাতবছরে যেই জিহাদি সংগঠন ও বিদ্রোহী দলগুলো সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদকে উৎখাত করার চেষ্টা করেছে, তাদের সবশেষ শক্ত ঘাঁটি এই ইদলিব।

জাতিসংঘের বক্তব্য অনুযায়ী, ইদলিবের মোট জনসংখ্যা প্রায় ২৯ লাখ, যাদের মধ্যে ১০ লাখই শিশু।

ইদলিবের বেসামরিক নাগরিকদের অর্ধেকের বেশীই এসেছে একসময় বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে থাকা সিরিয়ার বিভিন্ন এলাকা থেকে। যুদ্ধের সহিংসতা থেকে বাঁচতে সেসব জায়গা থেকে তারা হয় স্বেচ্ছায় পালিয়ে এসেছে, অথবা তাদের বাধ্য করা হয়েছে এলাকা ছাড়তে।

ইদলিব প্রদেশের উত্তরে রয়েছে তুরস্কের সীমান্ত। আর দক্ষিণ-পশ্চিমের একটি অংশ জুড়ে রয়েছে আলেপ্পো থেকে হামা হয়ে রাজধানী দামেস্ক যাওয়ার মহাসড়ক। আর এর পূর্বদিকে ভূমধ্যসাগরের উপকূলীয় শহর লাটাকিয়া।

ইদলিবের নিয়ন্ত্রণ যদি সিরিয়ার সরকারি বাহিনীর হাতে চলে আসে তাহলে সিরিয়ায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কয়েকটি ক্ষুদ্র অঞ্চল বাদে আর কোথাও বিদ্রোহীদের ঘাঁটি থাকবে না। অর্থাৎ বিদ্রোহীরা কার্যত পরাজিত হবে।

ইদলিব নিয়ন্ত্রণ করে কারা?
ইদলিব প্রদেশটি কোনো একক নেতৃত্বের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় না। পরস্পরবিরোধী কয়েকটি দল - যাদের মোট আনুমানিক সৈন্যের সংখ্যা ৩০ হাজার - সম্মিলিতভাবে ইদলিব নিয়ন্ত্রণ করে।

আল-কায়েদার সাথে যুক্ত জিহাদি জোট হায়াত তাহরির আল-শামস (এইচটিএস) এসব দলের মধ্যে প্রভাবশালী।

প্রাদেশিক রাজধানী ও সীমান্ত দিয়ে তুরস্কে প্রবেশের পথ বাব আল-হাওয়াসহ ইদলিবের প্রধান প্রধান এলাকাগুলো নিয়ন্ত্রণ করে এইচটিএস।

এইচটিএস'এর আনুমানিক ১০ হাজার সৈন্য রয়েছে যাদের মধ্যে অনেকেই বিদেশী নাগরিক। জাতিসংঘ এটিকে জঙ্গী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

তুরস্ক সমর্থিত ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট (এনএলএফ) ইদলিবের দ্বিতীয় শক্তিশালী জোট। এইচটিএস'এর বিরুদ্ধে শক্তিশালী অবস্থান তৈরীর উদ্দেশ্যে কয়েকটি বিদ্রোহী দল এবছরই তৈরী করে এনএলএফ।

ফ্রি সিরিয়ান আর্মি ব্যানারের অধীনে কার্যক্রম চালানো কয়েকটি ছোট দলসহ কট্টরপন্থী ইসলামিস্ট দল আহরার আল-শামস ও নূর আল-দিন আল-জিঙ্কি সংগঠনের সৈন্যরা এই জোটের সদস্য।

সিরিয় সরকার এখন ইদলিব অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছে কেন?
সিরিয়া যুদ্ধের ঘটনাপ্রবাহ বর্তমানে প্রেসিডেন্ট আসাদের পক্ষে মোড় নিয়েছে। বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সিরিয়ার মিত্র রাশিয়া পরিচালিত বিমান হামলা এবং সিরিয়ার আরেক মিত্র দেশ ইরানের হাজার হাজার সৈন্যের সমর্থনে অন্যান্য অঞ্চলের বিদ্রোহীদের দমন করতে সক্ষম হয়েছে সিরিয় সেনাবাহিনী।

৩০শে অগাস্ট পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়ালিদ মুয়াল্লেম ঘোষণা করেন যে সরকারের প্রধান লক্ষ্য এখন ইদলিব 'স্বাধীন' করা।

পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী, সিরিয় সরকার বেসামরিক ক্ষয়ক্ষতি এড়িয়ে 'সন্ধি চুক্তি'র মাধ্যমে ঐ অঞ্চলের আধিপত্য দখল করতে চায়। কিন্তু পাশাপাশি 'ত্যাগের পরোয়া না করে' এইচটিএস'কে পরাজিত করার দৃঢ় সঙ্কল্পও ব্যক্ত করেন তিনি।

রাশিয়ার মতে, সিরিয় সরকারের পূর্ণ অধিকার রয়েছে 'নিজেদের এলাকায় জঙ্গীবাদের আশঙ্কা দমন' করার।

ইদলিবে সংঘর্ষ কামনোর উদ্দেশ্যে করা পূর্ববর্তী এক চুক্তির শর্ত কতটা পালিত হচ্ছে, তা পর্যবেক্ষণ করার উদ্দেশ্যে ইদলিবে তুরস্কের সৈন্যও রয়েছে। তথ্য অনুযায়ী, ইদলিবে যেন বিদ্রোহী নিধনে সর্বাত্মক অভিযান না চালানো হয় সেবিষয়ে রাশিয়ার সাথে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে তারা।

এরই মধ্যে ৩০ লাখেরও বেশী সিরিয় শরণার্থীকে আশ্রয় দেয়া তুরস্ক আশঙ্কা করছে ইদলিবে যুদ্ধ ছড়িয়ে পরলে নতুন করে তাদের সীমান্তে শরণার্থীদের ঢল নামবে।

ইদলিবের বাসিন্দাদের কী হবে?
পুরোদস্তুর সেনা অভিযান শুরু হলে প্রদেশটিতে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসতে পারে।

ইদলিবে লক্ষ লক্ষ মানুষ বর্তমানে মানবেতর জীবনযাপন করছে। সেখানকার অধিকাংশ আশ্রয়কেন্দ্রই অতিরিক্ত ঘনবসতিপূর্ণ, যেখানে জীবনধারণের জন্য আবশ্যক সেবা নিশ্চিত করাই কঠিন হয়ে পড়েছে।

ইদলিবে অভিযান চালানো হলে 'মানবিক সঙ্কট এমন পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে যা এই যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পরিলক্ষিত হয় নি' বলে সতর্ক করেছেন জাতিসংঘের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা।

জাতিসংঘের হিসেব অনুযায়ী অভিযান শুরু হলে প্রায় ৮ লাখ মানুষ ঘরছাড়া হতে বাধ্য হবে এবং মানবিক সঙ্কটে ভুগতে থাকা মানুষের সংখ্যা কয়েকগুণ বেড়ে যাবে।

বাস্তুচ্যুত মানুষের গন্তব্য পুরোপুরি অনিশ্চিত কারণ অনেক তুরস্ক আগেই নিজেদের সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে।

ইদলিবে আক্রমণ কি থামানো সম্ভব?
রাশিয়া, ইরান ও তুরস্ককে এখনই যুদ্ধে না জড়ানোর জন্য আহ্বান জানিয়েছেন সিরিয়ায় নিযুক্ত জাতিসংঘের বিশেষ দূত স্টাফান ডে মিস্তুরা।

সঙ্কট নিরসনে দু'টি সমাধান প্রস্তাব করেছেন তিনি - রাজনৈতিক সমাধান অর্জনের লক্ষ্যে আলোচনায় অংশ নেয়া; অথবা 'বেসামরিক নাগরিকদের অস্থায়ীভাবে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়ার উদ্দেশ্যে নির্ভরযোগ্য একটি চলাচলের পথ তৈরী করা।'

তুরস্ক চায় সিরিয়া ও রাশিয়া যেন এই অভিযান স্থগিত করে। এই সঙ্কটের বিষয়ে আলোচনা করার উদ্দেশ্যে তিন দেশের শীর্ষ নেতারা শুক্রবার ইরানে বৈঠক করবেন।

প্রেসিডেন্ট আসাদের বিরুদ্ধে হওয়া বিদ্রোহকে সমর্থন করা যুক্তরাষ্ট্র বলেছে সিরিয় সরকারের 'অতীত নৃশংসতা' ইঙ্গিত করে যে বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষার বিষয়ে তাদের বিশ্বাস করা যায় না। বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে রাশিয়ার হস্তক্ষেপ দাবি করেছে তারা।

(দ্য রিপোর্ট/এনটি/সেপ্টেম্বর ০৫, ২০১৮)