মাদকের গ্রাস ও নৈতিক মূল্যবোধ-শেষ
মোহাম্মাদ আনিসুর রহমান
(পূর্ব প্রকাশের পর) সাধারণত খুব সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে মসজিদে অথবা বাড়িতে আরবি শিক্ষার পাশাপাশি নৈতিক শিক্ষার চর্চা করা হত বাধ্যতামূলকভাবে, পারিবারিক চাপের কারণে। কখনো কখনো ঘুম ভাঙত হুজুরের লাঠির ভয়ে। স্কুলেও প্রতিদিন নৈতিক শিক্ষা দেওয়া হত। শপথ করানো হত। জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ানো হত। প্রতি সপ্তাহে স্কুলের বড় মাঠ পরিস্কার করানো হত। সবাই আমরা সেটা অনেক আনন্দ নিয়েই করতামও। আমরা অনেকেই জীবনে কখনো মার না খেলেও, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলের বেতের ভয় আমাদের প্রজন্মকে পথভ্রষ্ট করা থেকে বিরত রাখতে অনেক অবদান রেখেছে।
একজন শিক্ষকই তাঁর শিক্ষার্থীকে বের করে আনতে পারেন মাদকের নীল বিষের রাজ্য থেকে। পাশাপাশি শিক্ষা ব্যবস্থা শিক্ষার্থী বান্ধব হওয়া দরকার। শুভ ও বিবেকবোধসম্পন্ন নাগরিক বা মানুষ তৈরির জন্য যে নৈতিক ও ধর্মীয় জ্ঞান শিক্ষার্থীদের প্রয়োজন তা শেখানোর মত শিক্ষকের কি বড় অভাব ? ঢালাওভাবে শিক্ষক নিয়োগ না দিয়ে শিক্ষা নিয়ে খেলতে ও খেলাতে পারে এমন মেধাবী শিক্ষক দরকার যারা মন্ত্রমুগ্ধের মত শিক্ষার্থীকে আপন আলোয় উদ্ভাসিত করতে সহায়ক ভূমিকা রাখবেন। একাডেমিক, দর্শনগত, আদর্শগত, নৈতিক দিক দিয়ে দূর্বল মানের শিক্ষক থাকার কারণে মূল্যবোধ ও নৈতিক শিক্ষার ক্ষেত্রটা নষ্ট হচ্ছে, হয়েছে। জ্ঞানের আকাশে উন্মুক্ত বিহঙ্গের মত উড়তে শিখছেন না শিক্ষার্থীরা। মন্ত্রমুগ্ধের মত ঘন্টার পর ঘন্টা শিক্ষা দেওয়া ও নেওয়ার সেই কালজয়ী শিক্ষক যেমন তৈরি হবার সুযোগ নষ্ট হচ্ছে তেমনি একাডেমিক শিক্ষার পাশাপাশি নৈতিক ও আদর্শিক শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ বঞ্চিত শিক্ষার্থীরা অনায়াসে পথভ্রষ্ট হচ্ছে। সততা, মানবতা, নৈতিকতা, পারিবারিক বন্ধন, ভ্রাতৃত্ববোধ, সামাজিক সম্পর্ক, সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ, সুষ্ঠু সামাজিকীকরণ, দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য, নৈতিকতা ও সামাজিক মূল্যবোধের যে ঘাটতি নিয়ে বর্তমান প্রজন্ম বড় হচ্ছে এবং যেভাবে তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও গুণাগুণগুলো বিকশিত না হয়ে চরম বিপর্যস্ত হচ্ছে-তার দায় যেমন পরিবারের তেমনি রাষ্ট্র, সমাজ ও শিক্ষা ব্যবস্থা সে দায় এড়াতে পারে না।
সমাজের মধ্যে মানুষ এক অদৃশ্য সামাজিক সম্পর্কের শৃঙ্খলে আবদ্ধ। মানুষ সামাজিক জীব হওয়ায় মানুষের কাছে সামাজিক আচরণ প্রত্যাশিত ও কাঙ্ক্ষিত। সামাজিক শৃঙ্খলার ছন্দপতন, সামাজিক সম্পর্কের শিথিলতা এবং সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধের ক্রমহ্রাসমান অবক্ষয়ের কারণে বিপথগামি কিছু মানুষের কারণে সমাজ ও রাষ্ট্র কখনো কখনো হয়ে উঠছে অস্থির। বেশ কিছু মানুষের মন আছে আবেগ নেই, সমৃদ্ধি আছে শান্তি নেই, পারস্পরিক শ্রদ্ধা, আস্থা ও বিশ্বাস, ভালোবাসা, সংহতি আছে কিন্তু কোথায় যেন গভীর এক শূন্যতা ভর করেছে। বিশ্বায়নের প্রভাবের জন্যে হোক আর সমাজ পরিবর্তনের যে কোন কারণে হোক সামাজিক নিয়ন্ত্রণের একমাত্র ধারক ও বাহক মানুষের আচরণ আজ আর আগের মত নেই। সেখানে অনেক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধের মাধ্যমে মানুষ তার মনুষ্যত্ববোধ, মানবতাবোধ, বিবেকবোধ ও ন্যায়বোধ নিজের মধ্যে ধারণ করে, অন্যকে অনুকরণ করে, প্রয়োগের চর্চা করে সামাজিক হয়। কেননা একমাত্র মানুষই সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনার, নিয়ন্ত্রণের, রক্ষার, সুখ-সমৃদ্ধির নিয়ন্ত্রক বলেই মানুষ সমাজে বাস করে, বনে পশুর মত বাস করে না। নৈতিকতা এবং মূল্যবোধ হচ্ছে মানুষের আচরণের ক্ষেত্রে প্রভাববিস্তারকারী একটি বিমূর্ত ধারণা বা আদর্শ। সামাজিকভাবে বাস করতে গিয়ে মানুষ সামাজিকীকরণের মাধ্যমে কতকগুলো আদর্শ বা মানদণ্ড সাধারণভাবে গ্রহণ করে নেয়। সমাজে মানুষের যা কিছু করা উচিত, যা কিছু মঙ্গলজনক মনে করে তার আদর্শরূপই হচ্ছে সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধ। একটি রাষ্ট্র বা সমাজের প্রচলতি ধর্ম, তাদের অনেক দিনের টিকে থাকা সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য এবং ঐ রাষ্ট্র বা সমাজে বসবাসরত মানুষের আচরণের সমন্বয়ে মূল্যবোধ ও নৈতিকতার উদ্ভব ঘটে। নৈতিকতা ও মূল্যবোধের উপাদান কোন ব্যক্তির মধ্যে এমন এক বিমূর্ত শিক্ষা এনে দেয় যা ব্যক্তিকে সততা, পরমতসহিঞ্চুতা, উদারতা, মহানুভবতা, নিয়মানুবর্তিতা, জবাবদিহিতা, ন্যায়পরায়ণতা, দানশীলতা, সহমর্মিতা, নিষ্ঠা, সৌজন্যবোধ, কর্তব্যনিষ্ঠা, শিষ্টাচার, দেশপ্রেম, অন্যের কল্যাণ সাধন, পারস্পরিক মমত্ববোধ, আত্মত্যাগ, অপরের প্রতি ক্ষমা ও মার্জনা, ধৈর্য, বিনয় ও নম্রতা, অধ্যবসায়, সর্বোপরি সত্য ও ন্যায়ের পথে পরিচালিত হওয়া ইত্যাদি গুণে গুণান্বিত করে । শিক্ষার সাথে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের সম্পর্ক অতপ্রোত। একটি সমাজের বা রাষ্ট্রের শিক্ষাব্যবস্থা যত উন্নত ও শক্তিশালী, সে সমাজ বা রাষ্ট্রের নৈতিকতা ও মূল্যবোধ ততই নান্দনিক, মানবীয়, মনুষ্যত্ববোধসম্পন্ন, উন্নত ও শক্তিশালী। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে, সমস্যাগুলোর সমাধান করে সময়োপোযোগি করে আলোকিত মানুষ গড়ার মত শিক্ষাব্যবস্থা দরকার। মাদকের বিরুদ্ধে অভিযানে এ পর্যন্ত কম-বেশি ১২৩/১২৪ জন নিহত হয়েছে। মাদকের মাদকতা প্রতিকার ও প্রতিরোধ করার জন্য যা যা করা উচিত তা করাও দরকার। তবে যে বৃক্ষে সমস্যা তার ডাল পালা না কেটে শেকড় একেবারে উপড়ে ফেলা উচিত। মাদক ব্যবসায়ী, মাদক সন্ত্রাসীদেরকে দ্রুত বিচার ট্রাইবুনালের মাধ্যমে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানো যেতে পারে। ক্ষেত্র বিশেষে স্বল্প মেয়াদি, মধ্যম মেয়াদি ও দীর্ঘ মেয়াদি প্রতিকারমূলক, প্রতিরোধমূলক ও পূর্ণবাসনমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। অবশ্য শুধু জেল জরিমানা দিয়ে মাদক নির্মূল করা সম্ভব হয়নি বলেই আজ মহামারি আকার ধারণ করেছে। গ্রেফতারে দু-একটি ভূল হতে পারে, বন্দুক যুদ্ধে নয়। মৃত্যুতে নয়। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, একটি মৃত্যু মানে একটি পরিবার নিঃস্ব, পরিবারের সদস্যরা নিঃস্ব। নিহতের পরিবারের সদস্য রাষ্ট্র ও সমাজের প্রতি বিরূপ মনোভাব নিয়ে বড় হবে। ভবিষ্যতের অনেক ক্ষতির কারণও হয়ে দাঁড়াতে পারে তারা। প্রত্যেক ধর্মই তার স্ব স্ব অনুসারি মানুষের অন্তরে আলোকর্তিকা হিসাবে কাজ করে। আর তাই ধর্মীয় বোধ জাগ্রত করে মনের কালিমা দূর করতে হবে। কেননা ধর্মীয় অনুভূতি মানুষের জীবনে নিয়ন্ত্রক, পথপ্রদর্শক, রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে। আজ সময় এসেছে নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষার উপর অধিক গুরুত্বারোপের। কেননা মনে প্রাণে ধর্ম ও নৈতিকতাকে ধারণ করা ব্যক্তির পক্ষে মাদকের মাদকতায় নিমজ্জিত হওয়া বড় কঠিন।
মোহাম্মাদ আনিসুর রহমান : পি.এইচ.ডি. গবেষক, আন্তজাতিক সম্পর্ক ও বৈশ্বিক সুশাসন, জেঝিয়াং ইউনিভার্সিটি, চীন ও শিক্ষক সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, বশেমুরবিপ্রবি, গোপালগঞ্জ।
(দ্য রিপোর্ট/একেএমএম/সেপ্টেম্বর ০৫, ২০১৮)