বাংলাদেশে প্রাইভেট এয়ারলাইন্স টেকে না কেন
দ্য রিপোর্ট ডেস্ক : বাংলাদেশে প্রাইভেট এয়ারলাইন্স যাত্রা শুরু করে ১৯৯৭ সালে৷ এরপর মোট ১২টি প্রাইভেট এয়ার লাইন্স এলেও টিকে আছে মাত্র তিনটি৷ ২০ বছরের এই পথচলায় বেসরকারি খাতে বিমান পরিচালনায় অর্জন কতটুকু?
নেপালে বাংলাদেশের ইউএস-বাংলা এয়ার লাইন্সের উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হওয়ার পর বাংলাদেশের প্রাইভেট এয়ার লাইন্সের সক্ষমতা এবং যাত্রীসেবা নিয়ে আলোচনার পর প্রশ্ন ওঠে বাংলাদেশের প্রাইভেট এয়ার লাইন্সগুলো কেন একের পর এক ঝরে পড়ছে? এর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করে ডয়চে ভেলে-ও।
তারা বলছে, বাংলাদেশে এখন সবচেয়ে বড় প্রাইভেট এয়ার লাইন ইউএস-বাংলা এয়ার লাইন্স৷ আর বাকি দু'টি হলো নভোএয়ার ও রিজেন্ট এয়ার৷ ইউএস-বাংলা'র এখন আটটি অভ্যন্তরীণ এবং পাঁচটি আন্তর্জাতিক রুটে বিমান রয়েছে৷ নভোএয়ারের বিমান চলে সাতটি অভ্যন্তরীণ রুট এবং একটি আন্তর্জাতিক রুটে৷ রিজেন্ট এয়ার পাঁচটি অভ্যন্তরীণ এবং পাঁচটি আন্তর্জাতিক রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করছে৷ নিয়ম অনুযায়ী, এক বছর অভ্যন্তরীণ রুটে উড়োজাহাজ চালানোর পর আন্তর্জাকি রুটে ফ্লাইট পরিচালনার অনুমতি দেয়া হয়৷
বাংলাদেশে মোট যাত্রীর ২০ থেকে ২১ ভাগ পরিবহন করে বাংলাদেশ বিমান৷ ফলে প্রতিদিন ৩ হাজারের মতো যাত্রী বাংলাদেশ বিমানের মাধ্যমে অন্য দেশে যায়৷ প্রতিদিন ৬ থেকে ৭টি ফ্লাইট পরিচালনা করে বাংলাদেশ বিমান৷ ১৬টি রুটে বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইট চলাচল করে৷ এর মধ্যে লন্ডনসহ কয়েকটি রুটে সপ্তাহে তিনটি ফ্লাইট যায়৷ অন্য রুটগুলোতে সপ্তাহে অন্তত দু’টি ফ্লাইট চলাচল করে৷
১৯৯৫ সালে বেসরকারি এয়ারলাইন্স অ্যারো বেঙ্গলকে ফ্লাইট অপারেশনের অনুমতি দেয়া হয়৷ তবে তারা যাত্রী পরিবহন শুরু করে ১৯৯৭ সালে৷ আর পরের বছরই এই এয়ারলাইন্সটি কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়৷ এরপর বাংলাদেশে একে একে কাজ শুরু করে এয়ার বাংলাদেশ, জিএমজি এয়ারলাইন্স, রয়েল বেঙ্গল ও বেস্ট এয়ার৷ এর কোনোটি এখন আর অপারেশনে নেই৷ আর্থিক সংকটের কারণ দেখিয়ে তারা বন্ধ করে দেয়৷ অ্যারো বেঙ্গলসহ ছয়টি প্রাইভেট এয়ার লাইন্সই তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নেয় আর্থিক কারণ দেখিয়ে৷ ওই এয়ারলাইন্সগুলোর মধ্যে শুধু জিএমজি আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনা করতো৷
বাংলাদেশে মোট ১২টি প্রাইভেট এয়ারলাইন্স বিভিন্ন সময় অনুমোদন পেলেও দুইটি এয়ার লাইন্স কখনো অপারেশনেই আসেনি৷
এরপর ২০০৭ সালে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ যাত্রা শুরু করে ১১টি উড়োজাহাজ নিয়ে৷ পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তর করেও শেষ পর্যন্ত তারা টিকে থাকতে পারেনি৷ ১১টি প্লেনের নয়টি পর্যায়ক্রমে অকার্যকর হয়ে যায়৷ দু’টি প্লেন দিয়ে আরো কিছুদিন সচল থাকার পর ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ বন্ধ হয়ে যায়৷
২০১০ সাল থেকে রিজেন্ট এয়ার এবং ২০১৫ সাল থেকে নভো এয়ার ও ইউএস বাংলা ফ্লাইট অপারেশন শুরু করে৷ এই তিনটি এখনো টিকে আছে৷ রিজেন্ট এয়ারওয়েজও দেনায় পড়েছে৷ বেসামরিক বিমান চলাচলকর্তৃপক্ষ (বেবিচক)-এর কাছে তাদের ২৪ কোটি টাকা দেনা রয়েছে বলে জানা গেছে৷
তাদের বিমানবহরে রয়েছে ড্যাশ-৮ এবং বোয়িং৷ নভোএয়ার এটিআর-৭২-৫০০ এয়াক্রাফট দিয়ে যাত্রী পরিবহণ করে৷ ইউএস-বাংলা ড্যাশ এবং বোয়িং উড়োজাহাজ ব্যবহার করে৷
আগের এয়ারলাইন্সগুলো বন্ধ হয়েছে প্রধানত দু'টি কারণে৷ অব্যাহত লোকসান এবং ব্যবস্থাপনার ত্রুটি৷ ইউনাইটেড এয়ারকে তাদের ৮৪ কোটি টাকা দেনা তিন বছরে তিন কিস্তিতে শোধ করতে সুযোগ দেয়ার পরও টিকে থাকতে পারেনি৷
আবার নির্দিষ্ট সময় পরপর একটি উড়োজাহাজের ইঞ্জিন ও ল্যান্ডিং গিয়ারসহ গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে রক্ষনাবেক্ষণ প্রয়োজন৷ এ রক্ষণাবেক্ষণের একটি পর্যায় হলো সি-চেক৷ এই সি চেকে গিয়ে আটকে যায় কোনো কোনো এয়ার লাইন্সের উড়োজাহাজ৷একটি এয়ারলাইন্সের ১১টির মধ্যে ছয়টি উড়োজাহাজ সি-চেক-এর কারণে বসে থাকতে হয়েছে দীর্ঘদিন৷
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ এবং বিমান বোর্ডের সাবেক পরিচালক ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, ‘‘একটি প্রাইভেট এয়া্রলাইন্স চালানোর জন্য যে ধরনের উদ্যোক্তা দরকার, যেমন দক্ষতা দরকার, ব্যবস্থাপনা দরকার সেগুলো আমাদের এখানে এখনো হয়নি৷ ফলে এখানে অনেকেই টিকে থাকতে পারছে না৷ এয়ারলাইন্স ব্যবসা অনেক জটিল ব্যবসা৷ এটা অন্য পরিবহণ ব্যবসার মতো নয়৷ অনেকে মনে করে এটা লাভজনক ব্যবসা, তাই আসে৷ মনে করে এই ব্যবসা করলে একটা পজিশন হবে৷ একটা এয়ারক্রাফট দিয়ে ব্যবসা শুরু করে৷ কিন্তু সেই এয়ারক্রাফট যখন মেজর চেকের জন্য যায়, তখন বড় ধরনের ইনভেস্টমেন্টের প্রয়োজন হয়৷ এছাড়া সিলেকশন অব এয়ারক্রাফট, রুট প্ল্যানিং এসবেও সমস্যা আছে৷ আর আগে লোড হিসাব করে ব্যবসা হিসাব করা হতো৷ এখন আয় এবং ম্যানেজমেন্টের ব্যালেন্স করতে হয়৷ কেউ যতি টিকেটের দাম কমিয়ে যাত্রী লোড বাড়িয়ে ফেলে৷ তাতে ব্যবসা না-ও হতে পারে৷''
তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে জানান, ‘‘বাংলাদেশে ড্যাশ-৮ এয়ারক্রাফট বেশি ব্যবহার হয়৷ গত ১৫ বছর ধরে ব্যবহার করা হচ্ছে৷ ফলে এই এয়ারক্রাফট চালানো ও পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় জনবল এখানে আছে৷ আর থাকার কারণেই এই এয়ারক্রাফট ব্যবহারের প্রবণতা বেশি৷ অন্য ধরনের এয়ারক্রাফট আনলে নতুন করে জনবল তৈরির প্রয়োজন হবে৷''
তিনি বলেন, ‘‘প্রাইভেট এয়ারলাইন্সগুলোর যাত্রীসেবার মান ভালো হচ্ছে, কারণ, তাদের এখন আন্তর্জাতিকভাবে অনেক ভালো এয়ারলাইন্সের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হয়৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘ইউএস-বাংলার বিমান দুর্ঘটনার কারণে সাময়িকভাবে বাংলাদেশের প্রাইভেট এয়ার লাইন্সের ব্যবসায় নেতবিাচক প্রভাব পড়তে পারে৷ কিন্তু এটা স্থায়ী হবে বলে আমার মনে হয় না৷''
রিজেন্ট এয়ার-এর চিফ কমার্শিয়াল অফিসার আখতার ইউ আহমেদ দাবি করেন, ‘‘বাংলাদেশের প্রাইভেট এয়ারলাইন্সগুলোর যাত্রীসেবা অনেক ভালো, কারণ, আমাদের আন্তর্জাতিক এয়ারলাইন্সগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে যাত্রী পেতে হয়৷ যাত্রী সেবার প্রথম শর্ত হলো শিডিউল মতো ফ্লাইট অপরেশন৷ আমরা সেটা চেষ্টা করি৷ আর অনবোর্ড সার্ভিসও মান সম্পন্ন৷''
তাহলে বাংলাদেশে প্রাইভেট এয়ারলাইন্স কেন বন্ধ হয়ে যায়? কেন ব্যবসা করতে পারে না? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন,‘‘লাভ-লোকসানের এই হিসাব তো আমি দিতে পারবো না৷ আর কেন টিকতে পারছে না এর কোনো সিম্পল আনসার নাই৷''
অন্যদিকে এভিয়েশন বিষয়ক সিনিয়র সাংবাদিক আবুল আজাদ সুলায়মান বলেন, ‘‘প্রাইভেট এয়ারলাইন্সের যাত্রীসেবা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের চেয়ে ভালো৷ তারা এটাকে গুরুত্ব দেয়৷ কিন্তু এরা ড্যাশ-৮ এর ওপর বেশি মাত্রায় নির্ভরশীল৷ ইউএস-বাংলার ড্যাশ-৮ বিমান দুর্ঘটনার পর এটা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে৷ এটা কিছু দেশ ব্যবহার করলেও ইউরোপ এবং স্ক্যান্ডিনেভিয়ান অনেক দেশ এই উড়োজাহাজ ব্যবহার করছে না৷ কারণ, এর ল্যান্ডিং গিয়ার ত্রুটিপূর্ন৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘আমাদের দেশে যারা প্রাইভেট এয়ালাইন্সের ব্যবসা করেন, তারা এটাকে আলু-পটলের ব্যবসার মতো মনে করেন৷ তাদের এটা করার দক্ষতা এবং যোগ্যতা নাই৷ তারা মনে করে, এ ব্যবসা করলে তাদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে৷ আর অনেক ব্যবসা হবে৷ কিন্তু ব্যবসায় নেমে যখন আর পারে না, তখন কোম্পানি বন্ধ করে দেয়৷ কারণ, এয়ারক্রাফট ওভারহলিং সম্পর্কে তাদের আগে ধারণা থাকে না৷ এটা ব্যয়বহুল৷ যখন করতে হয়, তখন ব্যবসার পুঁজিই শেষ হয়ে যায়৷''
(দ্য রিপোর্ট/একেএমএম/সেপ্টেম্বর ২১,২০১৮)