আশুরা : তাৎপর্য, করণীয় ও বর্জনীয়-দুই
মাহফূজ আল-হামিদ
(পূর্ব প্রকাশের পর) আমরা আপাতত সে বিতর্কে না জড়িয়ে যদি এ বিষয়ক অতি প্রচলিত ঐতিহাসিক বক্তব্যকে সঠিক ধরে নেই যে, আশুরার দিনে কারবালার প্রান্তরে হুসাইন (রা.) নির্মমভাবে শাহাদাত বরণ করেছেন, তাতেও আশুরার দিবসের তাৎপর্য কমবে না এবং আশুরা দিবসে করণীয় ও বর্জনীয় বিষয়সমূহেরও কোন হেরফের হবে না।
আশুরা উপলক্ষে করণীয়:
মানব ইতিহাসের সূচনালগ্ন থেকেই আশুরাতে সংঘটিত ঘটনাবলি মানবজাতির জন্য দিকনির্দেশনা হয়ে রয়েছে। ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের ক্রান্তিকালে করণীয় ও বর্জনীয় অসংখ্য নির্দেশনা এ আশুরার ঘটনাবলিতে বিদ্যমান। প্রতি বছর এ দিনটি যখনই মানুষের কাছে ধরা দেয়, তখনই মনে হয় যেন আশুরা তার শিক্ষার ভাণ্ডার নিয়ে আমাদের নতুনভাবে ডাকছে। এ দিনের আবেদন ফুরানোর নয়। আর তাই আশুরাকে আমাদের সুন্দরভাবে উদযাপন করতে হবে। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) এ দিনকে যেভাবে উদযাপন করেছেন এবং উদযাপনের নির্দেশ দিয়েছেন, আমাদেরও ঠিক সেভাবেই উদযাপন করতে হবে। আশুরার ফজিলত অগণিত। সে ফজিলত লাভের আশায় মুসলমানরা তো বটেই ইয়াহুদিরাও এ দিবসে রোজা পালন করে। এই সম্পর্কে হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রাসূল (সা.) যখন মক্কা থেকে হিজরত করে মদিনায় আগমন করলেন, দেখলেন মদিনার ইয়াহুদিরা আশুরার দিবসে রোজা পালন করছে। তাদেরকে এর কারণ জিজ্ঞেস করা হলে তারা বলল, এই দিনটা আমাদের কাছে বেশ গুরুত্বপুর্ণ। কারণ, এই দিনে আল্লাহ তা'আলা মুসা (আ.) এবং তাঁর সম্প্রদায় বনী ইস্রাঈলকে ফেরআউনের কবল থেকে মুক্ত করেছেন এবং তার উপর বিজয় দান করেছিলেন। তারই শুকরিয়া হিসাবে এই দিনে নবী মুসা (আ.) রোজা রেখেছিলেন। তাই আমরাও এই দিনে রোজা রাখি। রাসূল (সা.) বললেন, এই রোজা রাখার ব্যাপারে তোমাদের চেয়ে আমিই অগ্রাধিকার রাখি। তারপর তিনি নিজেও রোজা রাখলেন এবং সাহাবীদেরকেও রোজা রাখার নির্দেশ দিলেন। قَدِمَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الْمَدِينَةَ فَرَأَى الْيَهُودَ تَصُومُ يَوْمَ عَاشُورَاءَ فَقَالَ مَا هَذَا قَالُوا هَذَا يَوْمٌ صَالِحٌ هَذَا يَوْمٌ نَجَّى اللَّهُ بَنِي إِسْرَائِيلَ مِنْ عَدُوِّهِمْ فَصَامَهُ مُوسَى قَالَ فَأَنَا أَحَقُّ بِمُوسَى مِنْكُمْ فَصَامَهُ وَأَمَرَ بِصِيَامِهِ (বুখারী- ১৯০০, মুসলিম-২৬৫৩, ইবনে মাজাহ-১৭৩৪, আবূ ইয়ালা-২৫৬৭, আহমদ-২৬৩৯, শরহে ইবনে বাত্বাল-৭/১৬৫)
শুধু ইয়াহুদিরাই নয়, মক্কার কুরাইশরাও এই দিনে রোজা রাখত। এই সম্পর্কে হযরত আয়শা (রা.) বর্ণনা করেন,كَانَ يَوْمُ عَاشُورَاءَ تَصُومُهُ قُرَيْشٌ فِي الْجَاهِلِيَّةِ وَكَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَصُومُهُ فَلَمَّا قَدِمَ الْمَدِينَةَ صَامَهُ وَأَمَرَ بِصِيَامِهِ فَلَمَّا فُرِضَ رَمَضَانُ تَرَكَ يَوْمَ عَاشُورَاءَ فَمَنْ شَاءَ صَامَهُ وَمَنْ شَاءَ تَرَكَهُ - জাহেলিয়্যাতের যুগে কুরাইশরাও আশুরার দিবসে রোজা পালন করত। রাসুল (সা.) নিজেও রোজা রাখতেন। যখন তিনি মদিনায় হিজরত করলেন, তখন নিজেও রোজা রেখেছেন এবং লোকদেরকেও রোজা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার পর আশুরার রোজাকে ইচ্ছাধিন করে দিলেন। (বুখারী-১৮৯৮, মুসলিম-২৬৩২, তিরমিযী-৭৫৩, আবূ দাঊদ-২৪৪২, বাইহাক্বী-৮৪৯৪, মোআত্বা-৬৫১, হিব্বান-৩৬২১, আহমদ-২৩৪৯১)
উল্লেখ্য, মুসলমানদের উপর রোজা ফরজ হয় হিজরতের ২য় বৎসর শাবান মাসের ২৮ তারিখ সোমবার। (সুবুলুস সালাম-২/৩০৫, নাইলুল আওত্বার-২/৪৯৯, আত তাহরিক- ৩/৯/০৮)
তবে ইয়াহুদিরা আশুরা উপলক্ষে এক দিন রোজা রাখে। তাদের রোজার সাথে যেন মুসলমানদের রোজার সাদৃশ না হয় তাই মুসলমানদেরকে আশুরার রোজার সাথে ৯ অথবা ১১ তারিখে আরো একটি রোজা বৃদ্ধি করে রাখা উচিৎ। এই সম্পর্কে হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَئِنْ بَقِيتُ إِلَى قَابِلٍ لَأَصُومَنَّ التَّاسِعَ - আমি যদি আগামী বছর বেঁচে থাকি তাহলে মুহাররামের ১০ম তারিখের সাথে ৯ম তারিখেও রোজা রাখব। (মুসলিম-২৬৬২, ইবনে মাজাহ-১৭৩৬, মুসনাদে আহমদ-১৯৭২, কানজুল উম্মাল-৮/৫৭৩, মিশকাতুল মাসাবীহ ২০৪১, আউনুল মা’বুদ-৫/৩২৯, তুহফাতুল আহওয়াজি-২/২৯৫, ফাতহুল মুবিন-২/৩০১)
উপরের হাদীসে যদিও রাসুল (সা.) ৯ তারিখের কথা স্পষ্ট উল্লেখ করেছেন, তথাপি কেউ যদি ৯ তারিখের রোজা না রেখে আশুরার রোজার সাথে ১১ তারিখে মিলিয়ে রোজা রাখে, তাতেও সমস্যা নেই। কারণ, এ সম্পর্কে অন্য হাদীসে রাসুল (সা.) বলেন,صُومُوا يَوْمَ عَاشُورَاءَ وَخَالِفُوا فِيهِ الْيَهُودَ صُومُوا قَبْلَهُ يَوْمًا أَوْ بَعْدَهُ يَوْمًا - তোমরা আশুরার রোজা রাখ এবং এই দিনে ইয়াহুদিদের রোজার বিরোধিতা কর। তোমরা আশুরার রোজার সাথে এক দিন আগে অথবা এক দিন পরে করে আরো একটি রোজা রাখ। (খুজাইমাহ-২০৯৫, বাইহাক্বী-৮৪৯১, আহমদ-২১৫৫, আল-মুসনাদ আল-জামে‘-২০/২৮৩)
আশুরার রোজার ফজিলত
হযরত আবূ হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, أَفْضَلُ الصِّيَامِ بَعْدَ شَهْرِ رَمَضَانَ شَهْرُ اللَّهِ الْمُحَرَّمُ - রমজানের রোজার পর সবচেয়ে বেশি ফজিলতপুর্ণ রোজা হল মহাররমের রোজা। (মুসলিম-২৭৪৭, তিরমিযী-৪৩৮, নাসাঈ-১৬১২, আবূ দাঊদ-২৪২৯, বাইহাক্বী-৮৫০৬, হিব্বান-৩৬৩৬, আহমদ-১০৫৩২, হাকেম-১১৫৫, তুহফাতুল আহওয়াজী-২/১৯৭, আল-মুগনী-৩/১৯৯)
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রমযান ও আশুরায় যেরূপ গুরুত্বের সঙ্গে রোযা রাখতে দেখেছি অন্য সময় তা দেখিনি।’ (বুখারী ১/২১৮)
হযরত আলী (রা.) -কে এক ব্যক্তি প্রশ্ন করেছিল, রমযানের পর আর কোন মাস আছে, যাতে আপনি আমাকে রোযা রাখার আদেশ করেন? তিনি বললেন, এই প্রশ্ন রাসূল (সা.)-এর নিকট জনৈক সাহাবী করেছিলেন, তখন আমি তাঁর খেদমতে উপস্থিত ছিলাম। উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘রমযানের পর যদি তুমি রোযা রাখতে চাও, তবে মুহররম মাসে রাখ। কারণ, এটি আল্লাহর মাস। এ মাসে এমন একটি দিন আছে, যে দিনে আল্লাহ তা‘আলা একটি জাতির তওবা কবুল করেছেন এবং ভবিষ্যতেও অন্যান্য জাতির তওবা কবুল করবেন।’ (জামে তিরমিযী ১/১৫৭)
অন্য হাদীসে নবী করীম (সা.) বলেন, ‘আমি আশাবাদী যে, আশুরার রোযার কারণে আল্লাহ তাআলা অতীতের এক বছরের (সগীরা) গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন।’ (সহীহ মুসলিম ১/৩৬৭; জামে তিরমিযী ১/১৫৮)
উপর্যুক্ত আলোচনায় প্রতীয়মান হয় যে, ১০ই মুহাররমের তাৎপর্য কেবল কারবালার ঘটনাকে কেন্দ্র করে নয়, বরং এদিনে যে ঐতিহাসিক ঘটনাবলী রয়েছে তারই পরিপ্রেক্ষিতে আশুরার মর্যাদা ও গুরত্ব। যা পালিত হয়ে আসছে হাজার বছর ধরে।
লেখক:প্রিন্সিপাল, আল-ইত্তেহাদ আন্তর্জাতিক মাদরাসা,বনশ্রী আবাসিক এলাকা, মৌলভীবাজার
(দ্য রিপোর্ট/একেএমএম/সেপ্টেম্বর ২২,২০১৮)