শিল্পের সমীকরণ
পাখির কিচির মিচির শব্দ, কোথাও বা স্তুপকৃত চিঠি, আবার আদম সন্তানদের এক মিছিল যেখানে তারা নিজেরাই বহন করছে নিজেদের ফসিল। মননে চলা যোগ-বিয়োগ কেননা সমীকরণের মাধ্যমে চিত্রপটে ধারণ করে এক ধরণের উত্তর মেলাবার চেষ্টায় মত্ত মানুষগুলোর ক্যানভাস সারি সারি ঝুলছে দেয়ালে দেয়ালে। আবার যে শুধু উত্তর মেলাবার চেষ্টায় মত্ত তাও না, কেউ কেউ তো ভিন্ন ভিন্ন প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছে। বিশ্বায়নের যুগে বসবাস করা মানুষগুলোর দিকে। কেউবা নিজেকেই শিল্পের একটি উপাদান মনে করে, নিজের সত্তা ও শারীরিক ভঙ্গিমার মাধ্যমেও উপস্থাপন করতেও মত্ত।
হ্যাঁ। শিল্প-মাধ্যম এখন আর শুধুই বর্ণ, পট্ট বা কাঠ-পাথরের ভাস্কর্য-এর মধ্যে সীমাবদ্ধ তা নয়, শিল্প এখন মেঘেদের মতই স্বাধীন। নেই কোন সীমানা প্রাচীর বা কাটা-তাঁরের বেড়া, শিল্প-মাধ্যমগুলো এখন নিজের মত প্রকাশেও স্বাধীন। মানব জীবনের প্রতিটি স্তরকে টুকরো টুকরো অংশ করে তাকালে দেখা যাবে কী নান্দনিকতায় ঠাসা, আর তার নানা উপাদানও হয়ে ওঠে এক একটি শিল্পবস্তু। ঠিক সেখানে দাঁড়িয়ে আমরা অন্তর্দৃষ্টি একটু প্রসারিত করলেই শিল্পকে স্থাপন প্রতিস্থাপন করতে পারি সর্বময়। কু এবং সু প্রতিটি সময় এক জটিল দ্বান্দ্বিকতায় মত্ত এবং এই দ্বান্দ্বিকতার দোলাচালে পড়ে মননযন্ত্র ও বিভিন্ন সমীকরণ এর সমীক্ষণ। তা মেলাবার নানা ছক একে চলে প্রতিনিয়ত, কিন্তু তা কি মেলে? হয়তো সব সময় হ্যাঁ, আবার না। এর মাঝের প্রকাশগুলোই হয়ে ওঠে এক একটি শিল্পকর্ম।
এই প্রকাশের আতুর ঘর হলো গ্যালারি। গ্যালারি ধারণ করে পরম যত্নে ওই সমীকরণ বা প্রশ্নাবলিগুলো, যেগুলোর কোনটার উত্তর মিলে গেছে বা অপেক্ষমান। চিন্তার প্রকাশ ও উপস্থাপনা যা পরমযত্নে গ্যালারি ধারণ করে। গ্যালারি নিজেই এক মহাজটিলতায় আরোহণ বা অবরোহণ করতে থাকে। চিন্তাগুলোর ঠোকাঠুকি দেখতে দেখতে বিশ্বায়নের যুগে এসেও চিন্তাশীল মানুষগুলো কত না দ্বিধান্বিত তাদের অস্তিত্ব, প্রেম, সম্পর্কগুলোর কাঠামো টিকিয়ে রাখতে। কিছুসংখ্যক তো প্রদর্শনীতে এসে প্রশ্নাবলি ছুঁড়ে দিচ্ছে বিশ্বমানবতার দিকে, ছড়িয়ে দিচ্ছে নানা মতবাদ যা কারও কারও সমীকরণ মেলাতে পুরোধার ভূমিকায় অবতীর্ণ। সর্বোপরি চিন্তার; বিশেষ করে শিল্প-চিন্তার এক মিলন গবেষণাগারে পরিণত হয়েছে গ্যালারি।
এশিয়ান আর্ট বিয়েনাল ঠিক তেমনই এক মঞ্চ, যেখানে মঞ্চায়িত হচ্ছে নিজেকে মেলে ধরবার এক ওথেলো। বিভিন্ন রং বর্ণের, ভিন্ন ভাষার বিভিন্ন স্থানের মানুষগুলো যেন একটি নাটকে অভিনয় করছে। নিজের সাধ্যমত নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে নিজের সত্তাকে উপস্থাপনে মত্ত সবাই। কোথাও বা দ্বিমাত্রিকতা, ত্রিমাত্রিকতার ধারা কোথাও নিজেই আবার আলোর প্রতিবিম্ব ব্যবহার করেও নিজের আত্মার ব্যঞ্জনা প্রকাশ করছে।
সময়ের বক্তব্য উপস্থাপিত হয় শিল্পরূপে। এশিয়ান বিয়েনাল একটি মঞ্চ যেখানে সময়ের বর্তমান রূপকে খুব কাছ থেকে চেনা যায়, দেখা যায়, এমনকি স্পর্শও করা যায়। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি প্রতি দুই বছর পর পর আয়োজন করছে সময়ের বক্তব্য প্রকাশের জন্য মত্ত মানুষগুলোর প্রকাশভঙ্গির নানা আঙ্গিক। স্থানীয় শিল্পীদের পাশাপাশি ভিন্ন ভিন্ন দেশের শিল্পীগণ এই বিয়েনালে তাদের চিন্তার পসরা সাজিয়ে বসেছে। শিল্প নিয়ে মতামত তা নিয়ে গবেষণা চালাবার আরও কত কৌশল, কত মাত্রা যোগ করা যায় তারই ঐকতান এই বিয়েনাল।
আছে ত্রিমাত্রিক ভাস্কর্য যা কিনা প্রকৃতিগত করে উপস্থাপিত হচ্ছে। নিজেকে প্রকৃতির একটা অংশই মনে করে ত্রিমাত্রিক শিল্প-কর্মগুলো হাজির হচ্ছে শিল্পরসিকদের সামনে। রং ও পটের পাশাপাশি প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে শিল্পকর্মে, তবে বেশ উপভোগ্য বিষয় হলো বিংশ শতাব্দীর মানুষগুলো প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়িয়ে জীবনকে সুন্দর উপভোগ্য করেছে বটে। তবে কেন শিল্পকর্মের মধ্যে এত অস্থিরতা, সম্পর্কের কাঠামোগুলো যেন শূন্যতার দিকে ধাবিত হচ্ছে।
অগ্রজ শিল্পীগণের শিল্পকর্মগুলোও নবীনদের পথের সন্ধান দিচ্ছে, তবে তা স্থানিকতাকে ভুলে গিয়ে নয়। সাথে নিয়ে কীভাবে এগিয়ে যেতে হয়। ভিন্ন দেশি শিল্পীগণ ও তাদের স্থানিক চিন্তার এক ধরণের সমীক্ষা তুলে ধরেছেন। তবে কী ভিনদেশি, কী স্থানীয় শিল্পী, সবার মাঝে এক অস্থিরতা; তবে কি বিজ্ঞান এক অস্থির পৃথিবীর দিকে ধাবিত করছে মনুষ্যকূলকে? মননযন্ত্র কি বিকলতার আভাস দিচ্ছে? শিল্পকর্মাদির মাধ্যমে তেমনই বার্তা পাচ্ছি বলে মনে হচ্ছে, বিয়েনালে অংশগ্রহণ করা শিল্পীগণের শিল্পকর্মের বার্তায়। ক্ষুদে তো নয়ই বেশ বৃহৎ সে বার্তা।
বিয়েনালে অংশগ্রহণের তালিকা বেশ দীর্ঘতম, তা এশিয়া ছাড়িয়ে বিশ্বের অন্য মহাদেশকে ছুঁয়ে গেছে এবং পৃথিবীর কাছে আমাদের চিন্তার সমীকরণ উপস্থাপনে আমরা সচেষ্ট। তবে সময় এসেছে মনে হয় এটাকে আর এশিয়ান আর্ট বিয়েনাল নামে বেঁধে রাখা সমীচীন হবে না, তাকে পৃথিবীময় শিল্পরূপে অধিষ্ঠিত করে ফেলতে হবে, নিয়ে যেতে হবে বিশ্বের শিল্পরসিকদের মাঝে, আর ওই গুরুদায়িত্বটা আমাদেরকেই নিতে হবে, যারা শিল্পের পথের পথিক হয়ে একটি সরলরেখায় দেখতে চায় বিশ্বশিল্পকে।
লেখক : ফ্রিল্যান্স আর্টিস্ট
(দ্য রিপোর্ট/একেএমএম/অক্টোবর ০১,২০১৮)