'এমন কঠিন আইন কেন আমাদের উপহার পেতে হবে?’
দ্য রিপোর্ট ডেক্স : সম্পাদক পরিষদসহ বিভিন্ন পক্ষের আপত্তি, উদ্বেগ ও মতামত উপেক্ষা করে পাস হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে ব্রিটিশ উপনিবেশিক আমলের আইনের চেয়েও ‘কঠিন’ আইন বলে অবিহিত করা হয়েছে এক গোলটেবিল বৈঠকে।
শনিবার সন্ধ্যায় জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে ল’ রিপোর্টার্স ফোরাম আয়োজিত এ গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নেয়া কয়েকজন আলোচক আইনটিকে ‘কঠিন’ আইন হিসেবে উল্লেখ করেন।
এ আইনের নানা অসংগতি তুলে ধরে প্রশ্ন রাখা হয় যে, স্বাধীনতার রজতজয়ন্তীর সামনে এসে কেন আমাদের এমন কঠিন আইন উপহার পেতে হবে?
‘মুক্ত গণমাধ্যম: প্রেক্ষিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’ শীর্ষক এ গোলটেবিল বৈঠকে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) একাংশের মহাসচিব শাবান মাহমুদ বলেন, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে তথ্যমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক হয়। সেখানে আইনমন্ত্রী আশ্বস্ত করেছিলেন যে, এই আইন নিয়ে আমাদের উদ্বেগের জায়গাগুলোতে সংশোধনী আনা হবে এবং আইনটি চূড়ান্ত হওয়ার আগে সংশোধনী হবে।’
‘‘কিন্তু আইনমন্ত্রী তার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছেন, তিনি কথা রাখেননি। এই একটি জায়গায় আমাদের উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা আরও ঘনীভূত হয়েছে। কোনো অবস্থাতেই সংশোধনী ছাড়া আইনটি পুরোপুরি কার্যকর হোক তা আমরা সাংবাদিক সমাজ থেকে মেনে নিতে পারি না।’’
গোলটেবিল আলোচনায় দৈনিক ভোরের কাগজের সম্পাদক শ্যামল দত্ত বলেন, ‘আসলে একটা আইন কোনো বিষয় না, রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গিই মূল বিষয়। এ আইনে ৬২ টি ধারার মধ্যে আমরা মাত্র ৯টি ধারার বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছিলাম। আমরা কিন্তু পুরো আইনকে প্রত্যাখ্যান করিনি। আমরা বলেছি এই এই ধারাগুলো স্বাধীন সাংবাদিকতার পরিপন্থী। কোথায় পরিপন্থী তাও আমরা স্পষ্ট করে উল্লেখ করেছি।’
‘‘এই আইন পাসের আগে এ আইন নিয়ে যে উব্দেগ ছিল আইন পাসের পর সে উব্দেগ কিন্তু রয়েই গেল।’ তবু আমরা সরকারের প্রতি আস্থা রাখতে চাই। আস্থা রেখেই আমরা একটি সমাধানের পৌঁছাতে পারবো বলে মনে করি।’’
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের দ্বারা ৫৭ ধারা যে বাতিল হচ্ছে, তা কিন্তু নয়। এ আইনে ৫৭ ধারার প্রতিফলন ঘটেছে। এ আইনের ২৩, ২৯ ও ৪৩ ধারা দ্বারা সাধারণ জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ আইনে কোন জামিন সংক্রান্ত বিধান নেই।
গোলটেবিল আলোচনায় সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সারা হোসেন বলেন, স্বাধীনতার রজতজয়ন্তীর সামনে এসে কেন আমাদের ব্রিটিশ উপনিবেশিক আমলের চেয়ে কঠিন আইন উপহার পেতে হবে? দেশের নাগরিকদের জন্য সাংবিধানিক যে রক্ষাকবচ রয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তার কোনো প্রতিফলন নেই।
আলোচনায় অংশ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, এই আইনে অপরাধের সংজ্ঞাতেই অস্পষ্টতা রয়েছে। যেখানে, ‘গুজব’, ‘ভাবমূর্তি’, ‘মূল্যবোধ’ শব্দগুলো অপরাধের বিষয়বস্তু হিশেবে রয়েছে কিন্তু এই শব্দগুলোর সংজ্ঞা দেয়া নেই। যার ফলে ইচ্ছামত এই শব্দগুলোর ব্যাখ্যা ও অপপ্রয়োগ সম্ভব। এ আইন শুধু সাংবাদিক, সুশীল সমাজ বা বিরোধীদের সমস্যা নয়। এ আইন নাগরিকের জন্য সমস্যা।
এ আইনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো প্রত্যেকটি মানুষের দায়িত্ব।
বৈঠকে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন বলেন, সরকারের তরফ থেকে নাকি বলা হয়েছে আগামীতে এ সরকার ক্ষমতায় এলে এ আইন সংশোধন করবে। প্রশ্ন হচ্ছে, এখন সংশোধন করতে সমস্যা কি? আমরা মনে করি, আগামী নির্বাচনে কেউ যাতে সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলতে না পারে সেজন্য এ আইন পাস করা হয়েছে। এটা একটা কঠিন আইন। বিশেষ ক্ষমতা আইনের থেকেও এটি ভয়ানক আইন। এ আইনের অবশ্যই সংশোধনী হওয়া দরকার।সংসদের এ অধিবেশনেই আইনটি সংশোধন করা যেতে পারে।
তবে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন বলেন, সকলেই যদি মনে করে আইনটি সবার স্বার্থে এবং জনগণের স্বার্থে হয়নি, তবে আইনটি অবশ্যই সংশোধন করার সুযোগ রয়েছে। এটা কোন বাইবেল নয় যে সংশোধন করা যাবেনা। সুযোগ শেষ হয়ে যায়নি।
ল’ রিপোর্টার্স ফোরামের সভাপতি সাঈদ আহমেদ খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ গোলটেবিল বৈঠকের সঞ্চালনায় ছিলেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক হাসান জাবেদ।
অনুষ্ঠানে ‘মুক্ত গণমাধ্যম: প্রেক্ষিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’ শীর্ষক মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন দৈনিক প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক মিজানুর রহমান খান।
(দ্য রিপোর্ট/একেএমএম/ অক্টোবর ২৮, ২০১৮)