তরিকুল ইসলামের সঙ্গে কিছু স্মৃতি
তৌহিদুল ইসলাম মিন্টু
চলে গেলেন তরিকুল ইসলাম। তিনি ছিলেন যশোরের কিংবদন্তীতুল্য নেতা। ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী। সংবাদপত্রের সাথে যে সখ্য গড়ে উঠেছে আমার-তার পেছনে এই মানুষটির বিশেষ অবদান রয়েছে-এ কথা স্বীকার করতে হয়। তাঁর মৃত্যুর দিনে অনেক স্মৃতি মনে পড়ছে। এখানে খণ্ডিত কয়েকটি স্মৃতি পাঠকদের কাছে শেয়ার করছি। একদা জেলা শহর যশোরে সাংবাদিকতার সূত্রে অনেক অভিজ্ঞতা জীবনে অর্জন করেছি।
সালটা ১৯৯৭। মাস্টার্স পরীক্ষা দিয়ে বসে আছি। লোকসমাজ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ও আমার আপন বড়ভাই দাদাভাই(ফকির শওকত) বললেন, ‘সাংবাদিকতা করবি নাকি? লোকসমাজের একজন সাংবাদিক চলে গেছে।’ আমি রাজি হলাম। তরিকুল ইসলামের কাছে আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো। তরিকুল ভাই বললেন, তোর খোকন ভাই (মাহবুবুর রহমান খোকন, পত্রিকাটির ব্যবস্থাপনা সম্পাদক) আসুক। তার সঙ্গে একটু কথা বলে নিই। এরপর আমার যোগদান। এক হাজার টাকা বেতনে আমার সাংবাদিকতা জীবন শুরু।
তরিকুল ইসলাম লোকসমাজের প্রকাশক ছিলেন। পত্রিকাটিতে সাংবাদিকতা করার সুবাদে ব্যাক্তিগতভাবে পরিচিতি গড়ে ওঠে তাঁর সঙ্গে। পেশাগত কাজে তাঁর নিরঙ্কুশ সহযোগিতা পেয়েছি।
রোববার (০৪ নভেম্বর) তাঁর মৃত্যুর সংবাদ জানার পর থেকেই অনেক কিছুই মনে পড়ছে। যশোর থেকে প্রকাশিত এই পত্রিকাটি দক্ষিণাঞ্চলে যথেষ্ট জনপ্রিয়। তখনকার দিনে ওই অঞ্চলের মানুষের সকালবেলার চায়ের কাপে ঝড় উঠতো প্রকাশিত নিউজ পাঠে। এখন সম্ভবত সে জৌলুস আর নাই।
যাই হোক বলছিলাম যা। একদিন হলো কী-আমার সহোদর ফকির শওকত তখন আর লোকসমাজের সম্পাদক নন। আমি খানিকটা বিব্রত। ফলে আমার প্রতি তরিকুল ইসলাম বিশেষ নজর দিলেন। রিপোর্টার থেকে হঠাৎই আমাকে লোকসমাজের মফস্বল সম্পাদক করে দিলেন। এই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বেশ কয়েকজন জেলা ও থানা প্রতিনিধির সঙ্গে কিছুটা বিরোধ দেখা দিলো । এক পর্যায়ে পত্রিকাটির কয়েকজন প্রতিনিধি তরিকুল ইসলামের যশোরে শহরের বাসায় গেলেন। তারা গিয়ে আমার বিরুদ্ধে নালিশ জানালেন। আমি তাদের নিউজ ঠিক মতো ছাপি না-এ জাতীয় কিছু অভিযোগ তাঁর কাছে তারা করলেন।
এর পরিপ্রেক্ষিতে অফিসে মিটিংয়ের আয়োজন হলো। তরিকুল ভাই, আমি ও অভিযোগকারী সেসব প্রতিনিধি তারা মিটিংয়ে উপস্থিত। প্রতিনিধিদের কেউ কেউ তাদের নিউজ বেশি বেশি ট্রিটমেন্ট না দেওয়ার অভিযোগ করলেন। আমি আত্মপক্ষ সমর্থন করে বললাম, ‘কোনো ব্যাক্তিগত স্বার্থে নিউজ আটকে রাখি না। যেসব নিউজের সঙ্গে আর্থিক লেনদেনের সম্পর্ক থাকে বলে সন্দেহ হয় সেগুলো আটকে দিই। আমার কাজে আমি একশ’ ভাগ সৎ থাকার চেষ্টা করি। এ বিষয়ে আমি নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাসী ।’ এরপর প্রকাশক তরিকুল ইসলাম কথা বলা শুরু করেন। তিনি বললেন ‘ মিন্টু যা বলেছে আমি তা বিশ্বাস করি। ও সৎ ছেলে। আমি ওর ওপর আমার একশ’ ভাগ আস্থা রাখি।’ মিটিং শেষ হলে অভিযোগকারীদের কয়েকজন আমার রুমে এসে সৌহার্দ্য বিনিময় করে চলে গেলেন। সেসব দিনের কথা আমার আজ খুব মনে পড়ছে।
একদিনের সন্ধ্যার ঘটনা এই মুহূর্তে ডানা মেলছে। তখন রিপোর্টিংয়ে কাজ করি। যশোরের সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের দলিল লেখকদের নিয়ে একটা নিউজ করেছি। আরো কিছু নিউজের জন্য সোর্সের সঙ্গে দেখা করে অফিসে ফিরেছি। দেখি আমার চেয়ারসহ আরো দু’তিনজনের চেয়ার নেই। কি ব্যাপার! জানতে পারলাম প্রকাশক অফিসে উপস্থিত। দেরি করে আসায় চেয়ার সরিয়ে রাখতে বলেছেন। তরিকুল ভাইয়ের রুমে গেলাম। কোথায় গিয়েছিলাম, কেন দেরি হলো জানতে চাইলেন। বললাম, ‘ভাই সোর্সের কাছে গিয়েছিলাম।’ তিনি বললেন, ‘হ্যা, ওই দলিল লেখকদের বিরুদ্ধে লেখার জন্য সোর্সের কাছে গেছিলি।’ আমি তো ভীষণ অবাক। তিনি জানলেন কিভাবে। এই সন্ধ্যায় আমি কোন সোর্সের সঙ্গে কথা বলেছি। কি নিউজ লিখবো। বললাম, ‘হ্যা ভাই সোর্সের কাছেই গেছিলাম।’ তিনি বললেন, ‘থাক। আর যেতে হবে না। ওদের বিরুদ্ধে আর লিখতে হবে না। ‘কেন ভাই’ কৌতূহলবশত জানতে চাইলাম। বললেন, ‘ওরাতো বিএনপি করে। ওরা আমার দলের লোক। ওদের বিরুদ্ধে লেখা যাবে না। বুঝলে বিপদে আছি। ওরা আমার দলের লোক। তুমি যাদের বিরুদ্ধে লিখেছো, যাদের নিউজ লোকসমাজে ছাপা হয়েছে তারা আজ দুপুরে আমার বাড়ি ঘেরাও করেছিল। বুঝেছো।’ তরিকুল ভাইয়ের সঙ্গে নিউজ নিয়ে কথা বলতে কখনো কোনো দ্বিধা করেনি আমার। তিনি তেমন প্রকাশকও ছিলেনও না।
আমি একটু ঝালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলাম। বললাম, ‘তাহলে কী করবো ভাই? বললেন, ‘কবিতা লেখ, যাও ।’ বুঝলাম এটা উনার অনুযোগ। দলীয়কারণে নিজের কাগজে নিউজ ছাপতে না পারার কষ্ট। চেয়ার নিয়ে চলে আসলাম। আবার বসে লেখা শুরু করলাম। তবে সেটা নিউজও না। কবিতাও না। অন্যের নিউজ এডিট করা শুরু করলাম। বলে রাখা ভালো জেলা পর্যায়ের কোনো কাগজে সংবাদপত্রের কাজে ঢাকার কাগজের মতো এতো বিভাজন নেই। সেখানে জুতা সেলাই থেকে চন্ডিপাঠ প্রত্যেককেই করতে হয়।
আরেক রাতের ঘটনা। মফস্বল পাতার মেকাপ করছি। পেস্টার বদরুল, মুজিবর ও আমি। হঠাৎ তরিকুল ভাই মেকাপ রুমে হাজির। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলেন। তারপর বললেন, ‘এই যে শোন মিন্টু! মেকাপটা হচ্ছে একটা শিল্প। সুন্দরী মেয়ে সাজানোর মতো। যেমন একটা মেয়েকে সাজাতে হলে নাকে নথ দেয়, কপালে টিপ পরায়। পায়ে আলতা মাখে। এরকম মেকাপটাও একটা শিল্প।’
একজন রাজনীতিক তরিকুল ইসলামের পত্রিকার প্রকাশক হিসেবে এই বোধ আমাকে বিস্মিত করে। পরক্ষণে পত্রিকার পাতার কোথায় সিঙ্গেল কলাম, কোথায় হেডিং- দুই কলাম বা তিন কলাম। কোন হেডিং এর ওপরে সোল্ডার, কোথায় রিভার্স–এসবের নিখুঁত বিবরণ দিয়ে কিছু পরামর্শ দিলেন। এক পর্যায়ে বললেন, ‘শোন ওই যে মফস্বলের নেতারা আছে না! ওদের নিউজ টিউজ একটু বেশি বেশি দিও। বুঝলে না ওরা তো আবার ফোরামের নেতা।’ আমি বললাম, ‘ভাই আমি তো নিউজের গুরুত্ব বুঝে ট্রিটমেন্ট দেই। কারো নাম দেখে ট্রিটমেন্ট দেওয়ার ব্যাপারে আমি নিমরাজী ভাই।’ এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে তরিকুল ভাই এক মুহূর্ত দেরি করলেন না। পেস্টিং রুম ত্যাগ করলেন। ভাবলাম বেয়াদবি করে ফেললাম কি? এরপর তরিকুল ভাই আর কোনো দিন মফস্বল প্রতিনিধিদের নিয়ে কিছু বলেননি।
লোকসমাজে থাকা অবস্থায় তরিকুল ভাইয়ের নিউজ কাভার করতে বিভিন্ন সময় সফরসঙ্গি হয়েছি। দেখেছি আমাকে আর সব সাংবাদিকের মতোই মূল্যায়ন করেছেন। নিজের অফিস স্টাফের মতো নয়। সব সময় সফরসঙ্গির খবর রাখতেন। বিশেষ করে সাংবাদিকদের খাওয়া দাওয়া নিয়ে তিনি ছিলেন অনেক বেশি সচেতন। খেয়েছি কী-না সেটাই ছিলো তার বেশি আগ্রহের জায়গা। কী নিউজ হবে, কোন ধরনের শিরোনাম বা ইন্ট্রো কী হবে তা জানতে চাননি, বলেও দেন নি।
একবার দুর্গাপূজায় মন্দির পরিদর্শনে গিয়েছেন মন্ত্রী তরিকুল ইসলাম। লোকসমাজের রিপোর্টার হিসেবে আমি তার সফরসঙ্গী। যশোরের এক গ্রাম। তরিকুল ইসলাম এসেছেন জানতে পেরে শত শত লোক হাজির। আমি পাশি দাঁড়িয়ে অবাক! দেখলাম- তিনি ওই গ্রামের অধিকাংশ মানুষকেই চেনেন। একেকজনের নাম ধরে ধরে ডেকে কথা বলছেন। এই রামপদ তোদের এই মন্দিরে এবার ১২ মণ গম দিয়েছি। পেয়েছিস তো? তোর বাবা কেমন আছেরে। এভাবে নাম ধরে ধরে গ্রামবাসিকে সম্বোধন করছেন। কত প্রখর স্মৃতিশক্তির অধিকারী ছিলেন এই রাজনীতিক। সেদিনই বুঝতে পেরেছি।
আজ তিনি চলে গেলেন। যাদের নাম ধরে ধরে তিনি ডাকতেন সেই যশোরের প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষ তাঁর জন্য নিশ্চয় কেঁদে কেঁদে বুক ভাসাবেন। দোয়া করি ওপাশে ভালো থাকবেন তরিকুল ভাই। আপনার আত্মার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক।
লেখক: সম্পাদক, দ্য রিপোর্ট টোয়েন্টিফোর ডটকম
(দ্য রিপোর্ট/একেএমএম/এনটি/নভেম্বর ০৪,২০১৮)