কালা মিয়া টি স্টল
বাশিরুল আমিন
এই যে আমরা সাত সকালে এখানে এসে চা পান করি। রং চা কিংবা গুড়ের চা। এ নিয়ে আমাদের ভেতর এক ধরনের আভিজাত্য কাজ করে। নিজেদের বড় এলিট ভাবতে থাকি। রাতের অপূর্ণ ঘুমটা ঝেড়ে ফেলার একটা অবলম্বন খুঁজে পাই। ঘুম থেকে উঠে ধীর পায়ে নেমে যাই জীবনের পথে- হালকা ব্রেক নেই কালা মিয়া টি স্টলে। সংসার নিয়ে সব বিতৃষ্ণা ধুয়ে ফেলতে কিংবা নতুন আরেকটি সতেজ দিনের আশায় স্টলের বেঞ্চে গিয়ে বসি। বয়সের বাড়ে নুয়ে আসা মানুষগুলির কোলাহলে জমে উঠছে রাঙা সকাল।
অবগুন্ঠিত ভোর কেটে গেছে। রঙিন আভার সাথে আমাদের সবার ভেতরটাও যেন চায়ের তেজে জেগে উঠছে। মজমার মানুষগুলির বয়স কমতে শুরু করেছে-তারা ফিরে পাচ্ছে পূণর্জীবণ। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিদায় নেওয়া বুড়ো প্রফেসর গণি সাহেব চায়ের চুমুক থামিয়ে যেন তার ক্লাসে ফিরে যান। তারপর আচমকা বলে বসেন, দুনিয়াটা নষ্ট হয়ে গেছে।
পরিবেশবিদ মাহতাব চৌধুরী। চা মুখে নিয়ে কুলকুচি করার মতো করে খানিক্ষণ গড়গড় করলেন। খুব বিরক্তি সহকারে চা-টা শেষ করে প্রফেসরের দিকে তাকিয়ে বললেন- কথাটা ভুল বলেছেন মাস্টার। দুনিয়াটা নষ্ট হয়নি নষ্ট হয়েছে মানুষ। দিনদিন বর্বর থেকে বর্বর হচ্ছে এই হোমো সেপিয়েন্স প্রজাতিটা। কালকের দৈনিক পড়ছেন- মানুষগুলি কিভাবে এতো বড় একটা বনকে পুড়িয়ে দিল। কেয়ামত আর দূরে নাইরে ভাই।
অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা মির্জা হাফিজ বলেন, আরে ওসব বাদ দাও; আজ থেকে ছ হাজার বছর আগে মিসরের একজন পণ্ডিত দুনিয়ার প্রতি বিরক্ত হয়ে, পাথরে লিখে গেছেন, দুনিয়াটা নষ্ট হয়ে গেছে। চায়ের কাপ বেঞ্চে রেখে দাড়িয়ে যান পঞ্চাশোর্ধ তরুণ কবি আলফ্রেড কামালি। ধমকের সুরে বলে ওঠেন- সব কিছু নষ্টদের অধিকারে...
পুব আকাশে ধীরে ধীরে আলো ফুটছিল। পাশের কদম গাছের ছায়ার নিচে বড় বড় পাতার ছায়া তির তির করে কাঁপছিল। ডায়বেটিস রোগি আতাউর সাহেবের সুগার শর্ট হওয়ায় তার গলা শুকিয়ে আসছিল। কালা মিয়াকে একটা চায়ের অর্ডার করে। স্টলের সামনে কালোপিচের রাস্তায় গিয়ে দাড়ালেন। খুব বিরক্ত গলায় বললেন, দুনিয়া কোনো কালেই খুব ভালো ছিল না, মন্দও ছিল না। ঐযে ছেলেটা সাইকেল দিয়ে যাচ্ছে ওকে ডেকে জিজ্ঞেস করো, দুনিয়াটা কেমন লাগে? তবে সব উত্তর পেয়ে যাবে।
"...অবসারপ্রাপ্ত এক সেনা কর্মকর্তা তার দিকে তেড়ে গেলেন- শালা কি বলিস তুই? স্টল বন্ধ করবি কেন? আমাদের চা খাওয়াকে কে... তোর বাপেনি বাইঞ্চোত... সকালে আমরা বসব কোথায়... কোথায় বসব আমরা..."
কালা মিয়ার স্টলে যারা আসেন সবাই নিয়মিত এবং কাছাকাছি বয়সের। চার পাঁচজন ছাড়া প্রায় সবাই বয়স্ক। সময়ের দীর্ঘতার কারণে হোক বা ছোট্ট স্টলের বেঞ্চে গায়ের সাথে গা লাগিয়ে চা পানের কারণেই হোক কাস্টমারদের মধ্যে পরস্পর একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হয়ে গেছে। ফলে এটা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা, ডায়াবেটিস রোগী ও ভোরে হাঁটতে হয় এমন লোকজনের একটা সমাবেশ স্থল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বেশ গর্ব করেই বিষয়টি বৈকালিক আড্ডায় বন্ধুদের কিংবা অফিসে কাজ করতে করতে কলিগকে শোনাই- চায়ের স্বাদ-গন্ধের কথা। নেশা ধরার ব্যাপার ইত্যাদি। শাহজালাল মাজারের পেছনে, ঠিক গোরস্থানে পশ্চিম-দক্ষিণ কোণে কালা মিয়া টি স্টল। যারা মাজার অঞ্চলে যাননি বা এ নিয়ে ধারণা নেই তাদের বলতে হচ্ছে- তার দোকানের শিডিউল হলো ভোর ৬টা থেকে ৮টা। এই দু ঘন্টার বাইরে স্টলটি সারাদিন বন্ধ থাকে।
আরো কিছু খুঁটিনাটি তথ্য জানাতে গেলে যা বলতে হয়; কালা মিয়া স্টলের মালিক ও একমাত্র কারিগরের নাম কালাচ্চা বা কালা চাচা। যেহেতু সবাই তাকে চাচা ডাকে এমনকি তার বয়সের অধিক লোকেরাও কাজেই ধরে নিতে হচ্ছে এটি তার নাম। এই দুই ঘন্টায় তিনি গুণে গুণে একশো কাপ চা বিক্রি করেন।
এখানে চা পানকারী সবচে তরুণতম সদস্য আমি। অন্যান্যরা চা খেতে খেতে যখন ছেলে মেয়ের বিয়া-শাদী, মৃত স্ত্রীর স্মৃতিচারণ, পেনশন বিষয়ক জটিলতা, বাতের ব্যথ্যা, কোষ্ঠকাঠিন্য কিংবা ডায়াবেটিস নিয়ে কথা বলে তখন আমি বাধ্য হয়েই কালাচ্চার সাথে কথা বলার চেষ্টা চালাই। খুবই মিতভাষী লোক, গুরুগম্ভীর চেহারার অধিকারী ফলে আলাপ তেমন গতি পায় না।
" নিশ্চিত মনে অফিসের পথে হাটা ধরি; নিজেকে প্রবোধ দেই, একদিন লাশ আসবে কালাচ্চা স্টল খুলবে। আমরা সবাই চায়ের পেয়ালা হাতে নিয়ে লাশের গন্ধ নয় জীবন পান করব।.. "
তার সাথে আলাপ জমাতে জিজ্ঞেস করি- চা এতো মজা করে বানান কিভাবে? কয়দিন ধরে এই ব্যবসায় আছেন? চা সংশ্লিষ্ট সমূহপ্রশ্ন দিয়েই কথাবার্তা চালিয়ে যাই। তিনি কথা কম বললেও আমাকে বেশ গুরুত্ব দেন। আমার ব্যপারে বিশদ চিন্তা করেন, বিশেষত বিয়ে করছি না কেন এসব। আমার ক্যান্সারাক্রান্ত দাদীর খোঁজ নেন কিংবা তার বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মেয়ের ক্যারিয়ার বিষয়ক কথাবার্তা চালিয়ে যান। খুচরো আলাপের আলাপের মধ্যে একদিন জানতে পারলাম গুণগত মান ঠিক রাখতে বিদেশি পাতা দিয়ে চা করেন চাচা। আর সেই কারণেই দাম রাখেন কাপ প্রতি বিশ টাকা। শোনে বেশ আরামবোধ করি।
২.
আজ সকালে কালাচ্চা সবাইকে জানালেন তার স্টলটি বন্ধ করে দেবেন। এই আকস্মিক ঘোষণায় সবাই হতবাক। দুয়েকজন খেপে গেলেন। অবসারপ্রাপ্ত এক সেনা কর্মকর্তা তার দিকে তেড়ে গেলেন- শালা কি বলিস তুই? স্টল বন্ধ করবি কেন? আমাদের চা খাওয়াকে কে... তোর বাপেনি বাইঞ্চোত... সকালে আমরা বসব কোথায়... কোথায় বসব আমরা... দুয়েকজন ভদ্রলোক সেনা কর্মকর্তাকে না থামালে চাচার অবস্থা থাকতো না।
প্রত্যেকেই স্টল বন্ধের কারণ-টারন জিজ্ঞেস করলেন কিন্তু কারো কাছেই মুখ খুলেননি কালাচ্চা। খুব যত্ন করে চা খাওয়ালেন সবাইকে। অন্যান্যদিনের মতোই।
নির্দিষ্ট সময় দোকান বন্ধ করে কালাচ্ছা হাঁটা ধরলেন বাসার পথে। আমি পিছু নিলাম। মাজার এলাকা পেরিয়ে বেশ করুণ গলায় জানতে চাইলাম ঘটনা কী? পশ্চিম আকাশে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন- দেশ-বিদেশের ব্যাপার। রাষ্ট্রীয় জটিলতার কারণে দেশে লাশ আসতেছে না। এয়ারপোর্টে ঝামেলা হচ্ছে, বাংলাদেশি দূতাবাসের অসহযোগীতার কারণে দেশের লাশ দেশে আসতে পারে না। তাই স্টল বন্ধ করে দিচ্ছি।
আমি অবাক না হয়ে পারিনি; এইসবের খবরও রাখেন চাচা! কিন্তু লাশের সাথে চায়ের সম্পর্ক কি কালাচ্চা? হাসলেন; মিয়া আমিতো মাজারের গোরস্থানের গোর খোদক। গোর খুদি আর অবসরসময়টায় চাস্টল চালাই। কফিনে করে আসা লাশের পাতা দিয়া চা বানাই। লাশের পচন ঠেকাবার জন্য মরদেহের কফিনে রাখা হয় চা পাতা। লাশ কবর দিয়ে পাতাগুলে আমি নিয়ে আসি। বিদেশি পাতা, সেই সাথে লাশের গন্ধ। স্বাদ বেড়ে যায় বহুগুণ। আর এইটাই আমার মূল পুঁজি। লাশ আসে না পাতাও আসে না। যখন আসবে তখনই আমি স্টল খুলব।
আমি আর তাকে ঘাটাই না। বিস্ময়ে আমার তালু শুকিয়ে আসছে। থরথর করে কাপছে শরীর। তবুও কালাচ্চার চায়ের তৃষ্ণা আমার মগজের কোষে কোষে ছুটতে থাকে। আমি ভুলে যাই লাশের কথা। নিশ্চিত মনে অফিসের পথে হাটা ধরি; নিজেকে প্রবোধ দেই, একদিন লাশ আসবে কালাচ্চা স্টল খুলবে। আমরা সবাই চায়ের পেয়ালা হাতে নিয়ে লাশের গন্ধ নয়, জীবন পান করব।
(দ্য রিপোর্ট/একেএমএম/নভেম্বর ৩০,২০১৮)