পশু-পাখির প্রতি দয়ার গুরুত্ব
দ্য রিপোর্ট ডেস্ক : মহান আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে সৃষ্টি করে এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। তিনি মানুষকে এমন কিছু গুণ দিয়েছেন তা পশু-পাখি কিংবা অন্য কোনো সৃষ্টির মধ্যে নেই। এ ধরনের একটি গুণ হল- অপরের প্রতি দয়া বা অনুগ্রহ করা। মানুষ কেবল মানুষের প্রতি দয়া করবে এমনটি নয়, বরং পশুপাখির প্রতিও দয়া প্রদর্শন করতে হবে। ইসলাম ধর্মে এ ব্যাপারে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) সব সময় পশু-পাখির প্রতি দয়া প্রদর্শন করেছেন। অকারণে তাদের মেরে ফেলা, খাওয়ার জন্য ছাড়া হত্যা করা, তাদের উপর বেশি বোঝা চাপানো, নিজেদের মনোরঞ্জনের জন্য কষ্ট দেয়াকে মহানবী নিষেধ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আল্লাহর অভিশাপ সেই ব্যক্তির উপর, যে অকারণে পশুর অঙ্গহানী ঘটায়।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো কারণ ছাড়াই কোনো পাখি হত্যা করবে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তার হিসাব নেবেন।’
অকারণে পশু-পাখি হত্যা করতে ইসলামে যেমন নিষেধ করা হয়েছে তেমনি কোনো পশু রোগে আক্রান্ত হলে তাকে দ্রুত চিকিৎসার বিষয়েও জোর দেয়া হয়েছে। রোগাক্রান্ত পশুকে সুস্থ পশু থেকে আলাদা রাখতে বলা হয়েছে। যাতে করে অন্য পশু রোগাক্রান্ত না হয়। এমনিভাবে ইসলাম পশু-পাখির সব অধিকার সংরক্ষণের ব্যাপারে খুব গুরুত্বারোপ করেছে।
পশু-পাখির প্রতি মানুষের দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কেই কয়েকটা ঐতিহাসিক ঘটনা জানব এখন আমরা-
১.
একদিন বিকেলবেলা মহানবী (সা.) এক বনের ধার দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি দেখলেন বনের ধারে একটি তাঁবু। তাঁবুর সামনে গাছের সাথে একটি হরিণী বাঁধা। তিনি লক্ষ্য করলেন হরিণীটির চোখ দুটো ছলছল করছে। দুধের ভারে বাঁট দু'টি পরিপূর্ণ হয়ে আছে। তিনি বুঝতে পারলেন, নিশ্চয়ই হরিণীটির দুগ্ধপোষ্য বাচ্চা রয়েছে। হরিণীটি হয়তো সকালে ধরা পড়েছে। তাই বাচ্চাকে দুধ খাওয়াতে পারেনি। তিনি শিকারিদের ডেকে বললেন,‘তোমরা হরিণীটিকে ছেড়ে দাও। কারণ মায়ের দুধ না পেয়ে কয়েকটি কচি বাচ্চা হয়তো প্রাণ হারাবে।'
শিকারীরা ছিল ইহুদী। বনের পশুদের প্রতি রসূল (সা.) দরদ দেখে তারা হরিণীটিকে ছেড়ে দিল এবং রসূল (সা.)-এর হাতে কালেমা পড়ে মুসলমান হয়ে গেল।'
২.
আরেক দিনের ঘটনা। একটি বালক পাখির বাসা থেকে দু'টি পাখির ছানা নিয়ে যাচ্ছিল। মা পাখিটা ছানার শোকে পাগলপ্রায় হয়ে বালকটির মাথার উপর উড়াউড়ি করতে লাগল। এইদৃশ্য দেখে রাসূল (সা.) বালকটিকে বললেন, ‘ছানা দু'টি বাসায় রেখে এসো। দেখছ না, মা পাখিটি কেমন অস্থির হয়ে তোমার মাথার ওপর ওড়াউড়ি করছে!’ রাসূল (সা.)-এর কথা শুনে বালকটি ছানা দু'টিকে বাসায় রেখে এল। ছানা দু'টিকে পেয়ে মা পাখিটি আদর সোহাগ করতে লাগল। এ দৃশ্য দেখে রাসূল (সা.) এর আনন্দের আর সীমা রইল না।'
৩.
হাদিসে এসেছে, একদা এক ব্যক্তি হাঁটতে হাঁটতে পিপাসার্ত হয়ে গেল। এরপর লোকটি একটি কূপে নেমে পানি পান করে এসে দেল একটা কুকুরকে পিপাসায় কাতরাচ্ছে আর তৃষ্ণা মেটানোর জন্য ভিজা মাটি খাচ্ছে। এ দৃশ্য দেখে লোকটি মনে মনে বলল: কুকুরটির নিশ্চয়ই আমার মতোই পিপাসা লেগেছে। এরপর তিনি আবারও কূপে নেমে জুতায় পানি ভরে উপরে এসে কুকুরটিকে পানি পান করালেন। কুকুরের প্রতি তার দয়া দেখে আল্লাহ তার ওপর খুশি হয়ে তাকে ক্ষমা করে দিলেন। সাহাবিরা বললেন: হে আল্লাহর রাসুল, পশুর মধ্যেও কি আমাদের কোনো পুণ্য আছে? নবী (সা.) বললেন, প্রত্যেক প্রাণের মধ্যেই প্রতিদান রয়েছে।’
৪.
এ পর্যায়ে আমরা এক গোলামের পশুপ্রেমের কাহিনী জানব । বিশিষ্ট সাহাবী ছিলেন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে জাফর (রা.)। তিনি ছিলেন, হযরত জাফর ইবনে আবু তালিবের ছেলে এবং আমিরুল মোমেনীন হযরত আলী (আ.)-এর জামাতা। আব্দুল্লাহ ইবনে জাফরের সাথে হযরত আলীর কন্যা যয়নাব (রা.)'র বিয়ে হয়।
হযরত আব্দুল্লাহ একবার কোথাও যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে একটি বাগান দেখে বিশ্রাম নেয়ার জন্য তিনি থেকে গেলেন। সেই বাগানে একজন হাবশী গোলাম কাজ করছিলো। এ সময় গোলামটির জন্য এক লোক খাবার নিয়ে এলো। সেখানে ছিল মাত্র তিনটি রুটি। যে লোকটি খাবার নিয়ে এলো তার পিছু পিছু একটি কুকুরও এলো। গোলাম খাবার হাতে নিয়ে সেখান থেকে একটি রুটি কুকুরকে দিল। সাথে সাথে কুকুর রুটিটি খেয়ে ফেলল এবং আরো রুটি পাওয়ার আশায় তাকিয়ে থাকল। এবার ওই হাবশী গোলাম আরো একটি রুটি কুকুরটির সামনে ছুড়ে দিলো। এবারও কুকুর রুটিটি খেয়ে ফেলল এবং রুটির পাত্রের দিকে তাকিয়ে রইলো। কুকুরকে তাকিয়ে থাকতে দেখে গোলাম তার সর্বশেষ রুটিটিও কুকুরকে দিয়ে দিল।
কুকুরকে তিনটি রুটিই দিয়ে দেয়ার ঘটনাটি হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে জাফর খুব মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করছিলেন। সবগুলো রুটি কুকুরকে দেয়ার পর হযরত আব্দুল্লাহ গোলামকে জিজ্ঞেস করলেন, প্রতিদিন খাওয়ার জন্য তোমার জন্য কয়টি রুটি আসে? গোলাম জবাব দিল, মনিবের বাড়ী থেকে আমার জন্য প্রতিদিন তিনটি রুটি পাঠানো হয়। ওই তিনটি রুটি দিয়েই আমি সারাদিন পার করি। এরপর হযরত আব্দুল্লাহ বললেন, তাহলে তুমি সবগুলো রুটি কুকুরকে দিয়ে দিলে কেন? গোলাম জবাব দিল, আমাদের এ এলাকায় কোনো কুকুর নাই। আমার মনে হয়, ক্ষুধার্ত এ কুকুরটি দূরের কোন এলাকা থেকে এসেছে। তার আসতে নিশ্চয়ই অনেক কষ্ট হয়েছে। ক্ষুধার্ত কুকুরটিতে না খাইয়ে আমি নিজে স্বার্থপরের মতো রুটিগুলো খাবো-এটা আমার ভাল লাগেনি। তাই আমি তাকে সবগুলো রুটি দিয়ে দিয়েছি। এবার হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে জাফর জিজ্ঞেস করলেন, আজ সারাদিন তুমি কি খাবে? গোলাম জবাব দিলো, একদিন না খেলে তেমন কোনো কষ্ট হবে না। তাছাড়া কুকুরটির ক্ষুধা দূর করতে পেরে আমার ভালোই লাগছে।
গোলামের এ জবাব শুনে হযরত আব্দুল্লাহ মনে মনে ভাবলেন, লোকেরা আমাকে বড় দানশীল মনে করে থাকে অথচ এ গোলাম দেখছি আমার চেয়েও বড় দানশীল! এরপর তিনি সেখান থেকে শহরে চলে গেলেন। শহরে গিয়ে তিনি বাগানটির মালিকের সাথে দেখা করলেন এবং বাগান ও গোলামকে কিনে নিলেন। এরপর গোলামটিকে আযাদ করে দিলেন এবং বাগানটি গোলামকে দান করে দিলেন। এই ছিল জীব প্রেমী এক গোলামের প্রতি হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে জাফর (রা.)এর বদান্যতা।
(দ্য রিপোর্ট/একেএমএম/ডিসেম্বর ০২,২০১৮)