দ্য রিপোর্ট ডেস্ক :  ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী অরিত্রী অধিকারীর আত্মহত্যার ঘটনায় এক শিক্ষককে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ৷ আরো দু'জনকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে৷ তবে প্রশ্ন উঠেছে– এই ধরনের ঘটনার জন্য কি শুধু শিক্ষকরাই দায়ী?

বুধবার রাতে গ্রেপ্তার করা হয় ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের বেইলি রোড শাখার শ্রেণি শিক্ষক হাসনা হেনাকে৷ ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদাউস, বেইলি রোড ক্যাম্পাসের প্রভাতী শাখার প্রধান জিনাত আক্তারকেও পুলিশ গ্রেপ্তারের চেষ্টা করছে৷ তাঁদের তিন জনের বিরুদ্ধে আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগে মামলা হয়েছে৷ ওই তিন জন শিক্ষককে এরইমধ্যে প্রাথমিক তদন্তের ভিত্তিতে সাময়িক বরখাস্তও করা হয়েছে৷

একটি অভিযোগকে কেন্দ্র করে অভিভাবকের সঙ্গে শিক্ষকরা দুর্ব্যবহার করায় ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির প্রভাতী শাখার শিক্ষার্থী অরিত্রী অধিকারী আত্মহত্যা করেন গত সোমবার৷ এরপর শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকরা এর প্রতিকার চেয়ে ৬ দফা দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন৷ ক্লাস ও পরীক্ষা বন্ধ হয়ে যায়৷ মূল দাবিগুলো পূরণ হওয়ায় বৃহস্পতিবার বিকেলে তাঁরা আন্দোলন স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছেন৷ তার আগে স্কুলের গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান গোলাম আশরাফ তালুকদার অরিত্রী অধিকারীর আত্মহত্যার ঘটনায় প্রকাশ্যে ক্ষমা চান৷ তিনি বলেন, ‘‘আমাদের একজন শিক্ষার্থীর অকাল মৃত্যুতে আমরা সহমর্মিতা প্রকাশ করছি, ক্ষমা চাচ্ছি৷''


‘‘ভিকারুননিসার ঘটনায় আমরা যা দেখি, শিক্ষার্থী একটা ভুল করেছে, সে কোড অব কন্ডাক্ট লঙ্ঘন করেছে৷ এর বিপরীতে শিক্ষকরা তার ও তার অভিবাবকের সঙ্গে যে দুর্ব্যবহার করেছে, তা গ্রহণযোগ্য নয়৷ আরো সফটলি হ্যান্ডেল করা যেতো৷ কিন্তু এর ফলে এখন শিক্ষকদের আটক করা হচ্ছে, বাড়ি বাড়ি গিয়ে খুঁজে খুঁজে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে৷ এটা বাড়াবাড়ি৷''




এদিকে ভিকারুননিসা স্কুলের ছাত্রীর আত্মহত্যা একক এবং বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা হিসেবে দেখতে চাননা শিক্ষক এবং শিক্ষাবিদরা৷ তাঁরা মনে করেন, ওই ছাত্রীর আত্মহত্যা আমাদের পুরো শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটি বা গলদের প্রকাশ৷ শিক্ষা বিজ্ঞানের পদ্ধতিগুলো বাংলাদেশে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান, পরীক্ষা থেকে শুরু করে কোনো ক্ষেত্রেই সেই অর্থে অনুসরণ করা হয় না৷ আর ছাত্র অনুপাতে শিক্ষণ নেই, নেই পর্যাপ্ত প্রশিক্ষিত শিক্ষক৷ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে মনোবিশেষজ্ঞ ও শিশু মনোবিশেষজ্ঞ নেই৷ অভিভাককরাও সচেতন এবং প্রশিক্ষিত নন৷ তাঁদের কাছে ভালো ফল, ক্লাসে প্রথম হওয়া, সবার উপরে থাকা মূখ্য৷ এ নিয়ে তাঁরাও সন্তানদের ওপর চাপ সৃষ্টি করেন৷ এর ফলে পুরো শিক্ষা ব্যবস্থায় এক ধরনের সংকট তৈরি হয়েছে৷ শিক্ষার্থীরা এখন আর জানার জন্য পড়ে না, পড়ে ক্লাসে ফার্স্ট-সেকেন্ড হওয়ার জন্য৷

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা গবেষণা ইন্সটিউটের অধ্যাপক মুজিবুর রহমান লাভলু বলেন,‘‘ভিকারুননিসার ঘটনায় আমরা যা দেখি, শিক্ষার্থী একটা ভুল করেছে, সে কোড অব কন্ডাক্ট লঙ্ঘন করেছে৷ এর বিপরীতে শিক্ষকরা তার ও তার অভিবাবকের সঙ্গে যে দুর্ব্যবহার করেছে, তা গ্রহণযোগ্য নয়৷ আরো সফটলি হ্যান্ডেল করা যেতো৷ কিন্তু এর ফলে এখন শিক্ষকদের আটক করা হচ্ছে, বাড়ি বাড়ি গিয়ে খুঁজে খুঁজে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে৷ এটা বাড়াবাড়ি৷''

তিনি বলেন,‘‘আমরা শিক্ষকদের ভিলেন বানিয়ে ফেলছি, এটা করা ঠিক না৷ পুরো শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষকরা একটি অংশ৷ এখন আমাদের পুরো শিক্ষাব্যবস্থায়ই ত্রুটি দেখা যাচ্ছে৷ তারই বহিপ্রকাশ ঘটছে৷ আর তার জন্য শুধু শিক্ষকদের কেন দায়ী করা হচ্ছে? এভাবে করা হলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে৷ শিক্ষকদের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করানো মোটেই ঠিক হবে না৷''


‘‘ব্যর্থতাই যে জীবনের সব কিছু শেষ করে দেয় না এটা আমাদের শিক্ষার্থীদের বোঝাতে হবে, জানাতে হবে৷ অনেকেই পরীক্ষায় খারাপ করেছে, কিন্তু জীবনে সফল হয়েছে৷ কিন্তু আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা উল্টো৷ এখানে শুধু পরীক্ষায় ফার্স্ট-সেকেন্ড হওয়ার কথা বলা হয়৷ এই যে একটি শিশুর জীবন গেল, এটা কি আমরা মেনে নিতে পারি? মেনে নেয়া যায়না৷ সে আসলে আমাদের ব্যবস্থার শিকার৷ এই ব্যবস্থাকে বদলাতে হবে৷ যারা তার ও তার পরিবারের সঙ্গে খারাপ আচরণ করেছেন, তারা যেমন অন্যায় করেছেন, তেমনি এর প্রতিক্রিয়ায় বাড়াবাড়ি করাও ঠিক হবে না৷ আমাদের সঠিক শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য কাজ করতে হবে৷''




তিনি আরো বলেন,‘‘আমরা কাদের শিক্ষক বানাচ্ছি তাও তো আমাদের বিবেচনা করতে হবে৷''

মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক মোহাম্মদ আল আমিন বলেন, ‘‘একজন শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা দুঃখজনক৷ এটা আমাদের কষ্ট দেয়৷ কিন্তু এর জন্য শিক্ষককে এককভাবে দায়ী করা যায় না৷ কারণ, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিপত্রে বলা হয়েছে, পরীক্ষার হলে মোবাইল ফোন নেয়া যাবে না৷ এখন এটা তো অভিবাবকেরও দেখা দায়িত্ব৷ কোনো শিক্ষাথীর মানসিক গঠন বা অবস্থা কেমন তা কি শিক্ষকরা বোঝেন? সবার কি সেই প্রশিক্ষণ আছে? ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত হিসাব করলে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে আলাদাভাবে পরিচর্যা করার সুযোগ কি শিক্ষক পান? এই বিষয়গুলোকে বিবেচনা করলে দেখা যাবে দায়িত্ব যেমন সবার, দায়ও সবার৷ আমরা এই দায়িত্ব পালন না করায় শিক্ষাব্যবস্খায় সংকট দেখা দিয়েছে৷ এটা সামাজিক সমস্যা৷''

তিনি আরো বলেন,‘‘নানা কারণে এখন ছাত্র ও শিক্ষদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে৷ শিক্ষক যেমন যত্ন নিতে পারছে না, ছাত্ররাও আগের মতো শিক্ষকদের সম্মান করে না৷''

উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মো. আবুল হোসেন বলেন,‘‘ভিকারুননিসার ঘটনায় তদন্তে যা হয় তাই হবে, আইনে যা হয় তাই হবে৷ এটা নিয়ে এর বেশি কিছু আমি বলতে চাই না৷ তবে আমাদের এখন অনেক কিছু বিবেচনায় নিতে হবে৷ বাচ্চাদের ওপর অনেক কিছু চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে৷ এটা নিয়ে সবাইকে ভাবতে হবে৷ স্কুলে মোবাইলসহ ইলেট্রনিক ডিভাইস আনা ছাত্রদের নিষেধ৷ এটার জন্য শুধু শিক্ষক নয় , অভিভাবকদেরও কাজ করতে হবে৷ আর শিক্ষার্থী ভুল করলে তাকে কীভাবে বলতে হবে সেই প্রশিক্ষণতো সব শিক্ষকের নাই৷ একটি স্কুলে চাইল্ড সাইকোলজিস্ট, এডুকেশন সাইকোলজিস্ট থাকা দরকার৷ কিন্তু বাস্তবে তো নেই৷ শিক্ষকদের প্রশিক্ষণও নেই৷ তাহলে সমস্যাটা তো অনেক বড়৷ এটা নিয়ে সবার ভাবার সময় এসেছে৷''

আর শিক্ষাবিদ অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ বলেন,‘‘ব্যর্থতাই যে জীবনের সব কিছু শেষ করে দেয় না এটা আমাদের শিক্ষার্থীদের বোঝাতে হবে, জানাতে হবে৷ অনেকেই পরীক্ষায় খারাপ করেছে, কিন্তু জীবনে সফল হয়েছে৷ কিন্তু আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা উল্টো৷ এখানে শুধু পরীক্ষায় ফার্স্ট-সেকেন্ড হওয়ার কথা বলা হয়৷ এই যে একটি শিশুর জীবন গেল, এটা কি আমরা মেনে নিতে পারি? মেনে নেয়া যায়না৷ সে আসলে আমাদের ব্যবস্থার শিকার৷ এই ব্যবস্থাকে বদলাতে হবে৷ যারা তার ও তার পরিবারের সঙ্গে খারাপ আচরণ করেছেন, তারা যেমন অন্যায় করেছেন, তেমনি এর প্রতিক্রিয়ায় বাড়াবাড়ি করাও ঠিক হবে না৷ আমাদের সঠিক শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য কাজ করতে হবে৷''

এদিকে বৃহস্পতিবার শিক্ষার্থীরা আন্দোলন স্থগিতের সময় তাদের পক্ষে শিক্ষার্থী আনুশকা বলেন, ‘‘আমাদের কোনো নির্দোষ শিক্ষক ও শিক্ষার্থী যাতে এই ঘটনায় হেনস্থা না হয়, আমরা সেটা চাই৷ ঘটনার একটি সুষ্ঠু তদন্ত চাই৷ আমরা চাই দোষীরা বিচারের মুখোমুখি হোক৷''

সূত্র:ডয়চে ভেলে


(দ্য রিপোর্ট/একেএমএম/ডিসেম্বর ০৭, ২০১৮)