ব্যাংকগুলোতে এ যাবৎকালের সবচেয়ে নাজুক অবস্থা বিরাজ করছে
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ
দেশের ব্যাংকগুলোতে এযাবতকালের সবচেয়ে নাজুক অবস্থা বিরাজ করছে। সরকারি সেক্টরে ৩২ শতাংশ, বেসরকারি সেক্টরে ৬.৭ শতাংশ ঋণ শ্রেণিকৃত। পরিস্থিতি ক্রমে আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে। প্রতি বছর তার আগের বছরের চেয়ে খারাপ হচ্ছে।
ব্যাংকের ৭-৯ শতাংশ চলতি মূলধন যোগান দেয় শেয়ার হোল্ডার বা মালিক পক্ষ। ৯০ শতাংশের বেশি যোগান দেয় আমানতকারীরা। পরিচালনা পর্ষদের সদস্যবৃন্দ শেয়ার হোল্ডারদের দ্বারা নির্বাচিত। তারা স্বাভাবিকভাবেই মালিক পক্ষের স্বার্থ সংরক্ষণ করেন। ৯০ শতাংশ স্টেকহোল্ডার আমানতকারীর স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য বোর্ডে কেউ নেই। এজন্য বিশ্বের সর্বত্র স্বাধীন ও শক্তিশালী কেন্দ্রীয় ব্যাংক গঠন করা হয়েছে জনস্বার্থ তথা আমানতকারীর স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য। বোর্ড তথা মালিকদের সংযত করাই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আইনি ও নৈতিক দায়িত্ব। বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ দায়িত্ব পালনে অক্ষম।
ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক আইনের ৭ নং ধারা অনুযায়ী বিশেষ অবস্থায় কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে নির্দেশনা প্রদানের। এ যাবৎকালে ভারত সরকার এ ক্ষমতা প্রয়োগ করেনি। একবার ৭ ধারার অধীনে কিছু নির্দেশনার কথা ওঠার পর পরই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর পদত্যাগের হুমকি দিয়েছিলেন। বাংলাদেশ ব্যাংক আইনের ৭ ধারাতে সরকারের হাতে এই ধরনের ক্ষমতা ছিল, যা ২০০৩ সালে সংশোধনীর মাধ্যমে অবলুপ্ত হয়। আইন না থাকলেও সরকারের লিখিত ও মৌখিক উভয় প্রকারে অনবরত কেন্দ্রীয় ব্যাংককে নির্দেশ দিচ্ছে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুবোধ বালকের মতো সেটা পালন করছেন। সরকার ধনী মালিক শ্রেণির স্বার্থকে প্রাধান্য দিচ্ছে বিধায় আমানতকারীর স্বার্থ বিঘ্নিত হচ্ছে। শুধু সরকার নয় ব্যাংক মালিকরাও ব্যাংকের ওপর খবরদারি করছেন।
ব্যাংকিং কোম্পানি আইনের ৪৬ ধারায় দোষী ব্যাংক পরিচালকদের অপসারণের ক্ষমতা বাংলাদেশ ব্যাংককে দেওয়া হয়েছে। পুরো বোর্ড দায়ী হলে ৪৭ ধারায় বোর্ডকে অপসারণের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু উভয় ধারায় শর্ত রয়েছে, সরকারি ব্যাংকে এই আইন প্রযোজ্য হবে না। সরকার কি আইনের ঊর্ধ্বে? একই দেশে দুই আইন কেন? এ কারণেই কি সরকারি ব্যাংকে খেলাপি ঋণ ৩২ শতাংশ আর ব্যক্তি খাতে ৬.৭ শতাংশ?
বিশ্বের কোনো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিষয় নিয়ে বেসরকারি ব্যাংকের মালিকদের সঙ্গে বৈঠক করেন না। অলিখিত এই নিয়ম-আচার সব জায়গায় পালন করা হয়। কারণ উভয়ের স্বার্থ পরস্পরবিরোধী। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বার্থ পরিচালকদের খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখা। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর একটি হোটেলে গিয়ে ব্যাংক মালিকদের সঙ্গে বৈঠক করে সিআরআর হ্রাস করার কথা বিবেচনা করলেন।
মাননীয় অর্থমন্ত্রীর উৎসাহে ব্যাংক মালিকরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঘাড়ে চেপে বসেছেন। এখনও গভর্নর সুবোধ বালকের ভূমিকায়। ফলে যা হবার তাই হচ্ছে।
বিশ্বের উন্নত দেশের মতো ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার গভর্নর জবাবদিহি করেন পার্লামেন্টে। বাংলাদেশের গভর্নর জবাবদিহি করেন অর্থ মন্ত্রণালয়ে।
বাংলাদেশ ব্যাংক আইন প্রয়োগে উদ্যত হলে, মালিকদের প্রভাবে সরকার আইনটিই পালটে ফেলেছে। সম্প্রতি দেশের একটি ব্যাংকের বোর্ডে এক পরিবারের পাঁচ জন সদস্য থাকায় জনগণের আমানতের নয়-ছয় হচ্ছিল। বোর্ডে এক পরিবার থেকে দুজনের বেশি পরিচালক না থাকার বিধান ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যবস্থা গ্রহণে উদ্যোগী হবার পর আইনটি পালটে ফেলা হলো। এবার এক পরিবার থেকে ৪ জন সদস্য ৯ বছর পর্যন্ত থাকতে পারবে। আইনের নিজ গতিতে চলার কথা। কিন্তু নিজ গতিতে চলতে গেলে আইনকে পালটে ফেলা হয়।
বাজার অর্থনীতিতে প্রবেশের পর থেকে ব্যাংকের সুদ নির্ভর করে বাজারের ওপর। বাংলাদেশ ব্যাংক বা সরকার নির্ধারণ করে না। কিছুদিন আগে ব্যাংক মালিক সমিতি আমানতে সুদের হার ৯% ও ৬% শতাংশ ঘোষণা করলেন প্রধানমন্ত্রীর দোহাই দিয়ে। ধমক দিলেন এটি না মানলে তাকে পদচ্যুত করা হবে। প্রথমত: প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ তার সরকারি মুখপাত্র ঘোষণা করবেন। এক্ষেত্রে ঘোষণাকারী ব্যক্তিটি তার সরকারি মুখপাত্র নন। তাছাড়া ব্যাংকের এমডির কেন্দ্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করার কোনো ক্ষমতা নেই। এসব কিসের আলামত?
বেসিক ব্যাংকে আগে খেলাপি ঋণ ছিল মাত্র ২ শতাংশ। রাজনৈতিক বিবেচনায় চেয়ারম্যান নিয়োগ দিয়ে খেলাপি ঋণ ৮০ শতাংশে গিয়ে পৌঁছল। তাকে অপসারণ করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক সুপারিশ পাঠাল সরকারের কাছে। সরকার সেটা আমলে নিল না। এই চেয়ারম্যান তার মেয়াদ শেষ হবার আগের দিন পদত্যাগ করে চলে গেলেন। আজ পর্যন্ত তাকে কেউ স্পর্শ পর্যন্ত করতে পারল না; দুদকও না। এই হলো আইনের শাসনের নমুনা।
সুপারিশমালা
১। নতুন বছরে নতুন সংসদ গঠিত হবার পর দেশের ব্যাংকিং সেক্টর নিয়ে একটি সমীক্ষা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সংসদে আলোচনা করতে হবে।
২। সংসদের সুপারিশের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক গভর্নর নিয়োগ দেওয়া হবে। গভর্নর জবাবদিহি করবেন সংসদীয় কমিটি তথা সংসদে।
৩। অর্থ মন্ত্রণালয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকে মৌখিক বা লিখিত কোনো নির্দেশনা দেবেন না। ২০০৪ সালে ৭ নং ধারা সংশোধনের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ থাকে না। এখন যা ঘটছে তা সম্পূর্ণ বেআইনি। সরকার নিজেই এই বেআইনি কাজ করছে। আইন অনুযায়ী অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যে একটি কোঅর্ডিনেশন কমিটির মাধ্যমে যোগাযোগ করতে হবে।
৪। এক পরিবার থেকে চার জন পরিচালক থাকার বিধান পুনরায় সংশোধন করে দুই জন পরিচালক রাখার পূর্ব ব্যবস্থা বহাল করতে হবে। যাতে কায়েমি স্বার্থ দীর্ঘায়িত না হয়। কারণ ব্যাংক চলে জনগণের টাকায়। ধনী মালিকদের টাকায় নয়।
৫। ব্যাংক পরিচালনায় ব্যাংক মালিক সমিতির কোনো আইনি অধিকার নেই। তাদেরকে তাদের নিজ ভূমিকায় ফিরে যেতে হবে।
৬। ব্যাংক কোম্পানি আইনের ৪৬ ও ৪৭ ধারা সংশোধন করে আইনটি দেশের সকল তফসিলি ব্যাংকের জন্য প্রযোজ্য করতে হবে।
৭। বেসিক ব্যাংকের ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনসমূহ সংসদীয় কমিটি কর্তৃক পর্যালোচনা ও তাদের সুপারিশসহ সংসদে উপস্থাপন করতে হবে।
৮। ব্যাংকের পরিচালক হবার জন্য ২ শতাংশ শেয়ার প্রয়োজন- এই আইন পাল্টাতে হবে। যাতে কম ধনী অথচ যোগ্য ব্যক্তি আসতে পারেন।
৯। পরিচালনা পর্ষদ যেন জমিদারের ভূমিকায় না যান।
[সিপিডি আয়োজিত ‘বাংলাদেশের ব্যাংক খাত নিয়ে আমরা কী করব’ শীর্ষক এক সংলাপে খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের লিখিত বক্তব্য]
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ: ব্যাংকার, সাবেক ডেপুটি গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক।
(দ্য রিপোর্ট/একেএমএম/ডিসেম্বর ১০,২০১৮)