দ্য রিপোর্ট ডেস্ক : বিশ্বের ১৬টি দেশে কাজ করার জন্য যেতে কত টাকা করে খরচ হবে তা নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এর চেয়ে বেশি টাকা খরচ করতে হয় একজন অভিবাসন প্রত্যাশীকে। বিভিন্ন সংস্থার গবেষণা বলছে একজন অভিবাসন প্রত্যাশীর যেই টাকা অভিবাসনে খরচ হয় তার একটি বিপুল অংশ চলে যায় মধ্যসত্ত্বভোগকারীর কাছে। তাই আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবসে এখনও অভিবাসন খরচ নিয়ন্ত্রণ একটা বড় চ্যালেঞ্জ মনে করে সরকার। অন্যদিকে অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন মধ্যসত্ত্বভোগীদের নিয়ন্ত্রণ না করলে অভিবাসন খরচ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।


জাতিসংঘের অভিবাসন সংস্থা আইওএম’র সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে বাংলাদেশ এখনও উচ্চ অভিবাসন খরচের দেশেগুলোর মধ্যে অবস্থান করছে। পুরুষ অভিবাসন প্রত্যাশীদের ক্ষেত্রে খরচ হচ্ছে সর্বোচ্চ সাত লাখ টাকা এবং নারী অভিবাসন প্রত্যাশীদের ক্ষেত্রে খরচ হচ্ছে ৯৫ হাজার টাকা, যেখানে অভিবাসী শ্রমিকদের বেতন ২৫ হাজার থেকে ১ লাখ টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ। এর মধ্যে অনেকেই আছেন যারা ১৫ -৩০ হাজার টাকার বেশি আয় করতে পারেন না। গবেষণায় আরও বলা হয়েছে বেশিরভাগ অভিবাসন প্রত্যাশী শ্রমিক সরাসরি রিক্রুটিং এজেন্সির কাছে না গিয়ে মধ্যসত্ত্বভোগীদের ওপর নির্ভর করে।
অন্যদিকে, বেসরকারি সংস্থা রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিট (রামরু) বলছে গত তিন বছরে টাকার অংকে অভিবাসন ব্যয় ১০ শতাংশ কমেছে। এই কমার হার বাংলাদেশ থেকে মধ্যপ্রাচ্য এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতেও লক্ষ্য করা গেছে বলে এক জরিপে জানা গেছে। সুইস এজেন্সি ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কোঅপারেশনের (এসডিসি) সহযোগিতায় জরিপটি পরিচালনা করে রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিট (রামরু)। ২০১৪ থেকে ২০১৭ সালে বাংলাদেশ থেকে মধ্যপ্রাচ্য এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে অভিবাসন ব্যয় কমেছে। ২০১৪ সালে জরিপে দেখা গেছে পরিবার থেকে যেসব পুরুষ অভিবাসন করেছেন তাদের গড়ে ৩ লাখ ৮২ হাজার ৩১ টাকা খরচ করতে হয়েছিল। ২০১৪ থেকে ২০১৭ সালের ভেতরে যারা অভিবাসন করেন, তাদের খরচ করতে হয় ৩ লাখ ৪২ হাজার ২৫৪ টাকা। অর্থাৎ গত তিন বছরে টাকার অংকে অভিবাসন ব্যয় কমেছে ১০ শতাংশ।
এদিকে সরকারের নির্ধারিত অভিবাসন খরচ - সিঙ্গাপুরে (প্রশিক্ষণসহ) দুই লাখ ৬২ হাজার ২৭০ টাকা, সৌদি আরবে একলাখ ৬৫ হাজার টাকা, মালয়েশিয়ায় একলাখ ৬০ হাজার টাকা, লিবিয়ায় একলাখ ৪৫ হাজার ৭৮০ টাকা, বাহরাইনে ৯৭ হাজার ৭৮০ টাকা, সংযুক্ত আরব আমিরাতে একলাখ সাত হাজার ৭৮০ টাকা, কুয়েতে একলাখ ছয় হাজার ৭৮০ টাকা, ওমানে একলাখ ৭৮০ টাকা, ইরাকে একলাখ ২৯ হাজার ৫৪০ টাকা, কাতারে একলাখ ৭৮০ টাকা, জর্ডানে একলাখ দুই হাজার ৭৮০ টাকা, মিশরে একলাখ ২০ হাজার ৭৮০ টাকা, রাশিয়ায় একলাখ ৬৬ হাজার ৬৪০ টাকা, মালদ্বীপে একলাখ ১৫ হাজার ৭৮০ টাকা, ব্রুনাইয়ে একলাখ ২০ হাজার ৭৮০ টাকা ও লেবাননে একলাখ ১৭ হাজার ৭৮০ টাকা।

অনুসন্ধান এবং বিদেশ ফেরত শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সৌদিআরব যেতে একজন পুরুষ শ্রমিককে খরচ করতে হয় ৫ থেকে ৯ লাখ টাকা, মালয়েশিয়ায় যেতে খরচ করতে হয় সাড়ে তিন লাখ থেকে ৫ লাখ টাকা।
অভিবাসনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের মতে, একজন অভিবাসন প্রত্যাশীর সাধারণ অভিবাসন খরচের সঙ্গে রয়েছে অ্যাপ্লিকেশন ফি, ভিসা ফি, ওয়ার্ক পারমিট ফি, স্বাস্থ্য পরীক্ষা, বিদেশে বিপণন ও লিয়াজোঁ অফিস খরচ, প্রশিক্ষণ খরচ, বিমান ভাড়া, অগ্রিম আয়কর, প্রশিক্ষণ ও ভাষা পরীক্ষা, ওয়েজ আর্নার্স ওয়েলফেয়ার ফি, আনুষাঙ্গিক খরচ, তথ্য নিবন্ধন ফি, রিক্রুটিং এজেন্সির সার্ভিস চার্জ, ইন্স্যুরেন্স ফি, ইমিগ্রেশন ট্যাক্স এবং ভ্যাট। এই খরচের মধ্যে থাকলে কোনও সমস্যা নেই কিন্তু সমস্যার জায়গা অনির্ধারিত খরচগুলো (হিডেন কস্ট)। অভিবাসন প্রক্রিয়ায় সর্বমোট খরচের ৭৮ শতাংশই চলে যায় মধ্যসত্ত্বভোগী, অবৈধ মধ্যস্থতাকারী অথবা গমনেচ্ছু দেশের কিংবা নিজ দেশের সাব এজেন্টদের পকেটে।
অভিবাসন খরচ নিয়ন্ত্রণ করা একটি চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর মহাপরিচালক সেলিম রেজা। তিনি বলেন, অভিবাসন খরচ কমানোর জন্য আমরা চেষ্টা করছি। এক্ষেত্রে সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। তবে ইতোমধ্যে কিছু কিছু দেশে অভিবাসন খরচের বিষয়ে উন্নতি লাভ করেছে। যেমন জাপানে আমরা লোক পাঠাচ্ছি, তাদের কিন্তু অভিবাসন খরচ শূন্য। কোরিয়া, জর্ডানে কিন্তু খুবই অল্প অভিবাসন খরচে আমাদের শ্রমিকরা যাচ্ছে।
ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রধান শরিফুল হাসান মনে করেন মধ্যসত্ত্বভোগীদের নিয়ন্ত্রণ না করলে অভিবাসন খরচ কমানো সম্ভব হবে না। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, বাংলাদেশ থেকে বিদেশে যেতে যে অভিবাসন খরচ সেটা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। সরকার প্রত্যেকটা দেশের জন্য নির্ধারিত খরচ বেঁধে দিয়েছে। কিন্তু কাগজে কলমেই সেটা আছে। যারা বিদেশে লোক পাঠায় তারা অনেক সময়েই বহুগুণ বেশি টাকা নেন। এর কারণ, বিদেশে যেমন মধ্যসত্ত্বভোগী আছে, দেশেও তেমনি নানা স্তরে দালালদের দৌরাত্ম্য। ফলে আট থেকে দশ লাখ টাকাও লাগে বিদেশে যেতে। এছাড়া পদে পদে আছে ভোগান্তি-হয়রানি। পাসপোর্ট তৈরি থেকেই এর শুরু। এরপর রিক্রুটিং এজেন্সির দালাল ও প্রতারক এজেন্সি, চাকরির বিষয়ে অসত্য তথ্য, উচ্চমূল্যে ভিসা কেনাবেচা, স্বাস্থ্য পরীক্ষা, সরকারি ছাড়পত্র—সবক্ষেত্রে সীমাহীন যন্ত্রণা। দেশের আকাশ পার হলে শুরু হয় বিরূপ প্রকৃতি, অমানুষিক পরিশ্রম, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে জীবনযাপন, মালিকদের প্রতারণা, নির্যাতনসহ আরও কত কী।
তিনি আরও বলেন, আমাদের বিদেশ যাওয়ার প্রসেসটা এখনও দালাল নির্ভর। যার কারণে যাওয়ার খরচ সবচেয়ে বেশি এবং আয় সবচেয়ে কম। অভিবাসন খরচ কমানোর একটা বড় উপায় হল অভিবাসন প্রক্রিয়া ঠিক করা এবং দক্ষ শ্রমিক তৈরি করা।
অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রামের (ওকাপ) চেয়ারম্যান শাকিরুল ইসলাম বলেন, অভিবাসন খরচ শূন্যে নিয়ে আসতে হবে। কেননা কলম্বো প্রসেসের ঢাকা ডিক্লেয়ারেশন ২০১১ তে সরকার পুরোপুরি ভাবে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে অভিবাসন খরচ শূন্য করা হবে। অভিবাসন খরচ কমাতে সরকারকে সত্যিকারভাবে উদ্যোগ নিতে হবে। এখনও বলা হচ্ছে সরকারিভাবে নির্দিষ্ট আছে কিছু কিছু দেশে, কিন্তু সেটা কাগজে কলমেই আছে, বাস্তবে মিল নেই। তাই রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে জবাবদিহিতার ভেতর নিয়ে আসতে হবে এবং অভিবাসনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মধ্যসত্ত্বভোগী কিংবা সাব এজেন্টদের একটি আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। কারণ অভিবাসন খরচ বাড়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে মধ্যসত্ত্বভোগীরা নানাভাবে অতিরিক্ত টাকা নিচ্ছে।
রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) গবেষক এবং অভিবাসন বিশ্লেষক ড. জালাল উদ্দিন শিকদার মনে করেন, অভিবাসন খরচ শূন্য হওয়ার কথা। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, দালালদেরকে একটি কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। মার্কেট উন্মুক্ত থাকলে সুযোগের সদ্ব্যবহার করার অনেক মানুষ আছে এখানে। যার কারণে অভিবাসন খরচ বাড়ে। এখন যেই খরচ বাস্তবে আছে এটা কোনো ভাবেই যৌক্তিক নয়।

(দ্য রিপোর্ট/একেএমএম/ডিসেম্বর ১৮,২০১৮)