সাংবাদিক আর পর্যবেক্ষক ‘নিয়ন্ত্রণ'?
দ্য রিপোর্ট ডেস্ক : এবারের নির্বাচনে সাংবাদিক আর পর্যবেক্ষকদের জন্য নানা ধরনের নিয়ম-নীতি আরোপ করা হয়েছে৷ সাংবাদিকরা তাই নির্বাচনের খবর সংগ্রহ নিয়ে নানা ধরনের আশঙ্কায় আছেন৷ বিদেশি পর্যবেক্ষক শেষ পর্যন্ত কতজন আসেন তা-ও বলা যাচ্ছে না৷
ডয়চে ভেলের খবরে বলা হয়েছে, সাংবাদিকদের ওপর সর্বশেষ বিধিনিষেধ, যা নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে, তা হলো নির্বাচনের দিন মোটর বাইক ব্যবহার করা যাবে না৷ এই নির্দেশনা সাধারণভাবে দেয়া হলেও সবচেয়ে কেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন সাংবাদিকরা৷ কারণ, ফটো সাংবাদিক এবং ঢাকার বাইরের সাংবাদিকরা প্রধানত মোটর বাইকই ব্যবহার করেন সংবাদ সংগ্রহ এবং চলাচলের জন্য৷ এর বাইরে আগেই আরো কিছু নির্দেশনা জারি করা হয়৷ তার মধ্যে আছে ভোট কেন্দ্রে লাইভ না করা, একাধিক সাংবাদিক একসঙ্গে প্রবেশ না করা, প্রিজাইডিং কর্মকর্তার অনুমতি নিয়ে ভোট কেন্দ্রে প্রবেশ করা প্রভৃতি৷
সাংবাদিকদের নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে নির্বাচনের খবর সংগ্রহ করার জন্য যে প্রেস কার্ড দেয়া হয়, তাতেই জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে৷ এরমধ্যে যেসব শর্ত দেয়া হয়েছে তার মধ্যে একটি হলো অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড থাকতে হবে৷ কিন্তু বাংলাদেশে যাঁরা সচিবালয় বিট কাভার করেন, তাঁদেরই কেবল কার্ড দেয়া হয়৷ কুমিল্লার সাংবাদিক মাসুদ আলম বলেন, ‘‘ঢাকায় সাংবাদিকদের একাংশের অ্যাক্রিডিটেশন কাড আছে৷ কিন্তু আমরা যারা জেলা পর্যায়ে সাংবাদিকতা করি, তাদের এই কার্ড নেই, থাকার প্রয়োজনও নেই৷ তারপরও আমাদের এই কার্ড চাচ্ছে রিটার্নিং অফিসার৷ আমরা আবেদন করেছি নির্বাচন কমিশনের প্রেস কার্ডের জন্য, কিন্তু শেষ পর্যন্ত পাবো কিনা জানি না৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘অনলাইন নিউজপোর্টালের সাংবাদিকরা আরো বেশি ঝামেলার মুখে পড়ছেন৷ পরিচয়পত্র এবং অফিসের অ্যাসাইনমেন্ট লেটারও তাঁরা গ্রহণ করতে চাচ্ছেন না৷''
সাংবাদিকদের এই ধরনের বিধিনিষেধের আওতায় ফেলায় ক্ষুব্ধ সাংবাদিকরা৷ এরই মধ্যে রিপোর্টার্স ফোরাম ফর ইলেকশন অ্যান্ড ডেমোক্রেসি (আরএফইডি) নির্বাচন কমিশনে এইসব বিধিনিষেধ শিথিল করার জন্য লিখিত আবেদন জানিয়েছে৷ সংগঠনের সভাপতি সোমা ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা অতীতে অনেক নির্বাচন কাভার করেছি৷ এত বিধিনিষেধের আওতায় পড়ি আগে কখনো৷ আমরা সাংবাদিকরা কখনোই ভোটিং বুথে যাই না৷ কিন্তু পোলিং সেন্টার থেকে সব সময়ই লাইভ সম্প্রচার করেছি৷ কিন্তু এবার তা করা যাবে না৷ আবার ভোট গণনার সময়ই সাংবাদিকরা খবর সংগ্রহের জন্য থাকতে পারবেন না৷ এটা আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি৷ আবার পোলিং সেন্টারে একসঙ্গে একাধিক সাংবাদিক প্রবেশ করতে পারবেন না৷ প্রবেশ করতে প্রিজাইডিং কর্মকর্তার অনুমতি লাগবে৷''
তিনি বলেন, ‘‘এখন সমস্যা হচ্ছে, নির্বাচন কমিশনের এই নির্দেশনা মাঠ পর্যায়ে কিভাবে প্রতিফলিত হবে৷ দেখা যাবে সাংবাদিকরা পোলিং সেন্টারে ঢুকতেই পারছেন না৷ আর একাধিক সাংবাদিক যদি একসঙ্গে পোলিং সেন্টারে ঢুকতে না পারে তাহলে তো সাংবাকিদের লাইন হবে৷ আর কখন সাংবাদিক ঢুকবেন তা কে নির্ধারণ করবেন?''
পোলিং সেন্টারে ঢুকে ছবি তোলা যাবে৷ খবরও সংগ্রহ করা যাবে৷ কিন্তু সেটা এইসব নিয়মের কারণে কতটা সম্ভব হবে তা নিয়ে সংশয়ে আছেন সাংবাদিকরা৷ সোমা ইসলাম বলেন, ‘‘মোটর বাইক যদি সাংবাদিকরা ব্যবহার করতে না পারেন তাহলে তাঁদের জন্য সংবাদ সংগ্রহ কঠিন হয়ে পড়বে৷ এটা তো স্টিকার দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায়৷ আর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীসহ নির্বাচনের সঙ্গে জড়িত কমিশনের অনেকই তো মোটর বাইক ব্যবহার করবেন৷''
তিনি বলেন, ‘‘এইসব বিষয় নিয়ে আমরা নির্বাচন কমিশনে সমাধানের জন্য একটি আবেদন করেছি৷ কিন্তু ‘দেখছি' বলে কমিশন সময় পার করছে৷''
এদিকে বিদেশি ও দেশি পর্যবেক্ষ নিয়ে চলছে জটিলতা৷ এবারে পর্যবেক্ষকের সংখ্যা সবচেয়ে কম হতে পারে৷ ভিসা জটিলতার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নে পরিচালিত এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ফ্রি ইলেকশনস (অ্যানফ্রেল)-এর ৩২ জন পর্যবেক্ষক বাংলাদেশের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণে আসছেনা৷ অ্যানফ্রেল স্বচ্ছ নির্বাচনে সরকারের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে৷ তবে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এরইমধ্যে ১৬ জনকে ভিসা দেয়া হয়েছে৷ আর যুক্তরাষ্ট্রের বিবৃতিতে মর্মাহত হয়েছে বাংলাদেশ সরকার৷
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘‘সরকার এরইমধ্যে এ বিষয়ে ব্যখ্যা দিয়েছে৷ যুক্তরাষ্ট্রের পর্যবেক্ষকরা চাইলে অন অ্যারাইভাল ভিসায় আসতে পারেন৷ তাদের আসা উচিত৷ সমালোচনা করার চেয়ে আসার চেষ্টা করা ভালো৷''
তিনি বলেন, ‘‘সরকারেরও উচিত হবে পর্যবেক্ষরা যাতে সহজে আসতে পারেন তার ব্যাবস্থা করা, কারণ, এ বিষয় নিয়ে সমালোচনা আছে৷''
অধ্যাপক ইমতিয়াজ বলেন, ‘‘সাংবাদিকরা যাতে স্বাধীনভাবে সংবাদ সংগ্রহ করতে পারেন, তার ব্যবস্থা করা উচিত৷ নির্বাচন কমিশন হয়তো নিরাপত্তার দিক বিবেচনা করে অনেক বিধি-নিষেধ আরোপ করছে৷ কিন্তু তা যেন স্বাধীন সাংবাদিকতায় বাধা না হয়৷ মোটরবাইক স্টিকার দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায়৷''
এবারে দেশি-বিদেশি কোনো পর্যবেক্ষকই প্রকাশ্যে কোনো মন্তব্য করতে পারছেন না৷ তাঁরা নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করে কমিশনকে রিপোর্ট দেবেন৷ তাঁরা সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে পারবেন না বা কোনো সংবাদ মাধ্যমে মতামত দিতে পারবেন না৷''
ডিআরইউ'র উদ্বেগ:
নির্বাচনের খবর সংগ্রহে সাংবাদিকদের মোটর বাইক ব্যবহারে নির্বাচন কমিশনের নিষেধাজ্ঞায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ঢাকা রিপোর্টাস ইউনিটি (ডিআরইড)৷ সোমবার রাতে এক বিবৃতিতে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি কার্যনির্বাহী কমিটির পক্ষ থেকে সভাপতি ইলিয়াস হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক কবির আহমেদ খান এক বিবৃতিতে বলেন, এতে সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব বিঘ্নিত ও ব্যাহত হবে৷
নির্বাচন কমিশন এক নীতিমালায় বলেছে, আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সাংবাদিক ও পর্যবেক্ষকরা নির্বাচন কমিশনের অনুমোদিত এবং অনুমোদনসূচক স্টিকারযুক্ত যানবাহন ব্যবহার করতে পারবেন৷ তবে, মোটরসাইকেল ব্যবহারের জন্য কোনো স্টিকার ইস্যু করা হবে না৷
সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ বলেন, নির্বাচন কমিশনের এ সিদ্ধান্ত প্রথা ও রেওয়াজ বিরোধী৷ কারণ, অতীতের সব নির্বাচনে সাংবাদিকরা নির্বাচন কমিশনের সরবরাহ করা স্টিকার মোটর সাইকেলে লাগিয়ে তাঁদের নির্বাচনি দায়িত্ব পালন করেছেন৷
(দ্য রিপোর্ট/একেএমএম/ডিসেম্বর ২৫,২০১৮)