নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
বাংলা কবিতার শস্যভূমি তিনিই তৈরি করেছিলেন
সুবোধ সরকার
স্বাধীনতার পর নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী হলেন সেই কবি, যিনি গত ৭০ বছরে জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছেছিলেন। বিশেষ করে কবিতায় জনপ্রিয়তা বড় সোজা ব্যাপার নয়। যখন কবিতার কাছে মানুষ আসতে চাইতেন না, তখন তিনি একেবারে বাড়ির অন্দরমহল থেকে, বৈঠকখানা থেকে পাঠককে বের করে নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়েছিলেন। বহু মানুষকে তিনি কবিতা পড়িয়েছেন। ছোটবেলায় দেখেছি কৃষ্ণনগরে ঘরে ঘরে যেরকম রবীন্দ্রনাথের গান, ডি এল রায়ের গান গাওয়া হত, তেমনি কবিতার কথা উঠলে দেখতাম যে বড়রা নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কবিতা মুখস্থ করছেন। কেউ হয়তো বলছেন উলঙ্গ রাজা, কেউ হয়তো শুনিয়ে দিচ্ছেন কলকাতার যিশু।
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর সবচেয়ে বড় অবদান হল, তিনি বাংলা কবিতাকে প্রকৃত অর্থে, একেবারে নিজের মতো করে আধুনিক করে তুলেছিলেন। তিনি পরতেন ধুতি। কিন্তু যে কোনও জিনস–পরা যুবকের চেয়ে তিনি ছিলেন স্মার্ট। কথায়, চলনে, ভঙ্গিতে, বিন্যাসে, আলোচনায়, যে কোনও পরিস্থিতিতে তিনি ছিলেন কবিতার সম্রাট। কবিতাকে নিয়েই তিনি দেশ–বিদেশে বহু জায়গায় গেছেন, বাংলা কবিতাকে রাজদরবারে পৌঁছে দিয়েছেন। তা সে কলকাতার রাজভবন হোক, রাইটার্স বিল্ডিং হোক, নবান্ন হোক বা রাষ্ট্রপতি ভবন। তেমনি তাঁর কবিতা সাধারণ পাঠকের জন্য তিনি কাকদ্বীপ থেকে কোচবিহার ছড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি একইসঙ্গে যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরকে মুগ্ধ করতে পারতেন, তেমনি মুগ্ধ করতে পারতেন একজন সাধারণ পাঠককে। এ ঘটনা একজন কবির জীবনে বিরল সম্মান। গত ৭০ বছরে এই বিরল সম্মান আর কোনও কবি পেয়েছেন কি না আমার জানা নেই। নীরেনদা কোনও একজন পাঠককে বেছে নিয়ে তাঁর পাড়ায় ঢুকে পড়তেন, তারপর পাড়া থেকে বাড়িতে বাড়িতে। এই জিনিসটা বাংলা কবিতায় আগে ছিল না। তিনি একের পর এক দরজা খুলে দিয়ে গেছেন পরবর্তী সময়ের কবিদের জন্য। যাঁরা বলতেন বাংলা কবিতা দুর্বোধ্য, সেই তাঁরাও একে একে নীরেন্দ্রনাথের কবিতার কাছে এসে নতজানু হয়ে বসেছিলেন। বাংলা কবিতার জন্য এই শস্যভূমি তৈরি করে দেওয়ার কাজটা করেছিলেন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী।
পাশাপাশি তিনি বাংলাভাষা, ব্যাকরণ ও বানান নিয়ে শেষদিন পর্যন্ত ভাবতে পেরেছেন। এ বিষয়ে একাধিক বই লিখেছেন। বাংলা বানান নিয়ে ম্যানুয়াল তৈরি করেছেন। অভিধান তৈরি করেছেন। তাঁর আর এক অবদান হল ছন্দ। কবিতার ছন্দ নিয়ে তাঁর মতো জাদুকর গত ৭০ বছরে কমই এসেছেন। তিনি আমাকে একাধিকবার বলেছেন, ছন্দটা শিখে ভুলে যেতে হবে। ছন্দকে সরিয়ে দাও। কবিতাকে কবিতা হয়ে উঠতে দাও। তাঁর কবিতা–সমগ্রের ষষ্ঠ খণ্ড এবারের বইমেলায় প্রকাশিত হওয়ার কথা। নিজে অক্সিজেনের মাস্ক সরিয়ে ষষ্ঠ খণ্ডের সমস্ত কবিতার প্রুফ দেখে গেছেন। একেবারে শেষ দিন পর্যন্ত তাঁর কাজ ছিল পরিষ্কার। তাঁর এই জীবন, বিরাট কর্মকাণ্ড— বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির জন্য ইতিহাস হয়ে থাকবে। আমি এই ইতিহাসকে আরও একবার প্রণাম জানাই।
সুবোধ সরকার: পশ্চিমবঙ্গের একজন আধুনিক কবি। প্রথম কবিতার বই প্রকাশিত হয় সত্তরের দশকে। এপর্যন্ত কুড়িটি কবিতার বই লিখেছেন, জিতেছেন দুটি পুরস্কার, কবিতার জন্য দেশবিদেশ সফর করেছেন।
(দ্য রিপোর্ট/একেএমএম/ডিসেম্বর ২৬,২০১৮)