নীরেনদা
পবিত্র সরকার
নীরেনদার কবিতা আমি কখন প্রথম পড়ি মনে নেই, সম্ভবত সেটা স্কুলজীবনেই হবে, দেশভাগের বছরে এপারে চলে আসার পর, খড়্গপুরে। কবে হবে সেটা? ১৯৫০ কি? একটা পুরনো, নিউজপ্রিন্ট আর লাইনোটাইপে ছাপা ‘দেশ’ পত্রিকার সংখ্যা হাতে পড়েছিল, তার বাঁদিকের একটা পাতায়, কোনও একটা লেখা শেষ হওয়ার পর, পাদটীকার মতো একটা কবিতা ছাপা হয়েছিল, নাম সম্ভবত ‘উজ্জীবন’। তখন বাংলার সব পত্রিকাতেই কবিতা ওইভাবে ছাপা হত, পাদপূরণের মতো। ‘উজ্জীবন’–এর প্রথম কয়েকটা লাইন পড়ে হঠাৎ শরীরে একটা বিদ্যুৎপ্রবাহ খেলে গেল—
তুমি বলেছিলে ক্ষমা নেই, ক্ষমা নেই;
অথচ ক্ষমাই আছে।
সহিষ্ণু হাতে কে ঢালে জীবন শীতের শীর্ণ গাছে?
অন্তরে তার কোনো ক্ষোভ জমা নেই।
জানি না তারিখটা ঠিক বলতে পারছি কি না; হয়তো স্কুলের ক্লাস এইট–টেইটের ছাত্র তখন, এ কবিতার পুরো অর্থ বোঝবার অনুভবভিত্তিই তৈরি হয়নি। তবু এ ছত্রগুলি আমাকে যে ভয়ঙ্কর দুলিয়ে দিয়েছিল তা আমার এখনও মনে আছে এবং এখনও একইভাবে দোলায়। এখন আমার মনে হয়, তখন অস্পষ্টভাবে যা ভেবেছিলাম হয়তো— জীবন সম্বন্ধে এমন ইতিবাচক স্পষ্ট প্রত্যয়ের সুরে কথা বলতে পারেন যিনি, তিনি সামান্য কবি নন। তার পরে তাঁর প্রথম কবিতার বই সিগনেট প্রেস থেকে বেরল, ‘নীলনির্জন’, সম্ভবত ১৯৫৩ সালে। পরে পুরস্কার হিসাবে পাই সেই বই। এখনও তা আমার সঞ্চয়ে আছে। আরও পরে তাঁর কবিতার সংগ্রহ আমার অধিকারে এসেছে, ‘অন্য গোপাল’ বইটি আমার স্ত্রী আর আমাকে উৎসর্গও করেছেন পরম স্নেহে। তাঁর কবিতায় অন্য সমস্ত বাঙালির মতো আমিও আপ্লুত। আমার নিজের জীবনবোধ এইরকম সহজ ভালবাসা ও প্রত্যয় পোষণ করে গড়ে উঠেছে, আমার কাছে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর এক মরূদ্যানের মতো, আশ্রয়ের মতো।
কবির সঙ্গে আলাপ, বা প্রায় আলাপ তার আরও বছর ছয়েক পরে। আমি তখন বঙ্গবাসী কলেজের ছাত্র। যুব উৎসবে আমি একই সঙ্গে গল্প আর কবিতা দুই–ই জমা দিয়েছিলাম, প্রণবের প্ররোচনায়। মফস্সলের ছেলে, যথেষ্ট আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়নি, কাজেই প্ররোচনার দরকার ছিল। শুনলাম দুই–ই গেছে কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী কাছে বিচারের জন্য। কী সর্বনাশের কথা। যা–ই হোক, একদিন সেই বিচার এসে পৌঁছল। আমি চমৎকৃত হয়ে জানলাম নীরেনদা আমার কবিতাকে প্রথম করেছেন, গল্পকে দ্বিতীয়। শুধু তাই নয়, কবিতার পাশে সাদা জায়গায় লিখে দিয়েছেন ‘একটি পবিত্র, সুন্দর কবিতা’। বলা বাহুল্য, আমার নামের সুযোগে তিনি একটু স্নেহময় দুষ্টুমি করে নিয়েছেন। সেই প্রথম আমি আমার নামটার প্রতি কৃতজ্ঞ বোধ করলাম।
নীরেনদার সঙ্গে তার পরে মাঝেমধ্যে দেখা হয়েছে। তাঁর স্নেহবৃত্তের মধ্যেও ঢুকে গেছি। নানা অনুষ্ঠানে তাঁর গলায় আশ্চর্য আবৃত্তি শুনেছি, রবীন্দ্রনাথের কবিতার আর তাঁর নিজের কবিতার। তাঁর মুখে ‘ক্ষণিকা’–র নানা কবিতার আবৃত্তি শোনা এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা। পরে আমাদের বান্ধবীদের চোখ দিয়ে দেখেছি আর–এক নীরেন্দ্রনাথকে, ওই কালো, দীঘল চেহারার দারুণ সুন্দর এক পুরুষকে। ইংরেজিতে যে কথাটা শুনেছিলাম tall, dark and handsome, সে কথাটার মানে যে ঠিক কী তা নীরেনদাকে দেখে বুঝেছিলাম।
আমরা তখন শিকাগোতে। খবর পেয়েছি নীরেনদা এসেছেন মার্কিন সরকারের আমন্ত্রণে, শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া বিভাগে তিনি আসবেন। বিভাগে যেদিন এসেছিলেন, সেদিন কেন যেন পাশের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ থেকে আমি খবর পাইনি, ফলে ওখানে তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। কিন্তু সন্ধেবেলায় হঠাৎ বন্ধুবর জীবনানন্দ–গবেষক ক্লিন্ট সিলি জানাল, সে নীরেনদাকে নিয়ে আমার ডরচেস্টারের বাসায় আসছে।ন্টের সঙ্গেই নীরেনদাকে শিকাগো ছাড়ার দিন ও’হেয়ার এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিতে গিয়েছিলাম। নীরেনদাকে নিয়ে আমার চতুর্থ আখ্যান ১৯৭৫–এ দেশে ফেরবার পর। ইউরোপ বেড়িয়ে হাতে মাত্র ১৪৫ ডলার সঞ্চয়, আর পৌনে দু–বছরের একটি ফুটফুটে কন্যাসন্তান নিয়ে দেশে ফিরেছি। যাদবপুরের চাকরিটা এক সমবয়সি বন্ধু ও সহকর্মীর শুভেচ্ছায় চলে গেছে, ফলত সম্পূর্ণ বেকার।
হঠাৎ একদিন এসে পড়ল নীরেনদার একটি চিরকুট, তাতে স্পষ্ট হাতে এইরকম কয়েকটি ছত্র লেখা, ‘পবিত্র, তুই দেশে এসেছিস, আমার সঙ্গে একবার দেখা করিসনি? শিগগির একবার এসে দেখা কর, আমার কিছু কাজ করে দে!’ কে সেই খোলা চিঠিটা এনে আমাকে পৌঁছে দিয়েছিল অকৃতজ্ঞ আমার তা–ও এখন মনে নেই।
কিন্তু চিঠিটা পেয়ে আমি যেন বেঁচে গেলাম। পরের দিনই সম্ভবত নীরেনদার ঘরে আনন্দবাজার পত্রিকার অফিসে দেখা করতে গেলাম তাঁর সঙ্গে। তিনি তাঁর কক্ষসঙ্গী নিখিল সরকার বা শ্রীপান্থর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন, আলাপ করিয়ে দিলেন গৌরকিশোর ঘোষের সঙ্গে। পরে দুজনেই আমার দাদা হয়ে যান। এই সব কাজের পর একগাদা বই হাতে ধরিয়ে দিলেন, বললেন, ‘যাও, চট করে এগুলোর সমালোচনা লিখে আনো’। বলে দিলেন, কোন বইয়ের জন্য কত শব্দ বরাদ্দ।
ব্যস, আনন্দবাজারের সঙ্গে আমার প্রায় তিন দশকের সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেল। কী লিখিনি সে কাগজে? বইয়ের সমালোচনা, কলকাতার কড়চা, রবিবাসরীয় পাতায় ফিচার, নাট্য সমালোচনা, আর নীরেনদার ‘আনন্দমেলা’য় কমিক্সের অনুবাদ, মাধ্যমিকের বাংলায় কী করে নম্বর বাড়াতে হয়, অজস্র ছড়া, ভ্রমণ কাহিনী, এবং শেষে আমার বাংলা উচ্চারণ সম্বন্ধে ছোটদের জন্য লেখা ‘বাংলা বলো’–র প্রায় আড়াই বছরের ধারাবাহিক। তা আমার পরিচিতি বাড়িয়েছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই, আনন্দবাজারের মঞ্চটাই সে সুযোগ দেয়। কিন্তু তখন আমার সংসারযাপনেও প্রচুর সহায়তা হয়েছিল, সে কথা না বললে অকৃতজ্ঞতা হবে। রাজনৈতিক দূরত্ব সত্ত্বেও আনন্দবাজারের বন্ধুরা, এমনকী কর্তৃপক্ষ আমাকে নানা সঙ্কটে সাহায্য করেছেন, এ কথাও স্বীকার করা দরকার। বরং আমিই তাঁদের সমস্ত দায়িত্ব পালন করতে পারিনি। পরে সাগরদাও ‘দেশ’ পত্রিকায় আমাকে দিয়ে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ লিখিয়ে নেন। একমাত্র নীরেনদার সূত্রেই আমার জীবনে এই সংযোগগুলি তৈরি হয়েছিল।
তিনি নিজে খেতে ভালবাসেন, আর আমিও এককালে এ বিষয়ে তাঁর সুযোগ্য অনুজ ছিলাম। ফলে আমাদের একসঙ্গে খাওয়ার অধিবেশনগুলি অত্যন্ত আনন্দময় হয়ে উঠত। পরে বাংলা আকাদেমিতেও দেখেছি, নানা উপলক্ষে খাওয়ার আয়োজন হলে তিনি সযত্নে মেনুর পরিকল্পনা করতেন, দুপুরের খাওয়া হলে শুক্তো আর ভাজামুগের ডাল এবং ইলিশের দিনে ইলিশ তাঁর বাধ্যতামূলক সুপারিশ ছিল। বাংলা আকাদেমির সন্ধেবেলার অতিথি আপ্যায়নে তিনি পুঁটিরাম বা বলরামের সন্দেশ আনাতেন। তাঁর কাছে মারোয়াড়ি আর বাঙালি শিঙাড়ার তফাতের বিবরণ আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনেছি। শেষোক্ত খাদ্যবস্তুটিতে কতটা আলুর ঘ্যাঁট, তাতে কতটা আদা, শীতের দিনে ক’টুকরো ফুলকপি, এবং ক’খানা বাদাম ভেজে দিতে হবে, শিঙাড়ার কোণগুলি কতটা ফাঁকা রাখতে হবে যাতে শিঙাড়াটিকে ঝাঁকালে ঝুমঝুম শব্দ হয়, এবং কতটা গরম শিঙাড়া কামড়ে খেয়ে জিভ পুড়িয়ে ফেলতে হবে, এসব বিষয়ে তাঁর পুঙ্খানুপুঙ্খ নির্দেশ আছে।
নীরেনদার সঙ্গে পাশে বসে কাজ করবার সুযোগ পেলাম পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমিতে, ১৯৮৬–র পরে। ভাষা সম্বন্ধে নীরেনদার আগ্রহ বিষয়ে আগেই জানতাম, কিন্তু এর মধ্যে ‘বাংলা কী লিখবেন কেন লিখবেন’ বইটি লিখে তিনি আমাদের একেবারে চমৎকৃত করে দিয়েছেন। ফলে বাংলা আকাদেমি যখন তার প্রথম সভাপতি অন্নদাশঙ্কর রায়ের নির্দেশে নতুন বাংলা বানাননীতি প্রণয়নের কথা ভাবে, তখন নীরেনদার কথা আমাদের ভাবতেই হয়।
এবং এই সমিতিতে নীরেনদার পরামর্শ ছিল অমূল্য। যে আকাদেমি বানান অভিধান আমার প্রণয়ন করি তার প্রতিটি শব্দ নীরেনদা দেখে দেন, বিচার করে, কখনও বা তর্ক করে শব্দটির সঙ্গতি নির্মাণ করেন। বাংলা বানানের সমতাবিধানের যে কাজটি আকাদমি করেছে তা নীরেনদার সুবিবেচনা–প্রসূত সমর্থন ছাড়া সম্ভবই ছিল না। পরেও বানান অভিধানের প্রত্যেকটি সংস্করণ তিনি তন্নতন্ন করে পড়েছেন, শব্দ জুড়েছেন, ভুল ছাপা শুধরেছেন, আর আমরা এ ব্যাপারটা তাঁর হাতে ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত থেকেছি।
পরে তো নীরেনদা, ২০০৩–এ আকাদেমির সভাপতিই হয়ে এলেন, আগের সভাপতি অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রয়াণের পর। কিন্তু সভাপতি হয়েও অভিধান আর বানানের ব্যাপারে কেরানির শ্রমসাধ্য কাজ তিনি মোটেই ছাড়েননি। আকাদেমি ছাড়ার শেষদিন পর্যন্ত বানান–অভিধানের দায় তিনি বহন করেছেন। এ–ও এক আনন্দের কথা এই যে, তাঁর সময়েই আকাদেমির শারীরিক প্রসার ঘটে, সল্টলেকে জাপান টেগোর সোসাইটির আংশিক আনুকূল্যে রবীন্দ্র–ওকাকুরা ভবন তৈরি হয়। এই প্রকল্পে হোতা প্রয়াত অধ্যাপক কাজুও আজুমার সঙ্গে আকাদেমির প্রাথমিক যোগাযোগটি আমি ঘটিয়েছিলাম এটা আমার ব্যক্তিগত তৃপ্তির বিষয়, কিন্তু পরে শ্রীমান সনৎকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সুযোগ্য পরিলাচনায় এবং নীরেনদার নেতৃত্বে প্রকল্পটি চূড়ান্ত রূপ পায়।
নীরেনদা আর সৌমিত্র মিত্র আমাকে নিয়ে জুড়ে দেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রতিষ্ঠা করা ‘বুধসন্ধ্যা’র সঙ্গে। বুধসন্ধ্যায় অনেকের অভিনয়–প্রতিভার পরিচয় পেয়ে বিস্মিত হই। আমরা রবীন্দ্রনাথের ‘মুক্তধারা’ করেছিলাম, তাতে নীরেনদা সেজেছিলেন রাজা বিশ্বজিৎ। খুব সহজ স্বচ্ছন্দ ছিল তাঁর অভিনয়।
বাংলা আকাদেমির সভাপতির ঘরের টেবিলটার সামনে এসেই ‘ব’–এর ওপর খুব জোর দিয়ে ‘বোস্’ বা ‘বোসো’ বলে উঠতেন, তাড়াহুড়ো দেখলে বকুনি দিয়ে বলতেন, ‘কোথায় যাবি?’ নানারকমের কথাবার্তায় কোনখান দিয়ে সময় কেটে যেত টের পেতাম না। বাড়িতে ফেরার সময় পার হয়ে যেত, তবে নীরেনদার সঙ্গে গল্প করেছিলাম বললে সব সময়েই সেটা একটা গ্রহণযোগ্য অজুহাত হত।
নীরেনদার মতো এমন আস্ত মানুষ আমি বেশি দেখিনি। তাঁর সঙ্গ পেয়ে আমার জীবন বিশেষ পুষ্টি পেয়েছে।
ঋণ স্বীকার-কোরক পত্রিকার নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী সংখ্যা
ড. পবিত্র সরকার : পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক । জন্ম ১৯৩৭ সালের ২৮ মার্চ তৎকালীন পূর্ববঙ্গের ঢাকার ধামরাইয়ে। উচ্চতর শিক্ষা লাভ করেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৯০ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত ছিলেন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য।
(দ্য রিপোর্ট/একেএমএম/ডিসেম্বর ২৬,২০১৮)