নিখোঁজ মাস্টারমশাই
পাভেল চৌধুরী
আমাদের মাস্টারমশাই শ্রী কার্ত্তিক চন্দ্র ধর নিখোঁজ হয়ে গেলেন।
বাড়িতে আর যারা ছিল মনিন্দ্রনাথ দত্ত, অমর দত্ত, মধাব দত্ত, কালিপদ দত্ত খুন হলেন নৃশংসভাবে। কিন্তু সেই কাতারে মাস্টারমশাই পড়লেন না, শিক্ষক যে তিনি, মানুষ গড়ার কারিগর, তাঁর পাওনা ছিল আরও অধিক। তাঁকে তুলে নিয়ে যাওয়া হলো তারপর থেকে টিকিটাও আর খুঁজে পাওয়া গেল না।
১৯৭১ সালের ৩-৪ এপ্রিল হবে। সারা দেশ জুড়েই তখন এক ভয়ংকর অবস্থা। একদিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হামলা, লুটপাট অগ্নিসংযোগ, নির্বিচার হত্যা আর একদিকে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধান, প্রতিরোধ, পাল্টা আক্রমণ, নিজেদের সংগঠিত করে তোলার চেষ্টা’̶ এ রকম অবস্থাতেই পরিবার পরিজন বাইরে পাঠিয়ে বাড়িতে মাস্টার মশাই সবান্ধব অবস্থান করছিলেন পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করতে। অকস্মাৎ হানাদারবাহিনী ঘিরে ফেলে বাড়ি, তারপরই ঘটে এই নারকীয় কাণ্ড।
আমাদের মাস্টার মশাই ছিলেন অজাত শত্রু, নির্বিরোধ মানুষ। ভারি চেহারা, একটু পৃথুল ধরণের শরীর, তাঁর সার্বক্ষণিক পোশাক ছিল সাদা হাউয়াই সার্ট আর ধুতি। রাস্তার ধার দিয়ে তাঁকে হাঁটতে দেখা যেত, আত্মমগ্ন মানুষ, শিক্ষকতার বাইরে আর কিছু নিয়ে তিনি ভাবতেন এরকম মনে হত না। সর্বস্তরের মানুষের কাছেই তিনি ছিলেন সম্মান আর শ্রদ্ধারপাত্র।
এখন বিস্তৃত কংক্রিটের ছাউনি দেওয়া সেটাকে (যশোরে) বেজপাড়া পুঁজোমণ্ডপ বলা হয়, সেই সময় এটাকে পুঁজোর মাঠ বলা হত। একেবারে উন্মুক্ত ছিল জায়গাটা। দক্ষিণের সীমানা ঘেঁষে ছিল ছোটখাট পুঁজোমণ্ডপ। পুঁজোর মাঠে খুটো পুতে গরু বাঁধতো কেউ, বিকেলে ছোট ছেলেমেয়েরা খেলা করত।
১৯২৯ সালে হার্গোট কমিশনের প্রতিবেদনে প্রথম দেশের প্রাথমিক শিক্ষার করুণ চিত্র ধরা পড়ে। অত:পর ১৯৩০ সালে বঙ্গীয় প্রাথমিকশিক্ষা আইন পাশ হলে এই আইনের অধিনে প্রাথমিকস্কুলগুলো তত্ত্বাবধানের জন্য জেলাগুলোতে জেলা স্কুলবোর্ড গঠন করা হয়। জেলা স্কুলইন্সপেকটরদের একজন প্রাথমিক স্কুলগুলো নিয়মিত তত্ত্বাবধান করতেন এবং প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকদের বেতন দেওয়া হত সরকারি ট্রেজারি থেকে। যদিও এই বেতনের পরিমাণ ছিল এত কম যে সরকারি অফিসের পিওনরাও এর থেকে বেশি বেতন পেত।...
পুঁজোর মাঠের পূর্বে গয়ারাম সড়কের ধার ঘেষে দুটো বিশাল দেবদারু গাছ ছিল। সন্ধ্যায় বাদুরের জমায়েত হত সেখানে। পুঁজোর সময় দেবদারু গাছ দুটোর মাঝখানটা গেট হিসেবে ব্যবহার করা হত। এই পুঁজোর মাঠের দক্ষিণে বেজপাড়া মেইন রোডের অপর পারে ছিল মাস্টারমশাইয়ের পাঠশালা। কাগজে কলমে যদিও প্রতিষ্ঠানটার নাম ছিল বেজপাড়া প্রাইমারি স্কুল, যশোর (BECHPARA PRIMARY SCHOOL, JESSORE) কিন্তু ‘পাঠশালা’ নামেই প্রতিষ্ঠানটির পরিচিতি ছিল এলাকার মানুষের কাছে। যতদূর মনে পড়ে গোলপাতার ছাউনির মাটির বারান্দায় চলত পাঠশালার কাজ। দেওয়ালে ঝোলান থাকতো ব্লাকবোর্ড, একটা চেয়ার থাকতো আর চেয়ারের সামনে কয়েকটা বেঞ্চ। এই ছিল পাঠশালার সরঞ্জাম। চেয়ারের উপর এক পা তুলে মাস্টার মশাই বসতেন, হাতে থাকতো পাঠদানের অনুষঙ্গ হিসেবে ছোট একটা বেত। পাঠশালা সংলগ্ন ১নং নিউ বেজপাড়া রোডের বাড়িটি ছিল মাস্টার মশাইয়ের। সেটাও গোলপাতায় ছাওয়া, চটা দিয়ে ঘেরা উঠোন। উঠোনে তুলসীতলা, কয়েকটা ফুলগাছ, চটার ফাঁক দিয়ে চোখে পড়ত। বাড়িটা সবসময়ের জন্যই ছিল এত নীরব যে বাইরে থেকে মানুষের অস্তিত্বই টের পাওয়া যেত না।
সন্ধ্যা হতেই কেমন নিঝুম হয়ে পড়ত নিউ বেজপাড়া রোডের এই এলাকাটা। লোক চলাচল কমে যেত। ঘটাং ঘটাং শব্দের কদাচিৎ দু-চারটে রিকসা যেত হোরিংবোরিং রাস্তা দিয়ে। কাঠের ল্যাম্প পোস্টগুলোতে কম তেজের বৈদ্যুতিক আলো জ্বলে উঠত আর সব বাড়িতেই যে বৈদ্যুতিক আলো জ্বলত এমন না, হারিকেনের প্রচলনও তখন বেশ ছিল।
মাস্টারমশাইয়ের বাড়ি থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুর ভেসে আসত। সঙ্গীতের চর্চা হত সেখানে।
সকাল থেকে শুরু হত পাঠশালা। মাস্টারমশাই উচ্চস্বরে বলতেন বর্ণমালা কিংবা নামতা, শিক্ষার্থীরাও সমস্বরে অনুস্মরণ করত তাঁকে। বেজপাড়া মেইন রোড দিয়ে যারা যাতায়াত করত তাঁদের কাছে এ দৃশ্য ছিল খুবই নৈমিক্তিক।
মাস্টারমশাইয়ের বাবা শ্রী সুরেশ কুমার ধর ছিলেন অবিভক্ত ভারতের বেনারসে রেলওয়ের স্টেশনমাস্টার। এক সময় ঐ অঞ্চলে গুটি বসন্তের মহামারি দেখা দেয়। তখন মহামারি থেকে বাঁচার একমাত্র পথ ছিল এলাকা ত্যাগ। তিনি চাকরি ছেড়ে বাড়ি চলে এলেন। তারপর স্কুল পরিদর্শক যশোরের ঘোপ নিবাসী বন্ধু সহিদুল ইসলামের পরামর্শে ১৯৩০ সালে এই প্রতিষ্ঠানের গোড়া পত্তন করেন।
উল্লেখ্য, ১৯২৯ সালে হার্গোট কমিশনের প্রতিবেদনে প্রথম দেশের প্রাথমিক শিক্ষার করুণ চিত্র ধরা পড়ে। অত:পর ১৯৩০ সালে বঙ্গীয় প্রাথমিকশিক্ষা আইন পাশ হলে এই আইনের অধিনে প্রাথমিকস্কুলগুলো তত্ত্বাবধানের জন্য জেলাগুলোতে জেলা স্কুলবোর্ড গঠন করা হয়। জেলা স্কুলইন্সপেকটরদের একজন প্রাথমিক স্কুলগুলো নিয়মিত তত্ত্বাবধান করতেন এবং প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকদের বেতন দেওয়া হত সরকারি ট্রেজারি থেকে। যদিও এই বেতনের পরিমাণ ছিল এত কম যে সরকারি অফিসের পিওনরাও এর থেকে বেশি বেতন পেত। বরাবরই আমাদের দেশে প্রাথমিক শিক্ষার ব্যাপারে রাষ্ট্র ছিল উদাসীন আর শুধু রাষ্ট্র না, সমাজের উচ্চ শ্রেণির মনযোগও এদিকে তেমন ছিল না। যে কারণে দেখা যায় দেশের সমাজপতি জমিদারশ্রেণি তাঁদের বাবা মা প্রমুখের নামে মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করেছে ঠিকই; কিন্তু প্রাথমিক বিদ্যালয় কেই প্রতিষ্ঠা করেছে এরকম নজির পাওয়া যায় না। যদিও প্রাথমিক শিক্ষাকে একেবারে উপেক্ষা করারও উপায় ছিল না। ১৯৫৭ সালে জেলাস্কুল বোর্ড বিলুপ্ত করা হল এবং প্রাথমিক শিক্ষা তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব পুরোটাই নিল সরকার। স্কুলগুলো কিন্তু যাথারীতি বেসরকারি থেকে গেল। তারপরও এক হিসেবে দেখা যাচ্ছে ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের সময় যেখানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল ২৯৬৩৩, সেখানে ১৯৭০ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা কমে এস দাড়াচ্ছে ২৯০২৯ টা।
১৯৫৭ সালে প্রায় ৮০ বছর বয়সে শ্রী সুরেশ কুমার ধর মৃত্যু বরণ করেন। মৃত্যুর কিছুদিন আগে থেকে তিনি শয্যাশায়ী ছিলেন। শোনা যায়, শয্যাশায়ী অবস্থাতেও তিনি শিক্ষাকতার কাজ যথারীতি অব্যাহত রেখেছিলেন। বাবার মৃত্যুর পর আমাদের মাস্টারমশাই শ্রী কার্ত্তিক চন্দ্রধর পাঠশালার হাল ধরেন। ১৯৭১ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি অন্ত:প্রাণ শিক্ষার কাজ চালিয়ে গিয়েছেন।
আজ এতকাল পরে মাস্টার মশাইয়ের কথার সূত্র ধরে মনে প্রশ্ন জাগে আমাদের রাষ্ট্রের গোড়া কি যথেষ্ট মজবুত হয়েছে? স্বাধীনতার ৪৮ বছর পরও যে দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই যথেষ্ট সুসংহত হতে পারলো না সে দেশ সম্পর্কে এ প্রশ্ন হয়তো অবান্তরই মনে হবে।...
আমাদের মাস্টারমশাইয়ের পাঠশালা ঠিক কোন পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল জানা যায় না। তবে তিনি নিয়মিত সরকারি মাসোহারা পেতেন। অন্য বিদ্যালয়ে বা উচ্চতর বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে গেলে এই পাঠশালার ছাত্রদের ছাড়পত্র নিতে হত। দেখা যাচ্ছে সদ্য প্রয়াত অধ্যাপক সমির কুমার হালদার ০২/০১/১৯৫৮ তারিখে এই পাঠশালা থেকে ফাইভ পাশের ছাড়পত্র নিয়েছেন। একইভাবে মাস্টারমশাইয়ের নিজের ছেলে এবং মেয়ে যাথাক্রমে বীর মুক্তিযোদ্ধা স্বনামধন্য রাজনীতিবিদ প্রণব কুমার ধর ২৮/১০/১৯৫৯ তারিখে ক্লাস থ্রি পাসের ছাড়পত্র নিয়েছেন এবং জয়ন্তি রাণী ধর, এক সময়ের প্রতিশ্রুতিশীল রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী, ২৩/০৪/১৯৬৩ তারিখে নিয়েছেন ক্লাস ওয়ান পাসের ছাড়পত্র। বেজপাড়া নিবাসী প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী মরহুম আলতাফ হোসেন চৌধুরীর ছেলে সর্ব মহলে বিশেষ পরিচিত আশরাফ উদ্দিন চৌধুরী (নথি অনুযায়ী) ও এই পাঠশালা থেকে ০১/০৮/১৯৬১ সালে ফাইভ পাসের ছাড়পত্র নিয়েছেন বলে সাক্ষ্য রয়েছে। এরকম আরও অনেকের নাম দেখা যায় এই পাঠশালায় যাদের প্রাথমিক শিক্ষার সূচনা হয়েছিল এবং পরবর্তীতে সমাজের নানা ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সবমিলিয়ে একথা অনস্বীকার্য যে আসলে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বেজপাড়ার অধিবাসীদের জন্য শিক্ষা অর্জনের প্রাথমিক লগ্নে এই ‘পাঠশালা’ বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছিল।
বেজপাড়ার স্থায়ী অধিবাসী হওয়া সত্ত্বেও আমি কিন্তু এই পাঠশালার ছাত্র ছিলাম না। মাস্টার মশাই আমাদের বাড়িতে এসে প্রাইভেট পড়াতেন। আমি তখন ক্লাস টু কি থ্রিতে পড়ি। আমার ছোটভাই শুভ’র হাতেখড়ি হয়েছিল মাস্টারমশাইয়ের হাতে। নিউ বেজপাড়া রোডে আমাদের বাড়িতে মাস্টারমশাই আসতেন দুপুরের একটু পরে। লেখাপড়ার জন্য সময়টা প্রীতিকর ছিল না। বিকেলে খেলার টান ছিল, খেলার সঙ্গীদের ইশারা ইঙ্গিত ছিল নানা রকম, তারপরও বাড়ির বাইরের বারান্দায় এক পাশে পাটি বিছিয়ে আমরা পড়তে বসতাম। একটা কথা মাস্টারমশাই প্রায় আপ্ত বাক্যের মত বলতেন; - লেখাপড়ার বেলায় সবার আগে গোড়া পাকা হওয়া দরকার। গোড়া যদি না পাকে তাহলে আসলে কিছুই হবে না।
আড়ালে শুভ মস্টারমশাইয়ের নাম দিয়েছিল ‘গোড়া পাকা মাস্টার’।
আজ এতকাল পরে মাস্টার মশাইয়ের কথার সূত্র ধরে মনে প্রশ্ন জাগে আমাদের রাষ্ট্রের গোড়া কি যথেষ্ট মজবুত হয়েছে? স্বাধীনতার ৪৮ বছর পরও যে দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই যথেষ্ট সুসংহত হতে পারলো না সে দেশ সম্পর্কে এ প্রশ্ন হয়তো অবান্তরই মনে হবে।
বলা বাহুল্য, আমাদের মাস্টারমশাইয়ের মত অসংখ্য মানুষের জীবন আর রক্তের উপর এ রাষ্ট্রের ভীত রচিত হয়েছে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক
(দ্য রিপোর্ট/একেএমএম/ডিসেম্বর ২৮,২০১৮)