ইসির মানদণ্ডে সুষ্ঠু নির্বাচন!
গোলাম মোর্তোজা
তফসিল ঘোষণার পরে হবে, হলো না৷ সেনাবাহিনী নামলে হবে, তা-ও হলো না৷ ‘লেভেল প্লেইং ফিল্ড' বা ‘সমান সুযোগ' কথার কথা ছাড়া, এর আর কোনো তাৎপর্য দৃশ্যমান হলো না৷
একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন ছিল সবার প্রত্যাশা৷ তা অনেকটাই হয়েছে৷ সব রাজনৈতিক দল অংশ নিয়েছে৷ সেই অর্থে নির্বাচনটি অংশগ্রহণমূলক ছিল৷ নির্বাচনে জনগণের অংশগ্রহণ থাকবে কিনা,ভোটার তার নিজের ভোট নিজে দিতে পারবেন কিনা, তা নিয়ে সংশয়-সন্দেহ ছিল৷ সেটা যে এতটা কার্যকরভাবে দৃশ্যমান হবে,অনুধাবন করা যায়নি৷
নির্বাচনটি পরিপূর্ণ অংশগ্রহণমূলক দূরে থাক, লক্ষ লক্ষ ভোটে বাক্স ভরেছে, কিন্তু ভোটারকে ভোট দিতে হয়নি৷ বাংলাদেশে নির্বাচনের এ এক নতুন বাস্তবতা৷ যে বাস্তবতায় সরাসরি বলে দেওয়া মুশকিল যে, সন্ত্রাস করে কেন্দ্র দখল করা হয়েছে বা কারচুপি হয়েছে৷ তাহলে কী ঘটল নির্বাচনে?
সে বিষয়ে দু-একটি কথা৷
১. খুলনা, গাজীপুর এমন কী বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনকে বর্তমান নির্বাচন কমিশন বলেছিল ‘চমৎকার' নির্বাচন৷ বরিশাল সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে নজিরবিহীন নৈরাজ্য দৃশ্যমান হয়েছিল সকাল এগারোটার মধ্যে৷ দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাচন কমিশনার নির্বাচন বাতিল করে দিতে চেয়েছিলেন৷ অন্য কমিশনাররা আলোচনা করে একমতও হয়েছিলেন৷ বাতিল করা হয়নি এই যুক্তিতে যে, নির্বাচনি কার্যক্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা বড়ভাবে বিঘ্নিত হতে পারে৷ তাঁদের প্রাণহানির আশঙ্কাও করা হয়েছিল৷ দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাচন কমিশনার তাঁর রিপোর্টে বিষয়টি বিস্তারিত লিখেছেন৷ প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে দেওয়া সেই রিপোর্ট প্রকাশ বা পর্যালাচনা করা হয়নি৷ ভোট গ্রহণের সময় শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের সচিব বলেছিলেন ‘নির্বাচন সুষ্ঠু' হয়েছে৷
বর্তমান নির্বাচন কমিশন ‘সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য অংশগ্রহণমূলক' নির্বাচনের একটি নিজস্ব ‘মানদণ্ড' তৈরি করেছে৷ সেই মানদণ্ড থেকে যে তারা বেরিয়ে আসবে না বা আসতে চায় না, তা গণমাধ্যম ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রত্যাশা করা ভোটাররা বিবেচনায় নেননি বা নিতে চাননি৷ তারা হয়ত ধরে নিয়েছেন ‘আগে যা-ই হয়ে থাকুক না কেন, এবার ঠিক হবে'৷
২. ঠিক হয়েছে কি হয়নি বা কতটা হয়েছে, সে বিষয়ে মন্তব্য না করে দু-একটি তথ্য উল্লেখ করলে বিষয়টি কিছুটা পরিষ্কার হতে পারে৷ গণমাধ্যমে সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছে৷
খুলনা ১ আসনের মোট ভোটার ২,৫৯,৪২০ জন৷ নৌকা প্রতীক ভোট পেয়েছে ২,৫৩,৬৬৯, ধানের শীষ পেয়েছে ২৮,১৭০৷
নৌকা আর ধানের শীষের ভোট যোগ করলে হয় ২,৮১,১৭০, যা মোট ভোটারের চেয়ে ২২,৪১৯ ভোট বেশি৷
ভোটারের চেয়ে বেশি ভোট,কী করে সম্ভব? কাজটি কীভাবে হলো? কারা ভোট দিলেন? যত ভোটার তার চেয়ে একটি ব্যালট পেপারও বেশি হওয়ার কোনো সুযোগ নেই৷ তাহলে বেশি ব্যালট পেপার কোথা থেকে এলো? এর ব্যাখ্যা কী? যদিও পরে এই ভুলটি সংশোধন করা হয়েছে, তারপরও এই ‘ভুলের' আসলে কোনো ব্যাখ্যা হতে পারে না৷
জনশ্রুতি ছড়িয়ে পড়েছে যে, ভোটের আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভরে রাখা হয়েছিল৷ জনশ্রুতি নিয়ে যখন তর্ক-বিতর্ক চলছিল, তখন বিবিসি বাংলা একটি প্রমাণ হাজির করলো৷ ভিডিও চিত্রে দেখা গেল, ভোট গ্রহণ শুরুর আগেই ব্যালট বাক্সের অর্ধেক ভরা৷
বলা হতে পারে, এমন তো ঘটেছে দু-একটি জায়গায়৷ সামগ্রিক চিত্রের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই৷ এই যুক্তির পাল্টা যুক্তি দিতে চাই না৷ তবে পাঠক তাঁর মতো করে যুক্তি নিশ্চয় তৈরি করে নিতে পারবেন৷
৩. নির্বাচন কমিশন কোনো প্রকার রাখ-ঢাকের ধার ধারেনি৷ জনগণ বা গণমাধ্যমের দেখার চোখ আর নির্বাচন কমিশনের দেখার চোখ সম্পূর্ণ আলাদা৷ গ্রেপ্তার-হামলা-মামলার স্থির বা ভিডিও চিত্রের কোনো কিছুই নির্বাচন কমিশনের শক্তিশালী রঙিন চমশায় দেখা যায়নি৷ প্রধান নির্বাচন কমিশনার এক কথার মানুষ৷ শুরু থেকেই যা বলে এসেছিলেন ‘‘সমান সুযোগ তৈরি হয়েছে'' নির্বাচনের পর বলেছেন, ‘‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে৷'' ‘‘কোথাও কোনো সমস্যা ছিল না'', ‘‘তৈরি হয়েছিল উৎসবের পরিবেশ''৷ একজন নির্বাচন কমিশনার সাদা চোখে দেখে তাঁর মত প্রকাশ করেছেন৷ প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছিলেন ‘‘এই বক্তব্য অসত্য''৷
নির্বাচনের আগে সাংবাদিকদের পেটানো হয়েছে, গাড়ি- ক্যামেরা ভাংচুর করা হয়েছে৷ সংবাদপত্র ও টেলিভিশনে সেই দৃশ্য দেখানো হয়েছে৷ নির্বাচন কমিশনের রঙিন চশমায় এসবের কিছুই ধরা পড়নি, দেখা যায়নি৷ নির্বাচনের দিনও সাংবাদিকরা নাজেহাল হয়েছেন৷ নির্বাচন কমিশন এসবের কিছুই দেখেননি৷
৪. এই দেখাদেখির বিষয়টির ইতি টানার উদ্যোগ নিয়েছিল নির্বাচন কমিশন৷ তাদের চোখে যা ‘সুষ্ঠু-চমৎকার' নির্বাচন, দেশের মানুষকেও তেমনটাই দেখাতে চেয়েছে নির্বাচন কমিশন৷
গোলাম মোর্তোজা, সাংবাদিক
নির্বাচন কমিশন যা দেখাতে চান না তেমন দৃশ্য যদি ধারণ করে ফেলেন সাংবাদিকরা, সে বিষয়ে অত্যন্ত সচেতন নির্বাচন কমিশন৷ নির্বাচনের আগের রাত থেকে মোবাইল ইন্টারনেট পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল৷ স্থির বা ভিডিও চিত্র ক্যামেরায় ধারণ করলেও, তাৎক্ষণিকভাবে তা পাঠানো যেন না যায়৷ কথা ছিল, ভোট গ্রহণ শেষ হওয়ার পর মোবাইল ইন্টারনেট আবার চালু হবে৷ হয়েছিল, কিন্তু পরে আবার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে৷
বিদেশি পর্যবেক্ষকদের সহায়তা না করে নানাবিধ প্রতিবন্ধকতায় সায় দিয়েছে নির্বাচন কমিশন৷ ভিসা জটিলতায় তারা আসতে পারেননি৷ যদিও ষাট জনের মতো বিদেশি গণমাধ্যম কর্মী এসেছেন৷ তাঁদেরও মোবাইলে ইন্টারনেটের সংযোগ না থাকায় জটিলতায় পড়তে হয়েছে৷
নির্বাচনের দিন যান চলাচল বন্ধ ছিল৷ ফলে কলাবাগান এলাকার ভোটার, যিনি এখন হয়ত বাসা বদল করে উত্তরায় চলে গেছেন, তাঁর পক্ষে কলাবাগান এলাকায় এসে ভোট দেওয়া সম্ভব হয়নি৷
৫. সব নির্বাচনে দেখা গেছে ভোটদানে মানুষকে উৎসাহিত করার নানাবিধ উদ্যেগ নেয় নির্বাচন কমিশন৷ এবার তার সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র৷ মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ করে দিয়ে নির্বাচন কমিশন যুক্তি দেখিয়েছে, সব সঠিক ঘটনার মাঝে একটি ভুল সংবাদ সমস্যা তৈরি করতে পারে, যা যুক্তি হিসেবে অত্যন্ত দুর্বল৷
সত্য দেখব না, শুনব না, শুধু বলব ‘সব ঠিক' ‘চমৎকার' ‘সুষ্ঠু'– কোনো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের নীতি এমন হলে, নির্বাচন যেমন হওয়ার তেমনই হয়েছে৷
সূত্র: ডয়চে ভেলে
(দ্য রিপোর্ট/একেএমএম/ডিসেম্বর ৩১,২০১৮)