দিরিপোর্ট২৪ ডেস্ক : প্রখ্যাত পরিসংখ্যানবিদ, বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক, দাবাড়ু ও শিক্ষাবিদ কাজী মোতাহার হোসেন ১৯৮১ সালের ৯ নভেম্বর ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।

তৎকালীন নদীয়া জেলার ভালুকা (বর্তমান কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী) থানার লক্ষ্মীপুর গ্রামে ১৮৯৭ সালের ৩০ জুলাই নানার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন কাজী মোতাহার হোসেন। কাজী গওহরউদ্দীন আহমদ এবং তসিরুন্নেসার চার ছেলে ও চার মেয়ের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। তার বাবার বাড়ি ছিলো ফরিদপুরের বাগমারা।

শিক্ষা জীবনের বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মেধাবী কাজী মোতাহার হোসেন ‍বৃত্তি লাভ করেছিলেন। লক্ষ্মীপুরের কাছে যদুবয়রা নিম্ন প্রাইমারি স্কুল দিয়ে আনুষ্ঠানিক পড়াশোরা শুরু। ১৯১৫ সালে কুষ্টিয়া উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় পূর্ববঙ্গ ও আসামের ভেতরে প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করেন। ১৯১৭ সালে রাজশাহী কলেজের বিজ্ঞান শাখা থেকে থম বিভাগে চতুর্দশ স্থান অধিকার করে আইএসসি পাস করেন।

১৯১৯ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ঢাকা কলেজ থেকে পদার্থবিজ্ঞানে অনার্স পরীক্ষায় দ্বিতীয় শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। ১৯২১ সালে তিনি ঢাকা কলেজ থেকে পদার্থবিজ্ঞানে দ্বিতীয় শ্রেণীতে প্রথম স্থান অর্জন করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থাকাকালে কলকাতার ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউট হতে ১৯৩৮ সালে ডিপ্লোমা অর্জন করেন কাজী মোতাহার হোসেন। পরের বছর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন।

১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ডিজাইন অব এক্সপেরিমেন্টস বিষয়ে ব্যালেন্সড ইনকমপ্লিট ব্লক ডিজাইন শিরোনামের গবেষণা-অভিসন্দর্ভ রচনা করে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তত্ত্বাবধায়কের সাহায্য ছাড়াই অভিসন্দর্ভ রচনা করেন তিনি। কাজী মোতাহার হোসেন উদ্ভাবিত এই পদ্ধতি ‘হোসেন’স চেইন রুল’ নামে পরিচিত।বাংলা পরিভাষা সৃষ্টির ক্ষেত্রেও তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। পরিসংখ্যানে বাংলা পরিভাষা হিসেবে তার ব্যবহৃত অনেক শব্দ এখনো ব্যবহৃত হয়।

১৯১৯ সালে দৌলতপুরের মোহসীন স্কুলে স্বল্পকালীন শিক্ষকতা করেন। ১৯২১ সালে এমএ শেষ পর্বের ছাত্র থাকতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে ডেমোনস্ট্রেটর এবং ফলাফল প্রকাশের পর একই বিভাগের লেকচারার নিযুক্ত হন। এছাড়া কৃষি বিভাগ, গণিত ও পরিসংখ্যান বিভাগ, পৃথক পরিসংখ্যান বিভাগে শিক্ষকতা করেন। ১৯৬১ সালে নিয়মিত অধ্যাপকের পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের 'প্রফেসর ইমেরিটাস' পদে নিযুক্ত। এছাড়া ডিন, আবাসিক শিক্ষক, প্রাধ্যক্ষ ও সহকারী প্রক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন। ১৯৫৩ সালে গ্রীষ্মের ছুটিতে ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটে ভিজিটিং প্রফেসরের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৩ সালে কলেজ অব মিউজিকে শিক্ষকতা করেন। ১৯৬৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যান গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক নিযুক্ত হন।

তার লেখালেখির হাতেখড়ি 'সওগাত' পত্রিকায়। এখানে প্রকাশিত হয় তার প্রথম রচনা 'গ্যালিলিও'। ১৯২৬ সালের ১৯ জানুয়ারি কাজী আবদুল ওদুদ, আবুল হুসেন এবং কাজী মোতাহার হোসেন মিলে ঢাকায় গঠন করেন 'মুসলিম সাহিত্য সমাজ'। এই সংগঠনের বার্ষিক মুখপত্র 'শিখা'র দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষ-সংখ্যা সম্পাদনা করেন তিনি। ১৯৩৭ সালে প্রকাশিত তার প্রথম মৌলিক প্রবন্ধসংকলন 'সঞ্চরণ' প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাকে সাধুবাদ জানিয়ে চিঠি লিখেন।

১৯৬১ সালে রবীন্দ্র-জন্মশতবার্ষিকী পালনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ১৯৬৭ সালে বেতার ও টেলিভিশনে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচার নিষিদ্ধ করার সরকারি সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানান। পাকিস্তান সাহিত্য সংসদের সভাপতি হিসেবে তিনিই প্রথম বাংলা নববর্ষ উপলক্ষ্যে পহেলা বৈশাখকে সরকারি ছুটির দিন ঘোষণার দাবি জানিয়ে ১৯৫৪ সালের এপ্রিল মাসে সংবাদপত্রে বিবৃতি প্রদান করেন।

প্রাঞ্জল ও বলিষ্ঠ গদ্য রচয়িতা হিসেবে পরিচিত। তার মৌলিক রচনার মধ্যে রয়েছে নজরুল কাব্যপরিচিতি (১৯৫৫), সেই পথ লক্ষ্য করে (১৯৫১), নির্বাচিত প্রবন্ধ ১ম খণ্ড (১৯৭৬)। অনুবাদগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে প্লেটোর সিম্পোজিয়াম (১৯৬৫)। পাঠ্য বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো Intermediate Geometry (১৯৪৯), Beginner's Translation, আধুনিক ভূগোল (২য় ভাগ: সুরেশচন্দ্র চৌধুরীর সহযোগে; ১৯৫০), সাহিত্যবিকাশ (১ম ভাগ; ১৯৫০), জ্যামিতি প্রবেশ (১৯৫১), প্রবেশিকা বাংলা ব্যাকরণ (১৯৫২), ইসলামের ইতিহাস (১৯৫২), পাকিস্তান ও পৃথিবী (সুরেশচন্দ্র চৌধুরীর সঙ্গে যৌথভাবে; ১৯৫৩), Elements of Statistics (১৯৫৫), সাহিত্যিকা (১ম ভাগ: অধ্যাপক অজিতকুমার গুহ-র সঙ্গে যৌথভাবে; ১৯৫৭), তথ্যগণিত (১৯৬৯), গণিতশাস্ত্রের ইতিহাস (১৯৭০) ও আলোকবিজ্ঞান (১ম খণ্ড; ১৯৭৫)। 'নবাব স্যার সলিমুল্লাহ' (১৯৮০) তাঁর রচিত একটি জীবনী পুস্তিকা। এছাড়া অপ্রকাশিত অবস্থায় রয়েছে অনেক বই।

তিনি ছিলেন উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দাবাড়ু। তিনি ১৯২৫ সালে 'অল ইন্ডিয়া চেস্ ব্রিলিয়্যান্সি' প্রতিযোগিতায় মোট ১০৩ নম্বরের মধ্যে ১০১ নম্বর পেয়ে প্রথম স্থান অধিকার করেন। তিনি ১৯২১ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত একটানা চল্লিশ বছর অবিভক্ত বাংলা এবং পূর্ব পাকিস্তানে দাবা চ্যাম্পিয়ন ছিলেন। 'বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশন'-এর প্রতিষ্ঠাতা এবং আজীবন সভাপতি ছিলেন তিনি। তার দাবাখেলার সঙ্গীদের মধ্যে ছিলেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কাজী নজরুল ইসলাম, সতীশচন্দ্র আড্ডী, কিষাণলাল প্রমুখ। তিনি ১৯৫১ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত লন্ টেনিস প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হন। ১৯১৭-১৮ সালে তিনি বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞ ওস্তাদ হেকিম মোহাম্মদ হোসেন সাহেবের কাছে দুই বছর রাগসংগীত তথা টপ্পা, ঠুমরি ও খেয়াল শেখেন এবং বছর তিনেক সেতারের তালিম গ্রহণ করেন।

কাজী মোতাহার হোসেন অনেক পুরষ্কার ও সম্মাননা লাভ করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সিতারা-ই-ইমতিয়াজ (১৯৬১), বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরষ্কার (১৯৬৭)। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে সম্মানসূচক 'ডক্টর অব সায়েন্স' বা ডিএসসি (১৯৭৪), জাতীয় অধ্যাপক (১৯৭৫)ও স্বাধীনতা পুরস্কার (১৯৭৯)।

কাজী মোতাহার হোসেন ১৯২০ সালের ১০ অক্টোবর সাজেদা খাতুনের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। সংস্কৃতিমনা এই দম্পতির চার পুত্র ও সাত কন্যা। সন্তানদের প্রায় সকলেই জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। তাদের মধ্যে সনজীদা খাতুন, ফাহমিদা খাতুন, মাহমুদা খাতুন, কাজী আনোয়ার হোসেন ও কাজী মাহবুব হোসেন পরিচিত মুখ।

৮৪ বছর বয়সে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে ১৯৮১ সালের ৯ অক্টোবর ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন তিনি।

(দিরিপোর্ট২৪/ডব্লিউএস/জেএম/নভেম্বর ০৯, ২০১৩)