রোমেনা আফরোজ

 

বিন্দু প্রতিদিনের মতো বিভাসের দরজায় মৃদু শব্দ করে। একবার,  দু’বার। কিন্তু ওপাশ সাড়াশব্দহীন। সচরাচর এমন হয় না। দরজায় মৃদু আঘাত পড়ার সাথে সাথে ভেতর থেকে মানুষটার  নাড়াচাড়ার শব্দ পাওয়া যায়।  আবার কোন কোনদিন বিভাস কে বলে আওয়াজও দেয় । সে জানে, বিভাসের ঘুম খুব একটা গভীর নয়।

একবার শঙ্কা জাগে, কাল হয়তো বিভাস অনেক রাত করে বাসায় ফিরেছে । গত এক সপ্তাহ ধরে স্বপ্না আর রূপা্র ওপর দায়িত্ব চাপিয়েছে দরজা খোলার। তাই সে এখন টের পায় না বিভাসের আগমন। এসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে, বিন্দু সন্তর্পণে দরজা খুলে প্রবেশ করে রুমের ভেতর। তার আগমনে ঘুমন্ত মানুষটার পূর্বের অবস্থানের কোনরকম হেরফের হয় না। কিছু আলো, কিছু অন্ধকারে চোখ বুলিয়ে সে বুঝে নেয়, বরাবরের মতো কাল রাতেও মশারি টাঙানো হয়নি। বিছানায় শুয়ে থাকা মানুষটার ওপর চোখ পড়তে ক্ষণমুহূর্ত থমকে দাঁড়ায় বিন্দু। আজ চেনা


"এসব কীর্তির কথা স্বপ্না কিংবা রূপাকে কোনদিন জানতে দেয়নি বিন্দু। সে কখনো চায়নি বাবার এসব অস্বাভাবিক কর্মকাণ্ড মেয়েদের মনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলুক। তাই ছোটবেলা থেকে দুই কন্যাকে তাড়াতাড়ি ঘুমের অভ্যাস রপ্ত করিয়েছে।"...


বিভাসকে কেমন যেন অপরিচিত লাগছে। তার নিচের অংশে কিছু নেই। শুধু একটা স্যান্ডো গেঞ্জি পরা। এই নগ্নতা কেমন যেন আঘাত করে চোখকে। শুধু চোখকে নয়। মনকেও। আসলে পোশাকের আড়ালে থাকা বিভাসের হঠাৎ এমন আবরণহীন হয়ে পড়ায় বুঝি অচেনা লাগার কারণ। বিন্দু কিছুক্ষণ স্তব্ধ, কী যেন ভাবে! সে ভাবনার কোনো কুল কিনার নেই। এক গহীন অতল থেকে ভেসে উঠে আবার তাকায় বিভাসের দিকে। ভাবে, মানুষকে আসলে তার পোশাকই সুন্দর করে তোলে। তাকে নগ্নতা কোনোদিন আকর্ষণ করেনি। নরনারীর দৈহিক সম্পর্ক দেখায় এরকম খোলামেলা সিনেমাও সে কখনো দেখেনি। এ নিয়ে স্বামীর সাথে অসংখ্যবার মনোমালিন্য এমনকি কথা কাটাকাটিও হয়েছে। সেসব অবশ্য বিয়ের প্রথম দিকের কথা। যখন বিভাসের কাছে তার অনেক প্রত্যাশা ছিল।

বিয়ের পর থেকে দেখছে, বিভাস মদ খায়।

প্রথম প্রথম স্বামীকে বোঝানোর চেষ্টা করতো বিন্দু। কিন্তু তার ভালবাসার প্রভাব ব্যর্থ হওয়ায় একসময় সকল উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা থেমে গেছে। তারপর থেকে সে নিরব দর্শক। মধ্যরাতে বাসায় ফেরা স্বামীর লাল চোখ, টলমল করা পা, চিৎকার চেঁচামেচি, বেমক্কা হাসি— সব হজম করে সে একা একা। এসব কীর্তির কথা স্বপ্না কিংবা রূপাকে কোনদিন জানতে দেয়নি বিন্দু। সে কখনো চায়নি বাবার এসব অস্বাভাবিক কর্মকাণ্ড মেয়েদের মনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলুক। তাই ছোটবেলা থেকে দুই কন্যাকে তাড়াতাড়ি ঘুমের অভ্যাস রপ্ত করিয়েছে।

মধ্যরাতের ঘন কালো অন্ধকার পাহারা দেওয়ার জন্য বিন্দু একা একা জেগে থাকে।

এক এক করে পাড়া প্রতিবেশীরা ঘুমিয়ে পড়ে। আশেপাশের, এমনকি দূরের ঝলমলে সব বাতি নিভে যায়। শুধু সে আর লাইটপোস্ট পাল্লা দেয়, একে অপরের সাথে। মাঝে মাঝে দু’একটা কুকুর নিজেদের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে কোথা যেন ডেকে ওঠে। তখন ভয়ে গা ছমছম। প্রতি রাতে অপেক্ষার এই সময়টাতে মনে হয়, পালিয়ে যায়। কিন্তু কোথায় যাবে?


"এসব চিন্তা করতে করতে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে বিন্দুর চোখেমুখে। আর মাত্র একঘণ্টা। তারপর নীলফামারী। সারাজীবনের বহু আকাঙ্ক্ষিত মুক্তির পথে সে এবার পা বাড়াবে। বিন্দু শেষবারের মত রুমটাকে দেখে নেয় গভীরভাবে। যতই অভিমান থাকুক না কেন তবুও এই রুমের প্রতি ইঞ্চিতে জড়িয়ে আছে মায়া। যদিও গত একবছর ধরে সে আর বিভাস একসাথে থাকে না।...


দু’সন্তানকে ছেড়ে কোথাও যাওয়ার কথা সে ভাবতেও পারে না। আর তিনজনকে আশ্রয় দেওয়ার মতো সংগতি তার পরিবার কিংবা আত্মীয়-স্বজনের নেই। এসব হিশাব মেলাতে গিয়ে কখন যেন কেটে গেছে পনেরো বছর! অবশ্য দীর্ঘ এই সময়ে সে বসে থাকেনি। চেষ্টা করেছে একটা চাকরির। ছোটখাটো যে কোনো ধরনের একটা চাকরি পেলেই সে ঠিক পালিয়ে যেতো। কিন্তু তার পড়াশুনা তো বেশি দূর নয়। সেই কলেজে পড়ার সময় বিভাসের সাথে বিয়ে হয়েছিলো। আর বিয়ের পর পরই স্বপ্না, রূপার আগমন। অনেক কষ্টে সংসার সামলে সে ডিগ্রি পরীক্ষা দিয়েছিল গতবছর। কিন্তু ঐ টেনেটুনে পাশ করা বিদ্যে দিয়ে যে চাকরি পাবে এমন প্রত্যাশা কোনদিন করেনি।

আজ কেন জানি পনেরো বছরের অসংখ্য স্মৃতি দরজায় কড়া নাড়ছে।

বিভাসকে ছেড়ে একটু পরে চলে যাবে দেখেই কি এসব পুরাতন স্মৃতিদের আনাগোনা? বিন্দু ভাবে, এই চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে সে অনেক দেরি করে ফেলেছে। তবে সারা জীবনের অবজ্ঞা, অবহেলার বিপরীতে এই প্রস্থানই একমাত্র উচিত জবাব। ঘুম থেকে উঠে স্বামী জেনে যাবে, সকল শৃঙ্খল ছিন্ন করে তার খাঁচার পাখিটি উড়াল দিয়েছে।

এসব চিন্তা করতে করতে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে বিন্দুর চোখেমুখে। আর মাত্র একঘণ্টা। তারপর নীলফামারী। সারাজীবনের বহু আকাঙ্ক্ষিত মুক্তির পথে সে এবার পা বাড়াবে। বিন্দু শেষবারের মত রুমটাকে দেখে নেয় গভীরভাবে। যতই অভিমান থাকুক না কেন তবুও এই রুমের প্রতি ইঞ্চিতে জড়িয়ে আছে মায়া। যদিও গত একবছর ধরে সে আর বিভাস একসাথে থাকে না। সে পাশের রুমে মেয়েদের সাথে ঘুমায়। বিছানা পৃথক করার সময় একবার ক্ষীণ আশা জন্মেছিল, এবার বুঝি একটু পরিবর্তন আসবে স্বামীর মধ্যে। কিন্তু বিভাস কোনও পরিবর্তনে ভীত নয়। এসব ভাবনা নতুন করে বিন্দুর মনে জেহাদ ঘটায়। সে পুনরায় উপলব্ধি করে, প্রস্থানের প্রয়োজনীয়তা। তবুও সুখের আনাচে কানাচে কোথা থেকে যেন বিষণ্ণতা উপচে পড়ে। এভাবে স্বপ্না, রূপাকে ফেলে যেতে হচ্ছে বলে বিন্দু গভীর যন্ত্রণায় বিমুঢ়। সে নিজেকে প্রবোধ দেয়, এই তো মাত্র কটা মাসের বিচ্ছেদ। সে বহুবার ভেবে দেখেছে, এ ছাড়া দ্বিতীয় কোনো পথ নেই। চাকরিতে জয়েন করে দু’তিন মাসের মধ্যেই সে নিয়ে যাবে মেয়েদের।


"একটা মৃদু গোঙানিও যেন শুনতে পায়। কি হলো লোকটার? কৌতূহল নয়, একটা অজানা আতঙ্ক ঘিরে ধরে তাকে। সে এগিয়ে যায়। বিভাসের কপালে হাত রেখে চমকে ওঠে। মানুষটার গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। বিন্দু তাড়াতাড়ি বিছানার পাশ থেকে কাঁথা নিয়ে ঢেকে দেয় স্বামীকে। রুম থেকে বের হয়ে থার্মোমিটার খুঁজতে যাবে, এমন সময় মোবাইলের গুঞ্জন। তখনি মনে পড়ে ট্রেনের কথা। বিন্দু জানে, খালাতো ভাই স্টেশনে অপেক্ষা করবে। কিন্তু এখন তার এসব ভাবার অবকাশ নেই। আগে বিভাসের জ্বর কমুক।...


হঠাৎ বিন্দুর মনে হয়, বিভাস বুঝি কাঁপছে। সে জানে, রাতে বাসায় ফেরার পর বিভাসের কোন হুশ জ্ঞান থাকে না। একবার শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রটা চালু করার পর বন্ধ করার কথা মনেও হয় না। রাতের সেই হিম বাতাসে এখন ঘরটা একেবারে ঠান্ডা। হয়তো এই ঠান্ডা বাতাসের কারণেই বিভাসের কাঁপুনি। একটা স্যান্ডো গেঞ্জি ছাড়া তো তার গায়ে আর কিছু নেই। একটা পাশবালিশ জড়িয়ে শুয়ে থাকা প্রায় নগ্ন বিভাসকে দেখে একবার মনে হয়, এ যেন বিভাস নয়, একটা অবোধ শিশু। ঠিক এইভাবেই স্বপ্না রূপাও ঘুমাতো। একটি সুতার প্রান্তে চিন্তাটা দুলতে দুলতে কেমন যেন মায়া্র স্ফুরণ। বিভাস তো আসলে জানে না, নেশা করতে করতে কখন তাকে নেশাই গ্রাস করে নিয়েছে। এই নেশার কারণে সে চারপাশের জগৎ এমনকি দুই সন্তানের কাছ থেকেও একরকম বিচ্ছিন্ন।

বিন্দু যার কারণে সংসার ত্যাগের মতো কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে সেই পুরুষকে মনের অজান্তে দেখছে, মায়াভরা চোখে।

একবার ভেতর থেকে কেউ প্রশ্ন করে, স্বপ্না রুপাও তো কত অন্যায় করে।
তখন সে শাসন করে তাদের। বোঝায়। কিন্তু কখনো তো ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবে না। তবে স্বামীর ক্ষেত্রেই কেন পালিয়ে যাবার কথা মনে হতো এতো বছর! বিভাস তো সুস্থ নয়। মদ তার বুদ্ধিমত্তাকে কবেই গ্রাস করে নিয়েছে। এই যে মেয়েদের ফেলে সে অতোদূর যাচ্ছে, এ কদিন যাতে ওদের কষ্ট না হয় সেজন্য একটা কাজের মেয়ে ঠিক করেছে। প্রয়োজন পড়লে ওরা যাতে রান্নাবান্না করতে পারে তারজন্য টুকিটাকি রান্নাও শিখিয়েছে। তারপরেও কত শঙ্কা, ভয়, দুর্ভাবনা। তবে কেন স্বামীর বেলাতেই সে এভাবে পালিয়ে যাচ্ছে? একটা দ্বিধা ক্ষণিক উঁকি দিয়েই বিদ্যুৎ গতিতে মিলিয়ে যায়। দু’দিন আগে কেটে রাখা ট্রেনের টিকিট বিন্দুর মনের ভেতরে তাগাদা দেয়।

অনেক কষ্টে রূপম একটা চাকরির ব্যবস্থা করেছে। এর জন্য তাকে কিছু টাকাও গুনতে হয়েছে। এখন আর এসব দ্বিধাদ্বন্দ্ব, মায়ার কোনও অর্থ নেই। একটা জেদ চেপে ধরে। বিন্দু রুম থেকে বের হতে যাবে এমন সময় আবার কেঁপে ওঠে বিভাস। একটা মৃদু গোঙানিও যেন শুনতে পায়। কি হলো লোকটার? কৌতূহল নয়, একটা অজানা আতঙ্ক ঘিরে ধরে তাকে। সে এগিয়ে যায়। বিভাসের কপালে হাত রেখে চমকে ওঠে। মানুষটার গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। বিন্দু তাড়াতাড়ি বিছানার পাশ থেকে কাঁথা নিয়ে ঢেকে দেয় স্বামীকে। রুম থেকে বের হয়ে থার্মোমিটার খুঁজতে যাবে, এমন সময় মোবাইলের গুঞ্জন। তখনি মনে পড়ে ট্রেনের কথা। বিন্দু জানে, খালাতো ভাই স্টেশনে অপেক্ষা করবে। কিন্তু এখন তার এসব ভাবার অবকাশ নেই। আগে বিভাসের জ্বর কমুক।

(দ্য রিপোর্ট/একেএমএম/জানুয়ারি ১৮,২০১৯)