জিএফআইর প্রতিবেদন
দেশ থেকে এক বছরে পাচার ৫০ হাজার কোটি টাকা
দেশ থেকে অস্বাভাবিক হারে টাকা পাচার বেড়েছে। ২০১৫ সালে বাংলাদেশ থেকে চার প্রক্রিয়ায় ৫৯০ কোটি ডলার (দেশীয় মুদ্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা) পাচার হয়েছে। সোমবার (২৮ জানুয়ারি) প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। এই পরিমাণ অর্থ দিয়ে দুটি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব। ওয়াশিংটন থেকে জিএফআইর এ রিপোর্ট প্রকাশ হয়।
জিএফআইর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৪টি প্রক্রিয়ায় এই অর্থ পাচার হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি মূল্য বেশি দেখানো (ওভার ইনভয়েসিং), রফতানিতে মূল্য কম দেখানো (আন্ডার ইনভয়েসিং), হুন্ডি ও অন্য মাধ্যমে বিদেশে লেনদেন এবং ভিওআইপি ব্যবসা।
জিএফআইর তথ্যমতে, ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে ৫ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে, যা দেশের চলতি বছরের (২০১৮-২০১৯) জাতীয় বাজেটের চেয়েও বেশি। প্রতিবছর গড়ে পাচার হয়েছে প্রায় ৫৫ হাজার কোটি টাকা। টাকা পাচারে বিশ্বের শীর্ষ ৩০ দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশের নাম।
এছাড়া অর্থ পাচারে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের পরই বাংলাদেশের অবস্থান। সংস্থাটির মতে, বাংলাদেশের মোট বাণিজ্যের প্রায় ২০ শতাংশই কোনো না কোনোভাবেই পাচার হচ্ছে। তবে ২০১৫ সালে বাংলাদেশেও ২৮০ কোটি ডলার এসেছে বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান গণমাধ্যমকে বলেন, অর্থ পাচার সংক্রান্ত যে তথ্য প্রকাশ করেছে প্রতিষ্ঠানটি, তা যাচাই করে দেখব।
এরপর আনুষ্ঠানিক মতামত জানাব। সাধারণত আমদানি-রফতানির আড়ালে অর্থ পাচার হয়ে থাকে। তবে গোটা পৃথিবীতে বিশ্ববাণিজ্যের মাধ্যমে অর্থ পাচার হচ্ছে। এ বিষয়ে এখন সবাই সতর্ক। আমরাও বিষয়টি দেখব।
প্রতিবেদনে ২০০৬ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ১৪৮টি দেশের অর্থ পাচারের তথ্য উঠেছে। আলোচ্য সময়ে উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে ১ ট্রিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ না হওয়ায় টাকা পাচার বেড়েছে। এছাড়া দুর্নীতিও টাকা পাচারের অন্যতম কারণ। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, সুনির্দিষ্ট তথ্য পেলে টাকা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেবে।
জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, দেশের মোট বিনিয়োগের ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ আসে বেসরকারি খাত থেকে। কিন্তু চলতি অর্থবছরে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ কমছে। বিপরীতে ২ বছর ধরে বেড়েছে আমদানি ব্যয়।
ধারণা করা হচ্ছে, ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে বিদেশে টাকা পাচার হয়েছে। অর্থাৎ যন্ত্রপাতির মূল্য বেশি দেখিয়ে বিদেশে টাকা পাচার করা হচ্ছে। তিনি বলেন, সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে বিষয়টি অবশ্যই খতিয়ে দেখতে হবে। কারণ একবার বিদেশে টাকা গেলে, তা ফেরত আনা খুব কঠিন।
প্রসঙ্গত, জিএফআই হল ওয়াশিংটনভিত্তিক একটি অলাভজনক সংস্থা, যারা উন্নয়নশীল দেশগুলোর অবৈধ আর্থিক প্রবাহ বা মুদ্রা পাচার নিয়ে গবেষণা ও বিশ্লেষণ করে থাকে। একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সরকার নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সঙ্গে অর্থ পাচার রোধে বিভিন্ন রকম পরামর্শ ও নীতিগত সহায়তা দিয়ে থাকে। এরই অংশ হিসেবে প্রতিবছর তারা এ প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে। মূলত দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পার্থক্য থেকে এ রিপোর্ট করে জিএফআই।
উদাহরণস্বরূপ বাংলাদেশ যে সব পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি করে, যুক্তরাষ্ট্র আবার ওইসব পণ্য বাংলাদেশ থেকে আমদানি দেখায়। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সরকারি তথ্যে দেখা গেল, তারা যুক্তরাষ্ট্রে তিন বিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি করেছে।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের তথ্য দেখা গেল তারা বাংলাদেশ থেকে ৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে। এর মানে হল- বাংলাদেশ ১ বিলিয়ন ডলারের রফতানির তথ্য গোপন করেছে। ওই অর্থ পাচার হিসেবে ধরা হয়। যেহেতু সব দেশের বাণিজ্যের তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়, সে কারণে রিপোর্ট প্রকাশ করতে জিএফআইয়ের ২ বছর সময় লেগে যায়।
সংস্থাটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৫ সালে উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে ১ ট্রিলিয়ন ডলার অর্থ পাচার হয়েছে। টাকার অঙ্কে যা ৯০ লাখ কোটি টাকা। আর ২০১৪ সালে পাচার হয়েছে ১ দশমিক ১ ট্রিলিয়ন ডলার, যা টাকার অঙ্কে দাঁড়ায় ৯১ লাখ কোটি টাকা। প্রতি ডলার ৮৫ টাকা ধরে এ হিসাব করা হয়েছে।
জিএফআই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিবছর গড়ে ৬৫১ কোটি ডলার সমপরিমাণ অর্থ বাংলাদেশ থেকে পাচার হচ্ছে। ২০১০ সালে ৫৪০ কোটি ডলার অর্থ পাচার হয়েছিল। তিন বছরের ব্যবধানে এ অর্থ বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৯৬৬ কোটি ডলারে। তবে ২০১৪ সালে ৯১১ কোটি ডলার। আর ২০১৫ সালে তা ৫৯০ কোটি ডলার।
গত দশ বছরে ৬ হাজার ৩০০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ অর্থ বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে। জিএফআই এবার অর্থ পাচারের হিসাবে একটু পরিবর্তন এনেছে। এর ফলে অর্থ পাচারের পরিমাণ বেড়ে গেছে বলে উঠে এসেছে। পণ্য বা সেবা আমদানিতে ওভার ইনভয়েসিং এবং রফতানিতে আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে এ অর্থ পাচার হচ্ছে বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে ২০০৫ সালে ৪২৬ কোটি ডলার, ২০০৬ সালে ৩৩৭ কোটি, পরের বছর ২০০৭ সালে ৪০৯ কোটি ডলার পাচার হয়। ২০০৮ সালে পাচারের পরিমাণ ৬৪৪ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। ২০০৯ সাল থেকে পরবর্তী দু’বছর অর্থ পাচার কিছুটা কমে আসে। ওই বছর ছিল ৫১০ কোটি ডলার। এ ছাড়া ২০১০ সালে ৫৪০ কোটি, ২০১১ সালে ৫৯২ কোটি ডলার সমপরিমাণ অর্থ পাচার হয়। ২০১২ সালে ৭২২ কোটি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে অর্থ পাচারে ভারতের পরের অবস্থানে বাংলাদেশ। ২০১৫ সালে দেশটি থেকে টাকা পাচারের পরিমাণ ৯৮০ কোটি ডলার।
জিএফআইর রিপোর্ট অনুসারে ২০১৫ সালে পাচারের দিক থেকে শীর্ষে রয়েছে মেক্সিকো। ওই দেশ থেকে পাচার হয়েছে ৪ হাজার ২৯০ কোটি ডলার, দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা মালয়েশিয়া ৩ হাজার ৩৭০ কোটি ডলার, ভিয়েতনাম ২ হাজার ২৫০ কোটি, থাইল্যান্ড ২ হাজার ৯০ কোটি, পানামা ১ হাজার ৮৩০ কোটি এবং ইন্দোনেশিয়া থেকে ১ হাজার ৫৪০ কোটি ডলার পাচার হয়েছে।
শিল্প বিনিয়োগে মন্দার মধ্যেও শিল্পের যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানি বেড়েছে। এ নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে। তাদের মতে, শিল্পের যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানির নামে দেশ থেকে টাকা পাচার করা হচ্ছে। কেননা যেভাবে শিল্পের যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানি হয়েছে, সেভাবে শিল্পের উৎপাদন বাড়েনি। তাহলে আমদানি করা ওইসব শিল্প উপকরণ কোথায় গেল?
কৃষিতে কয়েক বছর ধরে বাম্পার ফলন হওয়ার পরও সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাপকভাবে চাল আমদানি বেড়েছে। সরকারিভাবে বলা হচ্ছে, দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ, তারপরও কেন চাল আমদানি হচ্ছে। এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক তদন্তে দেখা গেছে, শিল্পের যন্ত্রপাতি ভর্তি কনটেইনারে পাওয়া গেছে ছাই, ইট, বালি, পাথর ও সিমেন্টের ব্লক। এতে শিল্পের কোনো যন্ত্রপাতি পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরে শুল্ক গোয়েন্দাদের তদন্তে খালি কনটেইনার আমদানির ঘটনাও ধরা পড়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে ভুয়া রফতানি এলসি (ঋণপত্র) এবং ক্রয়চুক্তির মাধ্যমে টাকা পাচার হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে এ ধরনের বেশকিছু ঘটনা ধরা পড়েছে।
গত তিন বছরে মালয়েশিয়া সরকারের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, বিদেশির জন্য মালয়েশিয়ান সরকারের সেকেন্ড হোম প্রকল্পে বাংলাদেশ দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বিনিয়োগকারী দেশ। এর আগে মালয়েশিয়া সরকারের এক কর্মকর্তা জানিয়েছিলেন, সেখানে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বিদেশি বিনিয়োগকারী দেশ বাংলাদেশ। যদিও দেশ থেকে বিদেশে কোনো টাকা নিতে হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন লাগে।
জানা গেছে, গত ১০ বছরে মালয়েশিয়ায় বিনিয়োগের ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কাউকে কোনো অনুমোদন দেয়নি। সংশ্লিষ্টদের প্রশ্ন- এরপরও বাংলাদেশ মালয়েশিয়ায় কীভাবে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বিনিয়োগকারী দেশ হল। এ প্রসঙ্গে অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ড. মইনুল হোসেন জানান, নিশ্চিত ওইসব টাকা পাচার করা হয়েছে।
যেহেতু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোনো অনুমোদন নেই মালয়েশিয়ায় টাকা নেয়ার। তারপরও টাকা গেছে। বুঝতে অসুবিধা নেই যে, এই টাকা পাচার হয়েছে। কানাডায় বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি বসবাস করেন এমন একটি এলাকার নাম হয়েছে বেগমপাড়া। বিশেষ দুর্নীতিবাজ রাজনৈতিক নেতারা ওখানে টাকা পাচার করে সম্পদ গড়ে তুলেছেন।
সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, হংকংয়ে অনেক বাংলাদেশি ব্যবসায়ীর অফিস রয়েছে। সেখানে তারা পুঁজি পাচার করে নিয়মিত ব্যবসা করছেন।
(দ্য রিপোর্ট/এনটি/জানুয়ারি ২৯, ২০১৯)