দ্য রিপোর্ট ডেস্ক :  ডয়চে ভেলের মাশরাফির এ সাক্ষাৎকারটির বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। এতে অনেক কিছু উঠে এসেছে। রেডিসন ব্লু হোটেলে দেওয়া সাক্ষাত্‍কারটি বিশ্বকাপ স্বপ্ন-সম্ভাবনা-প্রস্তুতি নিয়ে শুরু হয়ে ছড়িয়েছে আরো অনেক দিকে৷ মাশরাফির অধিনায়কত্ব, মাশরাফির বোলিং, মাশরাফির ইনজুরি, মাশরাফির রাজনীতি– আরো কত কী! তাই দ্য রিপোর্টের পাঠকদের জন্য গুরুত্ব বিবেচনায় এখানে পত্রস্থ করা হচ্ছে। এটি তিন কিস্তিতে ছাপা হবে। পড়ুন দ্বিতীয় কিস্তি।

বিশ্বকাপের ১৫ সদস্যের স্কোয়াডের সদস্যই আপনার কাছে গুরুত্বপূর্ণ৷ কিন্তু যখন কাপ জয়ের লক্ষ্য নিয়ে টুর্নামেন্টে যাচ্ছেন, তখন বিশেষ করে কাদের কাছ থেকে ভালো পারফরম্যান্স চাইবেন?

-সবাই তো একবাক্যে আমাদের সিনিয়রদের কথা বলবেন৷ আমি কিন্তু এর উপর নির্ভর করি না৷ আপনি লিটন দাশকে দেখুন৷ এশিয়া কাপ ফাইনালে ও যে ইনিংস খেলেছে, দল জিতলে তা বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সর্বকালের অন্যতম সেরা ইনিংস হয়ে থাকত ৷ এখনো তা রয়েছে অবশ্য; জিতলে আলাদা মাত্রা পেতো৷ তো লিটনের এই সামর্থ্য যখন দেখেছি, ওর কাছ থেকে বিশ্বকাপে সেরাটাই আশা করব৷ সৌম্য আছে৷ দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ওর ইনিংসগুলোর কথা মনে আছে৷ তো আমি কেন ওদের কাছ থেকে এমন কিছু আশা করব না! ২০১৫ সালে আমাদের কোয়ার্টার ফাইনাল খেলার পেছনে তরুণ ক্রিকেটারদের ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি ছিল৷ এ কারণেই সিনিয়রদের চেয়ে আমি এই তরুণ ক্রিকেটারদের গুরুত্ব কোনো অংশে কম দেখি না৷

২০১৫ বিশ্বকাপের আগের সময়টা বাংলাদেশের ভালো যায়নি৷ ঠিক আগের সিরিজে ওয়ানডের অধিনায়ক বদলে আপনাকে নেতৃত্ব ফিরিয়ে দেয়া হয়৷ তুলনায় এবার দলের অবস্থা ভালো ৷ মাঝের চার বছর তো বটেই, গেল বছরটাও বাংলাদেশের জন্য খুব ভালো কেটেছে ৷ এটি ২০১৯ বিশ্বকাপে কতটা সাহায্য করবে?

-জয় আসলে খুব গুরুত্বপূর্ণ ৷ এটি দলের আত্মবিশ্বাস অন্য পর্যায়ে নিয়ে যায়৷ সামনে আমরা নিউজিল্যান্ড যাবো, এরপর আয়ারল্যান্ডে৷ বিশ্বকাপের আগে এই সফরগুলোয় আমি জয়ের ধারায় থাকতে চাইবো, যেন বিশ্বকাপে ভালো মানসিকতা নিয়ে যেতে পারি ৷ তবে না জিতলেও সমস্যা নেই ৷ ২০১৫ বিশ্বকাপের আগে দুটি প্রস্তুতি ম্যাচে পাকিস্তান ও আয়ারল্যান্ডের কাছে বাজেভাবে হেরেছি ৷ তখন আমাদের উপর কারো কোনো প্রত্যাশা থাকেনি ৷ এরপর আমরা ঘুরে দাঁড়িয়েছি ৷ তবে সামনের এই দুটো সফরে জেতার মধ্যে থাকলে ভালো৷

দলীয় পারফরম্যান্স থেকে এবার একটু আপনার ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সের জায়গায় আসি৷ বিশ্বকাপের জন্য বোলার হিসেবে প্রস্তুতি কেমন?

-এখনো অত দূর ভাবছি না৷ ওভাবে ভেবে আমি পারিও না৷ এখন বিপিএল চলছে৷ তা শেষ হলে নিউজিল্যান্ড সফর নিয়ে চিন্তা করব৷

বাংলাদেশের ওয়ানডে দলের বদলে যাওয়ায় অধিনায়ক মাশরাফির বড় অবদান৷ সে কৃতিত্ব সবাই আপনাকে দেন৷ কিন্তু তাতে যে বোলার মাশরাফি একটু আড়ালে চলে যায় এ নিয়ে কি দুঃখ আছে?

-(হেসে) না, একেবারেই না৷ মানুষ যদি কোনো পর্যায়ে এসে মিলিয়ে দেখে, আমি বোলার হিসেবে সেরাদের কাছাকাছি পারফর্ম করেছি, দল জেতার জন্য যা করা দরকার করেছি, তাহলে ভালো লাগবে৷ নিজের কাছেই ভালো লাগবে৷ আর নিজের কাছে ভালো লাগাই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শান্তি৷ তা বাদ দিয়ে আমরা অন্যের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি যে, আমাকে নিয়ে কী বলছে৷

একটা পরিসংখ্যান জানাই ৷ আপনি এ দফা অধিনায়ক হবার পর যতগুলো ওয়ানডেতে খেলেছে বাংলাদেশ, সেখানে সর্বোচ্চ উইকেট আপনার ৷ ৬৩ ম্যাচে নিয়েছেন ৮৪ উইকেট ৷ ৫৯ ম্যাচে ৭৬ উইকেট নিয়ে সাকিব আল হাসান দ্বিতীয়তে ৷ কোনো প্রতিযোগিতার ব্যাপার নেই, কিন্তু এই যে সবচেয়ে বেশি উইকেট শিকার, তা ব্যক্তিগতভাবে নিশ্চয়ই তৃপ্তি দেয়?

-ব্যক্তিগত তৃপ্তির ব্যাপার কী, অধিনায়ক যদি পারফর্ম করে সেটি দলের জন্য ভালো৷ অবশ্যই এতে আলাদা তৃপ্তি থাকে৷

আপনার ক্যারিয়ারে ইনজুরি হানা দিয়েছে বারবার৷ কিন্তু এ দফা অধিনায়ক হবার পর ইনজুরির কারণে একটি ম্যাচও মিস করেননি...

-(হেসে দিয়ে) আল্লাহ মাফ করুক, এ কথা বলবেন না৷ নজর দিয়েন না...

এ সময় বাংলাদেশ ৬৬টি ওয়ানডে খেলেছে, যার মধ্যে তিনটিতেই কেবল আপনি খেলেননি ৷ ধীরগতির ওভাররেটে নিষেধাজ্ঞার আশঙ্কায় ২০১৫ বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে, আর অধিনায়ক হিসেবে ওই ধীরগতির ওভাররেটের জন্য শাস্তি পেয়ে ২০১৫ সালে পাকিস্তান এবং ২০১৭ সালে আয়ারল্যান্ডে ত্রিদেশীয় সিরিজের প্রথম ম্যাচ৷ দুই হাঁটুতে সাতটি অস্ত্রোপচার হওয়া ক্রিকেটারের জন্য চার বছরের বেশি সময় নিজেকে প্রতিটি ম্যাচের জন্য ফিট রাখা কতটা কঠিন?

-আমি সবকিছু রুটিন মেনে করার চেষ্টা করেছি৷ সঙ্গে ভাগ্যও পক্ষে ছিল৷ ভাগ্য না থাকলে আসলে এটি সম্ভব না৷ বিপিএল কিংবা ঢাকা লিগের ম্যাচের আগেও আমার পুরোপুরি প্রস্তুতি নিতে হয়; রিল্যাক্সড হবার কোনো সুযোগ থাকে না৷ যে ম্যাচই খেলি না কেন, শারীরিকভাবে তো অনেক শক্তিক্ষয় হয়৷ সে প্রস্তুতি আমাকে রাখতে হয়৷ ওজন কখনো কমে, কখনো বাড়ে, এটিও একটি জায়গায় রাখার চেষ্টা করি৷ অন্যান্য সব জিনিস আমাকে ঠিক জায়গায় রাখতে হয়৷

অধিনায়কত্ব ক্যারিয়ারে কোন জয়গুলো বেশি আনন্দ দিয়েছে?

সত্যি বলতে কী, প্রতিটি জয় আনন্দ দিয়েছে ৷ তবু নির্দিষ্ট করে বললে, ২০১৫ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠা, সর্বশেষ এশিয়া কাপে সাকিব-তামিম ছাড়া পাকিস্তানকে হারানো, চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে কার্ডিফে নিউজিল্যান্ডকে হারানো– এমন কিছু ম্যাচ আছে৷ তবে আমরা যেহেতু নিজের দেশের পতাকার প্রতিনিধিত্ব করি, কোনো জয়ই তাই ফেলনা নয়৷ অনেকে হয়তো বলতে পারেন, জিম্বাবুয়ের সঙ্গে জেতা আর অমন কী! ভাই, হারলে বুঝি যে, কেমন কী! সে কারণেই বললাম, সব জয়ই আমার কাছে ভালো লাগে৷

আর কষ্টের হার?

-অধিনায়ক হবার পর তো?

হ্যাঁ৷

-ভারতের কাছে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে এক রানে হারটা খারাপ লেগেছে৷ এবার এশিয়া কাপ ফাইনালের হার খারাপ লেগেছে৷ ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে ১২ বলে ১৩ রান প্রয়োজন ছিল– এ অবস্থা থেকে হেরেছি৷ আসলে এমন ক্লোজ ম্যাচগুলোতে হার কষ্ট দেয় বেশি৷ এসব খেলায় জিততে পারলে নিজেদের দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারতাম, দলের জন্য ভালো হতো৷

ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সের একটি জায়গা মিস করে গিয়েছি৷ বাংলাদেশের প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে আপনি দুশ 'ওয়ানডে খেলেছেন, আড়াইশ' উইকেট নিয়েছেন৷ পরিসংখ্যানকে গুরুত্ব না দেবার কথা সবসময় বলেন, তারপরও যখন ক্যারিয়ার শেষ হবে, তখন এ পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে কতটা তৃপ্তি পাবেন?

-আমি আসলে একটু অন্যরকম৷ এমন পরিসংখ্যান তো ভালো লাগারই কথা৷ ক্যারিয়ার শেষে না, এখনই ভালো লাগার কথা৷ কিন্তু জানি না, আমি তা কেন পরি না৷ হয়তোবা খেলার মধ্যে আছি বলে৷ যখন খেলা ছেড়ে দেবো, তখন হয়তো এ ব্যাপারগুলো মাথার মধ্যে বেশি করে আসবে৷ সত্যি যে, পরিসংখ্যান মাথায় রেখে আমি ক্যারিয়ার শুরু করেছিলাম৷ যখন প্রথম টেস্টে চার উইকেট পাই, তখন স্বপ্ন হয়েছিল টেস্টে তিনশ’ উইকেট নেবোই৷ ওই দিনই দলের সঙ্গে সোনারগাঁ হোটেলে ফিরে ডায়েরিতে তা লিখে রেখেছিলাম, তারিখ-টারিখ দিয়ে৷ ওয়ানডেতে কোনো টার্গেট ছিল না, কিন্তু লক্ষ্য ছিল টেস্টে তিনশ’ উইকেট নেবো৷ তখন আমার বয়স ১৭-১৮ বছর৷ ছোটবেলার স্বপ্ন তৈরি হয়েছে টেস্ট ক্রিকেট দিয়ে৷ তো ইনজুরির কারণে ওই টেস্টের স্বপ্নে যখন আঘাত লেগেছে, এরপর আর পরিসংখ্যান-টরিসংখ্যান নিয়ে চলি না৷ স্রেফ খেলি, উপভোগ করি আর বাংলাদেশ ক্রিকেটকে প্রতিনিধিত্ব করি ৷ এই প্রতিনিধিত্ব করার চেয়ে বড় অর্জন আমার জীবনে আর কিছু নেই ৷ এর চেয়ে বড় কিছু আসবে বলেও মনে করি না৷ প্রতি ম্যাচে নামি এই ভেবে যে, খেলার কোনো ক্ষেত্রে আমার যেন একটু অবদান থাকে ৷

কিছু দিন আগে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজে আপনার অবসর নিয়ে বেশ আলোচনা হয়েছিল৷ বিশ্বকাপের আগে দেশের মাটিতে জাতীয় দলের আর খেলা নেই বলে বাংলাদেশে সেটিই আপনার সম্ভাব্য শেষ ম্যাচ ধরে নেন অনেকে৷ সিলেটে শেষ ওয়ানডের পর আপনি যদিও স্পষ্ট করে বলেছেন, বিশ্বকাপ থেকে দেশে ফিরে অবসরের বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানাবেন৷ সিলেটের ওই ম্যাচের পরও তো মাসখানেক পেরিয়ে গেছে ৷ এ সময়ে কখনো কি মনে হয়েছে, বাংলাদেশের মাটিতে আর হয়তো আপনার খেলা হবে না?

-দেখুন, আমার ক্রিকেটীয় শারীরিক অবস্থা উন্নতির দিকে যাবে না ৷ পায়ে এখন আগের চেয়ে বেশি ব্যাথা করে ৷ আগের চেয়ে বেশি জিম করলেও ব্যাথা যায় না ৷ ম্যাচ শেষে পা সামলাতে অনেক সময় লাগে ৷ আগে এক দিনে সামলে উঠতাম, এখন সময় লাগে আরো বেশি ৷ বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এবং আমার পায়ের সমস্যা মিলিয়ে এগুলো হচ্ছে ৷ সেক্ষেত্রে নিজেও পরিষ্কার বুঝতে পারছি, আমি আর বেশি দিন ক্রিকেটে থাকতে পারব না ৷ সেটি যদি পারফর্ম করি, তবুও পারব না, কারণ, আমার শরীর সে সমর্থনটা দিচ্ছে না৷ বেশি দিন ক্রিকেটে থাকব না, সেটি তাই নিশ্চিত ৷ কিন্তু কত দিন থাকব, তা নিশ্চত না৷ বিশ্বকাপ শেষে পরিস্থিতিই হয়তো ঠিক করবে কী করা উচিত৷ সেটি দলের ফলের উপর নির্ভর করতে পারে; আবার আমার শারীরিক অবস্থার উপরও নির্ভর করতে পারে৷ এগুলো নিয়ে আমি ভাবি না, কেননা, তা আমার নিয়ন্ত্রণে নেই৷ এখন চেষ্টা করছি, বিশ্বকাপ পর্যন্ত খেলার জন্য যেন ফিট থাকি৷ ক্রিকেট আমার অনেক বড় আবেগের জায়গা৷ এটি ছেড়ে দেবার সিদ্ধান্ত নেয়াটা অত সহজ হবে না৷ কিন্তু আমি হুট করেই সিদ্ধান্ত নেবো ৷ এটিই আমার চরিত্রের ধরণ৷ (আগামী কিস্তিতে সমাপ্ত)

(দ্য রিপোর্ট/একেএমএম/ফেব্রুয়ারি ০১, ২০১৯)