অনুগল্প
একটি প্রতিশোধ
রোকেয়া আশা
আমি প্রথমবার যখন তাকে মারার চেষ্টা করি তখন সে রীতিমত অলৌকিকভাবে বেঁচে যায়।
সে রোজ রাতে ঘুমুতে যাওয়ার আগে একগ্লাস গরম দুধ খেতো। হুইলচেয়ারে বন্দী হওয়ার পরেও তার অভ্যাসের ব্যত্যয় ঘটেনি। আমি তার গ্লাসের মধ্যে গুনে গুনে একুশটা স্লিপিং পিল মিশিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু সে যখন দুধ খাওয়ার জন্য গ্লাসটা হাতে নেয় তখন তাতে একটা মাছি ভেসে থাকতে দেখে।
নভেম্বরের ঢাকায় একটা বহুতল বিল্ডিংয়ের ছয় তলায় মাছি কিভাবে এলো সেটা ভেবে আমিও হতভম্ব হয়ে পড়ি। এজন্যেই বলছি, তার সে বার বেঁচে যাওয়া অলৌকিক ছিলো।
আমার তীব্র হতাশা চলে আসে, টানা একুশ দিন রাতে ঘুমোনোর আগে আমি মুখের এক কোণে স্লিপিং পিল লুকিয়ে রেখে রেখে অতগুলো পিল জমিয়েছিলাম। তার ঘুমের ওষুধ খাওয়ার অভ্যাস নেই, রোজ রাতে আমাকেই স্লিপিং পিল খেয়ে ঘুমাতে হয়। ডাক্তারের নির্দেশে নয়, তার নির্দেশে। এটা গত দুই বছর ধরেই চলছে।
দুই বছর আগে সে আমাকে দত্তক নেয়; ডিভোর্সী, নিঃসংগ একজন মধ্যবয়সী পুরুষ। দেখতে বয়স আরো কম লাগে।
আমার গায়ের কালো রঙ আর মুখে অজস্র বসন্তের দাগের জন্য আমার তেরো বছর বয়স অব্দি কোথাও এডপশন হচ্ছিলো না। মানুষ বাচ্চা দত্তক নিতে গেলেও ফর্সা চামড়ার সুন্দর বাচ্চা খোঁজে।
বেসরকারি এসব এতিমখানা সম্পর্কে যারা জানেন না, তারা কল্পনাও করতে পারবেন না তেরো বছর বয়স অব্দি একটা মেয়ের কোথাও এডোপশন না হওয়া কতটা ভয়াবহ অবস্থা তৈরী করতে পারে। ওখানে আমাকে যা সহ্য করে থাকতে হয়েছে সেটা খারাপ ছিলো, সেজন্যেই এই মধ্যবয়সী লোকটি আমায় দত্তক নেওয়ার পর আমি এত খুশি হয়েছিলাম।
সে আমায় তার বিশাল ফ্ল্যাটে নিয়ে আসে, বাড়িতে সে ছাড়াও বিভিন্ন কাজের জন্য তিনজন মানুষ ছিলো।
আমাকে একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয়, লেজার ট্রিটমেন্ট করিয়ে মুখের বসন্তের দাগ গুলো সারিয়ে তোলে।
লোকটি বিত্তবান ছিলো।
সে আমার খেয়াল রাখতো, রোজ রাতে স্লিপিং পিল খাইয়ে ঘুমোতে পাঠাতো। কারণ জানতে চাইলে বলেছিলো, ওটা এন্টি ডিপ্রেশন পিল। আমার অনাথ জীবনের দুঃসহ অভিজ্ঞতা নাকি আমাকে ডিপ্রেশনের মধ্যে রেখেছে।
অবিশ্বাস করার কোন কারণ ছিলো না তার কথা।
তবে, এক বছর পার হওয়ার পর প্রথম যেদিন আমি ঘুমানোর কিছুক্ষণ আগে বমি করে পিলটা ফেলে দিই, সেদিন রাতেই আমি তার আসল রূপটা চিনতে পারি। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে আমি টের পাই, লোকটি আমাকে চেপে ধরে আছে। আমার গায়ের সাথে আরেকটি পুরুষ শরীর সেটে আছে, এরচে জঘন্য কিছু আমি কখনো দেখিনি। এরচে আমার এতিমখানার জীবন ভালো ছিলো। আমি চিৎকার করে উঠি, সে চমকে যায়। মুখ চেপে ধরে আমার।
আমার সেরাতে বমি করার কারণটা স্পষ্ট হলো কিছুদিনের মধ্যেই।
এসিডিটি কিংবা সাধারণ কোন অসুখ নয়, আমি তখন দেড় মাসের অন্তঃসত্ত্বা।
সে আমাকে জোর করেই এবরশন করায়। আমার স্কুল, পড়াশোনা, নাচের ক্লাস - কোন কিছুতে পরিবর্তন আসতে দেয় না সে। বাইরের পৃথিবীতে তার পরিচিতি ছিলো এখন মহৎ মানুষ হিসেবে। যে কিনা অনাথ একটা মেয়েকে যেচে মানুষ করছে।
অভিশাপ গায়ে লাগে কিনা আমি জানিনা, হয়তো লাগে।
নাহলে সম্পূর্ণ সুস্থ সে- ঠিক আমার এবরশনের তিন মাস পর স্ট্রোক কিভাবে করে?
সে মরেনি, তবে কোমর থেকে শরীরের নিম্নার্ধ পুরো প্যারালাইজড হয়ে যায়।
তার পর, তার একুশ দিন পর আমি তাকে প্রথমবার মারার চেষ্টা করি।
কিন্তু সে বেঁচে যায় একটি মাছির জন্য।
আমি তখনই সিদ্ধান্ত নেই, তাকে মারবো না।
সে অসহায় ভাবে পরনির্ভশীল হয়ে মরার মত করে বেঁচে থাকুক।
সম্ভবত এজন্যেই, এবরশন করার পর থেকে টানা তিনমাস আমি তার খাবারে তারই ল্যাব থেকে চুরি করা আর্সেনিক মেশানোর পরেও সে মারা যায়নি।
বলা হয়নি, সে রসায়নের শিক্ষক ছিলো একটি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এমনকি বাড়িতেও তার একটি ব্যক্তিগত ল্যাবরেটরি ছিলো।
(দ্য রিপোর্ট/একেএমএম/মার্চ ১৯,২০১৯)