স্বাধীনতার মর্মার্থ
সামসুন্নাহার মনি
ছোটবেলায় ‘চয়নিকা’ নামক সহপাঠে একটি পল্প পড়েছিলাম। গল্পটির নাম ছিল ‘স্বাধীনতা’। গল্পটি এরকম- ক্লাসে পণ্ডিত স্যার স্বাধীনতা শব্দটির অর্থ জানতে চাইলেন। চিরা চরিত নিয়মে ফার্স্টবয়কে জিজ্ঞাসা করা হলো। উত্তর পাওয়া গেল না। একে একে স্যার সবাইকে জিজ্ঞেসা করলেন। করো উত্তর জানা নেই। শিক্ষক জানালেন, স্বাধীনচেতা মানে নিজের অধীনতা।
অর্থটা ছাত্রদের কাছ বোধগম্য হলোনা। যাহোক স্কুল শেষে সবাই বাড়ি ফিরল। কিন্তু ফার্স্টবয় সুবলের মনে শব্দটি দাগ কাটল। বিকেলে সুবলের মা একটি কাজে বাড়ির বাইরে গেলেন। যাওয়ার আগে মা সুবলকে বলে গেলেন, ভাঁড়ার ঘরে দুইটি আম রাখা আছে, মাঠ থেকে ফিরে সুবল যেন একটি আম নিজে খায় অন্যটি ছোট বোনকে দেয়। খেলা শেষে সন্ধ্যায় মাঠ থেকে ফিরে ক্লান্ত-ক্ষুধার্ত সুবল ভাড়াঁর ঘরে যেয়ে দেখল, একটি আম পচা, অন্যটি ভালো। দোটানায় পড়ে গেল সে। এখন কী করা উচিত তার? পাশেই ছিল পণ্ডিত স্যারের বাড়ি। ছুটে গেল সেখানে। স্যারকে জিজ্ঞেস করল, এখন কী করা উচিত তার ? স্যার বললেন, এটাই তো স্বাধীনতা। গল্পটি এখানে শেষ হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু আমার ছোট্ট মনে বার বার একটি প্রশ্ন দোলা দিত, শেষ পর্যন্ত সুবল কী করেছিলো। সুবল কি স্বাধীনতা শব্দের অর্থ আত্মস্থ করতে পেরেছিল- ‘নিজের অধীনতা’।
এত বছর পর স্বাধীনতা শব্দের সঠিক অর্থ কি আমরা জানাতে সক্ষম হয়েছি আমাদের স্বাধীনতা পরবর্তী প্রজন্মকে?
১৯৭১ - গণিতের প্রয়োজনে সংখ্যাগুলি অনেকবার ব্যবহার করলেও বাঙালির কাছে এ সংখ্যাটির গুরুত্ব আকাশসম। বাঙালির অধিকার আদায়ের বছর, মানচিত্রের রূপরেখা পাল্টে দিয়ে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্ম লাল- সবুজের পতাকা হাতে নিয়ে।
নয় মাস জননী সহস্র কোটিবার লাঞ্ছিত হয়ে, লক্ষ লক্ষ সূর্য সন্তানকে উৎসর্গ করে প্রসব করল বাংলাদেশ নামক ছোট্ট একটি রাষ্ট্রের।
বাঙালির জীবনে একটি ঘটনাবহুল বছর ১৯৭১। কিন্তু ঘটনার শুরু হয় ১৯৪৭ সাল থেকে । ভারত উপমহাদেশকে দুটি ভাগে ভাগ করা হলো রাজনীতির খোলস পরিয়ে ক্ষমতালোভী নেতাদের প্রয়োজনে। এরমধ্যে বাংলাদেশ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান মিলে হলো পাকিস্তান ।এই দুইদেশের অধিবাসীদের মধ্যে ধর্ম ছাড়া আর কোন বিষয়ে মিল ছিল না। অথচ ধরে বেঁধে এক করা হলো যেন জোর যার মুলুক তার ফর্মূলা। কিন্তু অত্যাচার করে তো আর যাই হোক মূলুক ধরে করা যায় না। পাঞ্জাবীরাও ব্যর্থ এলো। বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভুত্থান বাঙালিকে দেখাচ্ছিল স্বপ্ন , আর জোগাচ্ছিল সাহস স্বাধিকার আন্দোলনের। পরবর্তীতে যা রূপ নেয় স্বাধীন সার্বভৌম জন্মভূমি-বাংলাদেশে।
অনেক চড়াই-উতরাই পার হয়ে আমাদের স্বাধীনতার বয়স এখন ৪৮ বছর। সূর্য এখন মধ্যগগনে। পাওয়া না পাওয়ার হিসেব। এত কঠিন হিসেবে না যাই। ভাবি বর্তমান প্রজন্মকে নিয়ে। আমাদের ডিজিটাল উত্তরাধিকারী। আমাদের ফেসবুক প্রজন্ম।তাদের কি আমরা সঠিক ইতিহিস জানাতে পেরেছি? তারা কি স্বাধীনতায় চেতনায় উজ্জীবিত ? তারা কি অনেক দাম দিয়ে কেনা জন্মভূমিকে ভালোবাসে ? তারা কি শহীদের রক্তের প্রতি সম্মান জানাতে প্রস্তুত? সবগুলি প্রশ্নের ইতিবাচক।মাঝে মাঝে আমাদের ভুলত্রুটি ধরিয়ে দিয়ে বলে , আমরা সঠিক পথেই এগিয়ে যাচ্ছি। লাল- সুবজের পতাকা হাতে নিয়ে তারা রাস্তায় দাঁড়িয়ে বলে,
"যদি তুমি ভয় পায় , তাহলে তুমি শেষ, যদি তুমি ঘুরে দাড়াঁও তাহলে বাংলাদেশ।" মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে তারা মাথা উচুঁ করে, অধিকার আদায়ের লড়াই করতে শিখেছে। এরা বন্ধূকে হারিয়ে নিরাপদ সড়কের দাবী করে, যুদ্ধাপরাধের বিচার চায়, শিক্ষাখাতে আরোপিত অযৌক্তিক ভ্যাট আন্দোলনের বিরোধিতা করে। সাবাস! বাংলাদেশ।সাবাস তারুণ্য।
হাঁটিহাঁটি পা করে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। অর্থনীতি, প্রযুক্তি, শিক্ষা, ক্রিকেট প্রতিটি ক্ষেত্রে স্বাধীনতাত্তোর প্রজন্ম তাদের মেধার স্বাক্ষর রাখছে, জন্মভূমির মুখ উজ্জ্বল করছে। ১৯৭১ এর ভূমিষ্ঠ শিশু এখন পরিণত যুবা, যে শুধু জানে সত্য, সাহস, নিষ্ঠা, মেধা, মননে মাতৃভূমিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে।
ব্যতিক্রম নয় আমাদের সংস্কৃতি অঙ্গনও,বিশেষত গান-কবিতায় মুক্তিযুদ্ধের ভূমিকা অনন্য। যার ধারাবাহিকতা লক্ষ্যণীয়। আমাদের স্বাধীনতা গান, কবিতা , গল্প-উপন্যাস, সিনেমার একটি আলোচিত, আলোড়িত বিষয়। স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসকে উপজীব্য করে আমাদের সংস্কৃতি অঙ্গন হয়েছে সমৃদ্ধ অনেকখানি।
আলোকিত জীবন তারুণ্যের। ১৯৭১ এর আলোয় আলোকিত হয়ে সোনার বাংলার গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা অতীতে রেখেছে তারুণ্য। বর্তমানেও রাখছে, ভবিষ্যতেও রাখবে। জয় হোক স্বাধীনতার, জয় হোক তারুণ্যের। নিশ্চয় তারা আত্মস্থ করতে সক্ষম হবে-স্বাধীনতা মানে নিজের অধীনতা।
লেখক : প্রাবন্ধিক
(দ্য রিপোর্ট/একেএমএম/মার্চ ২৬, ২০১৯)