চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদ : ইসলামী দৃষ্টিকোণ-২
এস কে জামান
(পূর্ব প্রকাশের পর)
চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদের উত্থানের কারণ
সন্ত্রাসবাদ নতুন কিছু নয়, প্রাচীন যুগে শক্তিধর গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে নিষ্ঠুর উপজাত তথা স্বজাতিগণ ভয়াবহ নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসযজ্ঞ চালাতো শক্তি প্রদর্শন করার জন্য। সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে এ কার্যক্রমের ধরণ ও কারণ পাল্টাচ্ছে ।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে ইউরোপে জঙ্গিবাদের উত্থান হয় । সে সময় জার্মানির নাৎসিবাহিনী গোটা ইউরোপ জুড়ে তাণ্ডব লীলা চালায় । পরে ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে ত্রাস সৃষ্টির করে । তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে ধর্মীয় কুসংস্কার ও দরিদ্রতাকে পুঁজি করে এক শ্রেণির চরমপন্থীগোষ্ঠী ধর্মীয় অপব্যাখার মাধ্যমে তরুণ সমাজকে উগ্রপন্থী করে তোলে । পাশাপাশি সমাজের বিত্তবানদের ছেলে-মেয়েদের ধর্মান্ধতার দিকে ঠেলে দেয় । আবার বিশ্বের বিভিন্নপ্রান্তে ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহার করে ব্যক্তি স্বার্থ হাসিল ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার লোভ দেখিয়ে তরুণ প্রজন্মকে ভুলপথে পরিচালিত করছে । সন্ত্রাসবাদের আরো উল্লেখযোগ্য কারণ হচ্ছে-
(ক) প্রকৃত ধর্মীয় শিক্ষার অভাব
(খ) সমাজের অভ্যন্তরে গভীর ভারসাম্যহীনতা ও বিত্তের বৈষম্য
(গ) ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহার
(ঘ) দেশের অভ্যন্তরে পারাজিত শক্তির সহিংস উত্থান ; বিপথে বিত্ত ও পেশী শক্তির উত্থান
(উ) আধুনিক ও মানবিক শিক্ষার অভাব
(চ) মানুষের সাধ্যের সঙ্গে স্বপ্নের এবং চাওয়ার সঙ্গে পাওয়ার অসীম দূরত্ব
(ছ) ন্যায় ও সত্যের প্রতি জনগণের আস্থাহীনতা
(জ) সামাজিক সচেতনতার অভাব
(ঝ) সামাজিক ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ন্যায় ও সাম্যের অভাব
(এ) মগজ ধোলাই
(ট) অশিক্ষা, দারিদ্র এবং কর্মসংস্থানের অভাব
বাংলাদেশে চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদের উত্থান
এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের প্রিয় জন্মভূমি একটি স্বাধীন সার্বভৌম উন্নয়নশীল গণতান্ত্রিক ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ বাংলাদেশ । এদেশের সমাজ কাঠামোতে সাম্প্রদায়িকতার লেশ মাত্র নেই । কিন্তু সময়ে সময়ে একটি কুচক্রিমহল এই সহবস্থানকে মতেই মনে প্রাণে গ্রহণ করতে পারেনি। তাই তারা বাংলাদেশের সাংবিধানিক গণতান্ত্রিক ধারা বিনষ্ট করে একটি চরম্পন্থী সন্ত্রাস কবলিত জঙ্গি রাষ্ট্র হিসাবে বিশ্ব দরবারে চিহ্নত করার প্রায়াস চালিয়ে আসছে । এদেশে সন্ত্রাসী কার্যক্রমের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায় আগে থেকে কিছু উগ্রপন্থি গোষ্টির উপস্থিতি থাকলেও চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদের আবির্ভাব দেখা যায় '৯০ এর দশকে ।
এ সময়ে অনেক ধর্মপ্রাণ মুসলমান আফগানিস্তান, কাশ্মীর, ইরাক, লেবানন ফিলিস্তিন সহ মধ্যপ্রাচের বিভিন্ন দেশে নির্যাতিত নিপীড়িত মুসলমানদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও ইসলামী শাসন কায়েমের উদ্দেশ্যে সশস্ত্র যুদ্ধের প্রশিক্ষণ ও যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে । ওই সময় তারা বিভিন্ন ইসলামী জঙ্গি সংগঠনের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে অনেকে দেশে ফিরে আসে এবং পরবর্তীতে তাদের মাধ্যমে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদি সংগঠন তাদের কার্যক্রমের বিস্তৃতি ঘটানোর প্রয়াস পায় । যার ফলে 'হারকাত-উল-জিহাদ-আল-ইসলাম' বা হুজির জন্ম হয় পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালে 'কিতাল-ফি-সাবিলিল্লাহ' বলে যাত্রা শুরু করে এটিই ১৯৯৮ সালে জামাতুল-মুজাহিদিন বা জে এমবিতে রূপান্তরিত হয় । ২০০১ সালে 'হিযবুত তাহরির' এর উদয় এবং বিকাশ বৈশ্বিক আর্থ সামাজিক অবস্থা ও অস্থির রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেই হয়েছিল ।
পরবর্তী প্রজন্মের জন্ম হয় ২০০৭ সালে 'জামাতুল মুসলেমীনের' যা পরে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নামে তৎপরতা চালায় এবং ২০১৪ সালে সারা বিশ্বব্যাপী ইসলামিক স্টেটের উদ্ভবের সাথে সাথে এই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে কেউ কেউ সিরিয়াতে যুদ্ধ করতেও বেরিয়ে পড়ে ।
এভাবে বিভিন্ন সময়ে নানাবিধ কারণে জন্ম নেয়া এসব চরম্পন্থী ও সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলোর নেতৃবৃন্দ ও সদস্যদের গ্রেফতার করে শাস্তির আওতায় আনা হলেও তাদের তৎপরতা কমে গেলেও একেবারে নিঃশেষ হয়ে যায় নি ।
চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদের গতি-প্রকৃতি
মানুষের জন্মগত স্বভাব প্রকৃতি, প্রবণতা, মানসিক অবস্থানের সঙ্গে পরিবার ও সমাজের শিক্ষা, সংস্কৃতি, স্বপ্ন, ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষা এবং অর্জনের বিক্রিয়াগুলো নির্মাণ করে তার আত্মপরিচয় । জগত সংসারে নানা ঘাত- প্রতিঘাত, সফলতা, বিফলতা, সামগ্রিক প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির প্রেক্ষাপটে ঐ পরিচয় নিবিড় ভাবে মিশে যায় । কল্পিত শিকড় সত্যিকারের শিকড়ের কথা ভুলিয়ে দেয় । ভুলিয়ের দেয় নৃতাত্ত্বিক পরিচয় ও বাস্তবতার বিষয়টি । এতে অতি কাছের মানুষ বা গোষ্ঠীকে দূরের মানুষ বলে প্রতীয়মান হয় । এভাবেই নষ্ট ভাবাদর্শে দীক্ষিত হয়ে শত্রুজ্ঞান করে কল্পিত বিরোধী পক্ষ আর সাধারণ মানুষকে। উপেক্ষিত হয় শিকড়ের বন্ধন, সামাজিক ও মানবতার বন্ধন এমনকি আত্মীয়তার ঐক্য । ধীরে ধীরে এই আত্মা হয়ে উঠে বেপরোয়া ও পরমত অসহিষ্ণু যাকে বলা হয় মগজ ধোলাই । এই পরিস্থিতিতে তাকে দিয়ে সকল প্রকার কাজ করানো সম্ভব । ছোট খাট অপরাধ থেকে শুরু করে মানুষ হত্যা পর্যন্ত করতে দ্বিধা করে না সে । যদিও অন্যায়ভাবে মানুষ হত্যা করাকে ইসলাম কঠোর ভাবে নিষেধ করেছে ।
পাশ্চ্যাতের আগ্রাসনে চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদ
পাশ্চাত্য বিশ্ব যেমন তার হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার মানসে একটি নষ্ট মুল্যবোধ ও পরিচয় নির্মাণ করেছে, যা সভ্যতা ও মানবতার কপট বহিরাবরণ ধারণ করেছে । ওই সন্ত্রাসীচক্র বৃহত্তম বলয়ের মধ্যে ক্ষুদ্রতম ইউনিট সৃষ্টি করে কল্পিত আদিম ও নিষ্ঠুরসত্তাকে আপন মনে করে চরম মানববিধ্বংসী খেলায় মেতে উঠেছে । পাশ্চাত্যবিশ্ব আপন প্রয়োজন মেটানোর জন্য অনুকূল পরিবেশ চায় । তাদের সীমাহীন লোভ ও ক্রোধে উত্তর আফ্রিকা ও আরব দেশগুলিতে নিরন্তর রক্তপাত ঘটিয়ে যাচ্ছে । পূর্ব এশিয়ায় গণহত্যার লীলাভূমি বানিয়েছে; আফগানিস্তান, ইরাক, ও সিরিয়ায় হাজার বছরের সভ্যতা ও সংস্কৃতি মুছে অগণিত মানুষের বুকের পাঁজর গুড়িয়ে বিশ্ব সভ্যতার সুতিকাগার গুলো একের পর এক শ্মশান বানাচ্ছে ।
যেভাবে ইসলামের নামে চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদের যাত্রা
ইসলামের ইতিহাসে প্রথম চরমপন্থী দল হিসাবে খারেজি সম্প্রদায়ের আবির্ভাব ঘটে । মানবতার মুক্তির দিশারী মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এর ইন্তেকালের পর খোলাফায়ে রাশেদার আমলে হযরত ওসমান (রা.) এর শাহাদাতের ঘটনাকে কেন্দ্র করে এ দলের অভ্যুদয় ঘটে । হযরত আলী (রা) ও আমিরে মুয়াবিয়া (রা) এর মধ্যে দ্বন্দ্ব সংঘাতের ফলে সংঘটিত সিফফিনের যুদ্ধে ব্যাপক রক্তক্ষয় হলে হযরত আলী (রা.) সালিশীর মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিলে তারই অনুসারীদের মধ্য থেকে একদল বিদ্রোহ করে বসে । এরা প্রায় সকলেই ছিল যুবক । পরে তাদেরকে খারেজী বা দলত্যাগী হিসাবে চরমপন্থী নামে অভিহিত করা হয় । (ক্রমশ)
লেখক : প্রাবন্ধিক ও ব্যাংকার
(দ্য রিপোর্ট/একেএমএম/এপ্রিল ০৯,২০১৯)